আবীর আহাদ


মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রক্ষাপটে রচিত ১৯৭২-এর সংবিধানের মূলনীতিমালার মধ্যে ''মানবিক মর্যাদা'' বলে দু'টি হৃদয়হরা শব্দ রয়েছে। এটি কেবল একটি রাজনৈতিক স্লোগান নয়; বরং একটি মুক্তিকামী জাতির জীবনদর্শন ও অঙ্গীকারের প্রতিশ্রুতি। এ শব্দযুগল মূলত সমাজতান্ত্রিক তথা সাম্যবাদী চেতনা থেকে উৎসারিত হলেও তা বাঙালির দীর্ঘ রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এবং বিশ্বমানবতার সার্বজনীন আকাঙ্ক্ষার সাথে মিশে গিয়ে বিশেষ অর্থ লাভ করেছে।

মুক্তিযুদ্ধ ও মানবিক মর্যাদা

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ ছিল কেবল ভূখণ্ডের স্বাধীনতার জন্য নয়, বরং মানুষের মর্যাদা ও শোষণমুক্ত জীবনের জন্য সংগ্রাম। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী পূর্ববাংলাকে শুধু অর্থনৈতিকভাবে লুণ্ঠন করেনি, রাজনৈতিকভাবে বঞ্চিত করেছে এবং সাংস্কৃতিকভাবে হেয় করেছে। “তোমরা দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক”-এই বার্তাই প্রতিদিন চাপিয়ে দেয়া হচ্ছিল। তাই স্বাধীন বাংলাদেশের ঘোষণাপত্রে ঘোষণা দেয়া হয়: “সকল নাগরিকের মানবিক মর্যাদা, সমতা এবং সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা হবে।”

মার্কসবাদ ও মানবিক মর্যাদা

মার্কসবাদী দর্শন মানুষকে কেবল উৎপাদনের যন্ত্র হিসেবে নয়, বরং ইতিহাসের সক্রিয় স্রষ্টা হিসেবে চিত্রিত করেছে। অর্থনৈতিক শোষণ ও শ্রেণিবৈষম্যের অবসান ঘটিয়ে মানুষকে তার পূর্ণ মর্যাদায় ফিরিয়ে দেয়ার প্রতিশ্রুতিই মার্কসবাদী সমাজতত্ত্বের মূল কথা। সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের সেই প্রভাব ২০ শতকে এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার মুক্তিসংগ্রামগুলোতে স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধও এই বৈশ্বিক ঢেউ থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল না।

পাশ্চাত্য বনাম সমাজতান্ত্রিক প্রভাব

অন্যদিকে পাশ্চাত্যের লিবারেল ডেমোক্রেসি ধারায় মানব মর্যাদার উৎস ব্যক্তিস্বাধীনতা ও মৌলিক অধিকারে। সেখানে মানুষ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে নিজ অধিকারের রক্ষক। কিন্তু সমাজতান্ত্রিক ধারায় মানব মর্যাদা সমষ্টির মুক্তি, সামাজিক ন্যায়বিচার ও অর্থনৈতিক সাম্যের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠে। বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণাপত্রে এই দুই প্রবাহের অনন্য সংমিশ্রণ ঘটেছে- গণতান্ত্রিক স্বাধীনতার সাথে সমাজতান্ত্রিক ন্যায়বিচার।

বঙ্গবন্ধুর দৃষ্টিভঙ্গি

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বারবার বলেছিলেন—“আমাদের সংগ্রাম কেবল রাজনৈতিক নয়, অর্থনৈতিক মুক্তির সংগ্রামও।” স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সংসদে সমাজতন্ত্রকে রাষ্ট্রের অন্যতম ভিত্তি হিসেবে ঘোষণা দিতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন: “এদেশের মানুষের মৌলিক অধিকার, ন্যায্য পাওনা এবং মর্যাদা প্রতিষ্ঠাই হবে আমাদের লক্ষ্য।” তাঁর রাজনৈতিক দর্শনের কেন্দ্রে তাই মানবিক মর্যাদা ছিল অবিচ্ছেদ্য অংশ।

সংবিধানে প্রতিফলন

১৯৭২ সালের সংবিধানের প্রস্তাবনায় লেখা হলো: “জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা- এই মূলনীতিগুলি হইবে রাষ্ট্রের মূলনীতি এবং এ রাষ্ট্র সকল নাগরিকের মানবিক মর্যাদা, সাম্য, ও সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করিবে।” এখানে “মানবিক মর্যাদা” কেবল নিছক নীতিগত ঘোষণা নয়, বরং রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রত্যেকটি শাখার জন্য নির্দেশক নীতি হিসেবে নির্ধারিত।

আজকের প্রাসঙ্গিকতা

আজ যখন বৈশ্বিক পুঁজিবাদী প্রবাহ আবারো বৈষম্য বাড়িয়ে তুলছে, তখন সংবিধানের “মানবিক মর্যাদা” শব্দ দু'টি আরও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। দারিদ্র্য, বৈষম্য, দুর্নীতি ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হলে এই মূলনীতিকেই সামনে আনতে হবে। মুক্তিযুদ্ধ কেবল ইতিহাস নয়, বরং চলমান এক শাশ্বত আদর্শ- যেখানে মানবিক মর্যাদা রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিকের মৌলিক অধিকার হয়ে থাকবে।

অতএব, মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণাপত্র ও সংবিধানে যে “মানবিক মর্যাদা”র প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল, তার ভিত্তি নিছক একটি রাজনৈতিক ধারায় সীমাবদ্ধ নয়। এর পেছনে রয়েছে সমাজতান্ত্রিক ও মার্কসবাদী দার্শনিক ঐতিহ্য, পাশ্চাত্য মানবাধিকারের ধারণা, বঙ্গবন্ধুর মুক্তিকামী চিন্তা এবং সর্বোপরি বাঙালি জাতির ত্যাগ-তিতিক্ষা ও আত্মমর্যাদার ইতিহাস। এ শব্দদ্বয় তাই আমাদের রাষ্ট্রদর্শনের আত্মা, যা আজও আমাদের পথ দেখায়।

লেখক : মুক্তিযোদ্ধা লেখক ও গবেষক।