গণতন্ত্রের বৈশ্বিক সংকট ও আশার আলো: আন্তর্জাতিক গণতন্ত্র দিবসের প্রাসঙ্গিকতা

ওয়াজেদুর রহমান কনক
বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্রের বর্তমান চিত্র একদিকে অগ্রগতির, অন্যদিকে গভীর সংকটের প্রতিচ্ছবি বহন করছে। ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের ডেমোক্রেসি ইনডেক্স ২০২৩-এর তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বের ১৬৭টি দেশের মধ্যে মাত্র ২৪টি পূর্ণ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র, যেখানে প্রায় ৭২% মানুষ কর্তৃত্ববাদী বা অগণতান্ত্রিক প্রবণতাসম্পন্ন শাসনব্যবস্থার অধীনে বাস করছে। একই বছরের ভি-ডেম (Varieties of Democracy) রিপোর্ট জানায় যে গত এক দশকে গণতান্ত্রিক মানদণ্ডের অবনমন বিশ্বব্যাপী দ্রুত বেড়েছে, বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়া ও সাব-সাহারান আফ্রিকার অনেক দেশে রাজনৈতিক স্বাধীনতা ও মতপ্রকাশের অধিকার উল্লেখযোগ্যভাবে সীমিত হয়েছে। জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির গবেষণা বলছে, শক্তিশালী গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাসম্পন্নদেশগুলোর মানব উন্নয়ন সূচক গড়ে প্রায় ২০% বেশি এবং মাথাপিছু জিডিপি প্রবৃদ্ধি কর্তৃত্ববাদী দেশগুলোর তুলনায় গড়ে ১৫% উচ্চ। এই পরিসংখ্যানগুলো প্রমাণ করে যে গণতন্ত্র শুধু শাসনব্যবস্থার একটি ধরন নয়, বরং অর্থনৈতিক উন্নয়ন, সামাজিক ন্যায়বিচার ও মানবাধিকারের সাথে সরাসরি সম্পর্কিত। ঠিক এই কারণেই ১৫ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক গণতন্ত্র দিবস প্রতি বছর বিশ্বজুড়ে উদযাপিত হয়, যাতে গণতন্ত্রের মূল্যবোধ ও ন্যায়বিচার রক্ষার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে নতুন করে সচেতনতা সৃষ্টি করা যায়।
আন্তর্জাতিক গণতন্ত্র দিবস বিশ্বের নানা দেশে ভিন্ন ভিন্ন আকার ও আয়োজনে পালিত হয় এবং প্রতিটি দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও নাগরিক সমাজের ঐতিহ্য অনুযায়ী এর রূপ আলাদা। ইউরোপের দেশগুলোতে যেমন যুক্তরাজ্য, নরওয়ে ও জার্মানিতে সংসদ ভবন বা সিটি হলে জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত সেশন ও সেমিনার আয়োজন করা হয়, যেখানে সংসদ সদস্য ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ, মানবাধিকার ও আইনের শাসন নিয়ে আলোচনা করেন। এসব দেশে বিশ্ববিদ্যালয় ও নাগরিক সংগঠনগুলো মুক্ত মতপ্রকাশের গুরুত্ব ও নির্বাচন প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা নিয়ে জনসচেতনতা ক্যাম্পেইন চালায় এবং অনলাইন প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে তরুণদের অংশগ্রহণ বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়।
যুক্তরাষ্ট্রে এই দিনটি ৯/১১ হামলার স্মরণ অনুষ্ঠানগুলোর প্রভাবের মধ্যেও নাগরিক অধিকার ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ নিয়ে আলোচনার মাধ্যমে চিহ্নিত হয়। অনেক থিঙ্ক ট্যাঙ্ক ও বিশ্ববিদ্যালয় গণতন্ত্র ও শাসনব্যবস্থার পরিবর্তনশীল প্রকৃতি নিয়ে প্যানেল আলোচনা ও প্রদর্শনী আয়োজন করে। দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলো যেমন চিলি, ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনায় মানবাধিকার সংগঠনগুলো গণতন্ত্র দিবসে সামরিক শাসনের অতীত স্মরণ করে এবং সামাজিক ন্যায়বিচার, দুর্নীতি রোধ ও স্বচ্ছ প্রশাসনের দাবি তোলে।
ভারত, বাংলাদেশ ও নেপালসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে নাগরিক সংগঠন, এনজিও ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো দিবসটি উপলক্ষে গোলটেবিল বৈঠক, ছাত্রসমাবেশ ও প্রবন্ধ প্রতিযোগিতা আয়োজন করে। বাংলাদেশের গণমাধ্যমে এই দিনটি নিয়ে সম্পাদকীয় ও টকশো প্রচারিত হয়, যেখানে নির্বাচন কমিশনের স্বচ্ছতা, রাজনৈতিক সংস্কার ও তরুণ প্রজন্মের রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা নিয়ে আলোচনা হয়। আফ্রিকার ঘানা ও দক্ষিণ আফ্রিকার মতো দেশগুলোতে স্থানীয় সরকার ও এনজিও মিলিতভাবে গণতন্ত্র শক্তিশালীকরণ এবং দুর্নীতিবিরোধী উদ্যোগ নিয়ে সচেতনতামূলক ক্যাম্পেইন চালায়, যা সাধারণ মানুষের কাছে গণতন্ত্রের মৌলিক গুরুত্ব তুলে ধরে।
মধ্যপ্রাচ্যের কিছু দেশ যেমন তিউনিসিয়া বা জর্ডান, যেগুলো সাম্প্রতিক বছরগুলোতে রাজনৈতিক রূপান্তর দেখেছে, তারা দিবসটি উপলক্ষে রাজনৈতিক সংস্কার ও সুশাসনের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে সেমিনার ও কর্মশালা আয়োজন করে। তিউনিসিয়ার বিশ্ববিদ্যালয় ও সাংবাদিক সংগঠনগুলো আরব বসন্ত-পরবর্তী গণতান্ত্রিক অভিজ্ঞতা নিয়ে বিশ্লেষণাত্মক আলোচনা করে, আর জর্ডানে স্থানীয় যুব সংগঠনগুলো রাজনৈতিক অংশগ্রহণ ও স্বচ্ছতার গুরুত্ব নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়া ক্যাম্পেইন চালায়। অস্ট্রেলিয়া ও কানাডায় নাগরিক শিক্ষা কর্মসূচি এবং স্কুল পর্যায়ের কর্মশালার মাধ্যমে গণতন্ত্রের মূল ধারণা শিক্ষার্থীদের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়।
জাতিসংঘ সদরদপ্তর ও আঞ্চলিক কার্যালয়গুলোতেও এদিন বিশেষ আলোচনাসভা ও প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে বিশ্বনেতা, গবেষক এবং সুশীল সমাজের প্রতিনিধি একত্রিত হয়ে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান রক্ষার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন। এই বহুমুখী উদযাপন প্রমাণ করে যে আন্তর্জাতিক গণতন্ত্র দিবস শুধু একটি আনুষ্ঠানিক তারিখ নয়, বরং এটি বিভিন্ন দেশের নিজস্ব অভিজ্ঞতা ও চ্যালেঞ্জের আলোকে গণতন্ত্রকে নতুন করে মূল্যায়নের একটি বৈশ্বিক প্ল্যাটফর্ম।
১৫ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক গণতন্ত্র দিবস জাতিসংঘ ঘোষিত একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন, যা গণতন্ত্রের মৌলিক মূল্যবোধ, ন্যায়বিচার এবং জনগণের অধিকার রক্ষার প্রতি বৈশ্বিক প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করে। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ ২০০৭ সালের ডিসেম্বরে ৬২তম অধিবেশনে (A/RES/62/7) এই দিবসের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেয় এবং ২০০৮ সালে প্রথমবার আনুষ্ঠানিকভাবে উদযাপিত হয়। দিবসটির মূল উদ্দেশ্য হলো গণতন্ত্রকে কেবলমাত্র একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থার নাম হিসেবে না দেখে, সামাজিক ন্যায়বিচার, মানবাধিকার, অংশগ্রহণমূলক শাসন, স্বচ্ছতা, এবং টেকসই উন্নয়নের অবিচ্ছেদ্য উপাদান হিসেবে বিশ্ববাসীর সামনে উপস্থাপন করা। জাতিসংঘ এই দিবসের মাধ্যমে সরকার, সুশীল সমাজ এবং সাধারণ মানুষকে একত্রিত করে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানকে শক্তিশালী করা এবং অধিকার সংরক্ষণে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে উদ্বুদ্ধ করতে চায়।
গণতন্ত্রের বাস্তব অবস্থা বিশ্লেষণ করলে একটি জটিল বৈশ্বিক চিত্র স্পষ্ট হয়। ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের ডেমোক্রেসি ইনডেক্স ২০২৩ অনুযায়ী ১৬৭টি দেশের মধ্যে মাত্র ২৪টি পূর্ণ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র, ৫০টি ত্রুটিপূর্ণ গণতন্ত্র, ৩৪টি মিশ্র শাসনব্যবস্থা এবং ৫৯টি কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থা বিদ্যমান। ২০২৩ সালের গড় বৈশ্বিক গণতন্ত্র স্কোর ছিল ৫.২৩ (১০-এর মধ্যে), যা ২০২০ সালের ৫.৩৭ থেকে সামান্য হ্রাস নির্দেশ করে। ভি-ডেম ইনস্টিটিউটের ২০২৪ সালের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে বিশ্বের প্রায় ৭২% মানুষ এখন কর্তৃত্ববাদী বা গণতন্ত্রহীন প্রবণতাসম্পন্ন দেশে বাস করছে, যা ১৯৯০ দশকের তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। একই সময়ে, গ্লোবাল বারোমিটার সার্ভের তথ্যে দেখা যায় যে দক্ষিণ এশিয়ার প্রায় ৫৪% মানুষ এখনও গণতন্ত্রকে সর্বোত্তম শাসনব্যবস্থা হিসেবে বিশ্বাস করে, কিন্তু প্রায় ৩৫% মানুষ মনে করেন তাদের দেশের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান দুর্বল বা কার্যকর নয়।
জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (UNDP) তথ্য অনুযায়ী, গণতান্ত্রিক দেশগুলির মানব উন্নয়ন সূচক (HDI) কর্তৃত্ববাদী দেশগুলির তুলনায় গড়ে প্রায় ২০% বেশি। বিশ্বব্যাংকের গভর্নেন্স ইন্ডিকেটর অনুযায়ী, গণতান্ত্রিক দেশগুলো দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ ও সরকারি কার্যকারিতা সূচকে সর্বোচ্চ স্থানে থাকে। ২০২২ সালের করাপশন পারসেপশন ইনডেক্সে শীর্ষ দশ দেশের মধ্যে নয়টি পূর্ণ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রেও গণতন্ত্রের ইতিবাচক প্রভাব সুস্পষ্ট: ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের বিশ্লেষণ অনুসারে, দৃঢ় গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানসম্পন্ন দেশগুলির মাথাপিছু জিডিপি বৃদ্ধি কর্তৃত্ববাদী দেশগুলির তুলনায় গড়ে ১৫% বেশি।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আন্তর্জাতিক গণতন্ত্র দিবস বিভিন্ন সামাজিক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আলোচনা, সেমিনার ও গণমাধ্যম কাভারেজের মাধ্যমে গুরুত্ব সহকারে পালিত হয়। ইন্টারন্যাশনাল আইডিয়ার ২০২৩ সালের প্রতিবেদনে বাংলাদেশকে একটি হাইব্রিড রেজিম হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে—যেখানে নির্বাচন ও গণতন্ত্রের আনুষ্ঠানিক কাঠামো রয়েছে, কিন্তু গণতান্ত্রিক মানদণ্ড ও প্রাতিষ্ঠানিক স্বচ্ছতায় ঘাটতি রয়ে গেছে। এশিয়া ফাউন্ডেশনের এক সমীক্ষায় দেখা যায়, বাংলাদেশের প্রায় ৬১% মানুষ গণতন্ত্রকে সর্বোত্তম শাসনব্যবস্থা মনে করেন, কিন্তু প্রায় ৪২% মানুষ নির্বাচনী প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।
আন্তর্জাতিক গণতন্ত্র দিবস তাই শুধু আনুষ্ঠানিক উদযাপনের একটি দিন নয়, বরং এটি বিশ্বব্যাপী নাগরিক সমাজ, সরকার ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর জন্য একটি সতর্কবার্তা এবং অঙ্গীকারের মুহূর্ত। এটি স্মরণ করিয়ে দেয় যে গণতন্ত্র রক্ষার জন্য নিরবচ্ছিন্ন প্রচেষ্টা প্রয়োজন—যেখানে স্বচ্ছতা, ন্যায়বিচার, জবাবদিহিতা এবং জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ অপরিহার্য। এই দিবসের আলোচনা ও কর্মসূচি প্রমাণ করে যে গণতন্ত্রকে শক্তিশালী না করলে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (SDGs), মানবাধিকার সংরক্ষণ এবং বৈশ্বিক শান্তির ভবিষ্যৎ হুমকির মুখে পড়তে পারে।
১৫ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক গণতন্ত্র দিবস বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্রের মূল্যবোধ, ন্যায়বিচার এবং জনগণের মৌলিক অধিকার রক্ষার অঙ্গীকারকে পুনঃস্মরণ করিয়ে দেয়। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ ২০০৭ সালে এই দিবস ঘোষণা করে এবং ২০০৮ সাল থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে উদযাপন শুরু হয়। এই উদ্যোগের মূল প্রেক্ষাপট ছিল বিশ্বব্যাপী রাজনৈতিক অস্থিরতা, কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থার পুনরুত্থান, এবং নাগরিক অধিকার সংকোচনের মধ্যেও গণতান্ত্রিক মানদণ্ড শক্তিশালী করার প্রয়োজনীয়তা। জাতিসংঘের মতে, গণতন্ত্র কেবল একটি শাসনব্যবস্থা নয়, এটি মানবাধিকার, স্বচ্ছতা, জবাবদিহি এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক অংশগ্রহণের মাধ্যমে সমাজের প্রতিটি স্তরে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার পথ।
বিশ্বের রাজনৈতিক চিত্র বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে গণতন্ত্রের অগ্রগতি ও সংকট একই সঙ্গে বিদ্যমান। ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের ডেমোক্রেসি ইনডেক্স ২০২৩-এর তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বের ১৬৭টি দেশের মধ্যে মাত্র ২৪টি পূর্ণ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। ৫০টি দেশ ত্রুটিপূর্ণ গণতন্ত্র, ৩৪টি মিশ্র শাসনব্যবস্থা এবং ৫৯টি দেশ কর্তৃত্ববাদী শাসনের অধীনে রয়েছে। ২০২৩ সালের বৈশ্বিক গড় স্কোর ছিল ৫.২৩ (১০-এর মধ্যে), যা ২০২০ সালের তুলনায় সামান্য নিম্নমুখী। ভি-ডেম ইনস্টিটিউটের ২০২৪ সালের বিশ্লেষণ জানায়, বর্তমানে বিশ্বের প্রায় ৭২% মানুষ কর্তৃত্ববাদী বা গণতন্ত্রহীন প্রবণতাসম্পন্ন দেশে বসবাস করছে, যেখানে দুই দশক আগে এ হার ছিল প্রায় ৪৬%। গ্লোবাল বারোমিটার সার্ভের তথ্যে দেখা যায়, দক্ষিণ এশিয়ার প্রায় ৫৪% মানুষ গণতন্ত্রকে সর্বোত্তম শাসনব্যবস্থা মনে করেন, কিন্তু ৩৫% মানুষ বিশ্বাস করেন যে তাদের দেশের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্বল বা অকার্যকর।
গণতন্ত্রের সঙ্গে উন্নয়নের সম্পর্কও উল্লেখযোগ্য। জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির তথ্য অনুযায়ী, পূর্ণ গণতান্ত্রিক দেশগুলোর মানব উন্নয়ন সূচক কর্তৃত্ববাদী দেশগুলোর তুলনায় গড়ে প্রায় ২০% বেশি। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের বিশ্লেষণ অনুযায়ী, গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার অধীনে থাকা দেশগুলির মাথাপিছু জিডিপি প্রবৃদ্ধি সাধারণত কর্তৃত্ববাদী শাসনের তুলনায় অন্তত ১৫% বেশি। বিশ্বব্যাংকের গভর্নেন্স ইন্ডিকেটরগুলো দেখায় যে দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ ও সরকারি কার্যকারিতার ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক দেশগুলো ধারাবাহিকভাবে শীর্ষ স্থানে রয়েছে। ২০২২ সালের করাপশন পারসেপশন ইনডেক্সে শীর্ষ দশ দেশের মধ্যে নয়টি পূর্ণ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ছিল, যা প্রমাণ করে স্বচ্ছতা ও গণতন্ত্র পরস্পর পরিপূরক।
দিবসটি বিভিন্ন দেশে বিভিন্নভাবে উদযাপিত হয়। ইউরোপের দেশগুলো যেমন জার্মানি, যুক্তরাজ্য ও নরওয়েতে সংসদ ভবন বা সিটি হলে জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত সেশন ও আলোচনার আয়োজন হয়, যেখানে নাগরিকরা সরাসরি আইন প্রণেতাদের সঙ্গে গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ ও মানবাধিকার নিয়ে মতবিনিময় করেন। যুক্তরাষ্ট্রে দিবসটি প্রায়শই নাগরিক অধিকার ও গণতান্ত্রিক আদর্শের গুরুত্ব নিয়ে আলোচনা ও শিক্ষামূলক প্রোগ্রামের মাধ্যমে চিহ্নিত হয়। দক্ষিণ আমেরিকার চিলি, ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনায় মানবাধিকার সংগঠনগুলো সামরিক শাসনের অতীত স্মরণ করে এবং দুর্নীতি রোধ ও স্বচ্ছ প্রশাসনের দাবি তোলে। দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত, বাংলাদেশ ও নেপাল দিবসটি উপলক্ষে সেমিনার, গোলটেবিল বৈঠক এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রবন্ধ প্রতিযোগিতা আয়োজন করে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে গণমাধ্যম এই দিনটিকে ঘিরে সম্পাদকীয় প্রকাশ ও টকশো সম্প্রচার করে, যেখানে নির্বাচন কমিশনের কার্যকারিতা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং রাজনৈতিক সংস্কার নিয়ে আলোচনা হয়। আফ্রিকার ঘানা ও দক্ষিণ আফ্রিকায় স্থানীয় সরকার ও এনজিও মিলিতভাবে নাগরিকদের গণতান্ত্রিক অধিকার সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে প্রচারণা চালায়। মধ্যপ্রাচ্যের তিউনিসিয়া ও জর্ডান, যেখানে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে রাজনৈতিক পরিবর্তন হয়েছে, তারা সুশাসন ও রাজনৈতিক সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে সেমিনার ও কর্মশালা আয়োজন করে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই দিবসটি গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ও প্রক্রিয়াগুলোর শক্তি ও দুর্বলতা মূল্যায়নের একটি সুযোগ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ইন্টারন্যাশনাল আইডিয়ার ২০২৩ সালের প্রতিবেদনে বাংলাদেশকে হাইব্রিড রেজিম হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে, যেখানে নির্বাচন ও গণতান্ত্রিক কাঠামো বিদ্যমান থাকলেও প্রাতিষ্ঠানিক স্বচ্ছতা ও মানদণ্ডে ঘাটতি রয়েছে। এশিয়া ফাউন্ডেশনের এক সমীক্ষায় দেখা যায়, বাংলাদেশের প্রায় ৬১% মানুষ গণতন্ত্রকে সর্বোত্তম শাসনব্যবস্থা মনে করেন, তবে ৪২% নাগরিক নির্বাচনী প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন।
এই পরিসংখ্যান ও উদাহরণগুলো প্রমাণ করে যে গণতন্ত্র কেবল রাজনৈতিক প্রক্রিয়া নয়, এটি অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা, সামাজিক ন্যায়বিচার, মানবাধিকার এবং বৈশ্বিক শান্তির সাথে গভীরভাবে জড়িত। আন্তর্জাতিক গণতন্ত্র দিবস বিশ্ববাসীকে স্মরণ করিয়ে দেয় যে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ রক্ষা একটি অবিরাম প্রক্রিয়া, যেখানে নাগরিক সমাজের সক্রিয় অংশগ্রহণ, স্বচ্ছ নীতি ও জবাবদিহিতা অপরিহার্য। এটি একই সঙ্গে একটি বৈশ্বিক প্ল্যাটফর্ম, যা দেশগুলোকে নিজেদের গণতান্ত্রিক অর্জন ও ঘাটতি পর্যালোচনা করে আগামীর জন্য টেকসই পথনকশা প্রণয়নে উদ্বুদ্ধ করে।
লেখক : গণমাধ্যমকর্মী।