ভাঙ্গায় পুনরায় লাগাতার অবরোধ শুরু
.jpg)
রিয়াজুল রিয়াজ, বিশেষ প্রতিনিধি : বিপুল পরিমাণ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের মোতায়েন করেও আটকানো যায়নি ভাঙ্গা উপজেলার জনসাধারণকে। গতকাল শনিবার দিবাগত রাত থেকেই ভাঙ্গায় সেনাবাহিনী, র্যাব ও পুলিশ সহ হাজার হাজার অতিরিক্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের মোতায়েন করে সৃথানীয় প্রশাসন। আন্দোলনকারীদের শান্তিপূর্ণ অবরোধ কর্মসূচি পালনের পাশাপাশি যৌথ বাহিনীর টহল অব্যাহত রয়েছে।
শুক্র-শনি দু'দিন বিরতির পর আজ (রবিবার) থেকে আবারও শুরু হয়েছে তাদের টানা তিন দিনের লাগাতার সড়ক অবরোধ কর্মসূচি। প্রতিদিন সকাল ৬টা থেকে এ অবরোধ সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত চলার কথা রয়েছে। মহাসড়কের পাশাপাশি ভাঙ্গায় রেললাইনও অবরোধ করে রেখেছেন আন্দোলনকারীরা। যার ফলে সারা দেশের সাথে পদ্মা সেতু হয়ে রাজধানী ঢাকায় যাওয়ার রেল যোগাযোগও বন্ধ হয়ে গেছে।
এতে ভাঙ্গা হয়ে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার সঙ্গে ঢাকার যোগাযোগ সম্পূর্ণ রুপে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। ভাঙ্গা-ঢাকা এক্সপ্রেস ওয়ে-সহ ভাঙ্গা চৌরাস্তা ঘিরে থাকা চারটি মহাসড়কে আটকা পড়ে আছে শতশত যানবাহন। এসব রুটে চলাচলের করা হাজার হাজার যাত্রীদের ভোগান্তি বেড়েছে। কমেছে পদ্মা সেতুর ও এক্সপ্রেস ওয়ের প্রগিদিনের টোল আদায়ের পরিমানও।
আজ রবিবার সকাল ৬টা থেকে মহাসড়কগুলো দখলে রাখার কথা থাকলেও বিপুল পরিমাণ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অবস্থান ও টহলের কারণে ওই সময়ের মধ্যে সব সড়ক পুরোপুরি দখলে নেওয়া সম্ভব হয়নি। তবে বেশিক্ষণ অপেক্ষাও করতে হয়নি তাঁদের। ভাঙ্গা চৌরাস্তার চারপাশের মহাসড়কগুলো পুরোপুরি অবরোধ আওয়ায় আনতে বাড়তি ৪০ থেকে ৫০ মিনিট সময় লেগেছে ভাঙ্গা উপজেলাবাসীর। আন্দোলনেে আলগী ও হামিরদি ইউনিয়নের জনসাধারণ ছাড়া অখণ্ড ভাঙ্গার মাটি রক্ষার এ আন্দোলনে উপজেলার ১২টি ইউনিয়ন ও ভাঙ্গা পৌরসভার সকল শ্রেনী-পেশার জনগণ অংশগ্রহণ করেছে। ভাঙ্গার উপজেলার বিভিন্ন স্থান ঘুরে দেখা গেছে দল-মত নির্বিশেষে ওই এলাকার প্রায় ৫ লক্ষাধিক গণমানুষের প্রধান দাবি এখন একটাই- ইসি'র প্রজ্ঞাপন বাতিন করে আলগী ও হামিরদি কে আবারও ভাঙ্গার কাছে ফেরত দেওয়া হোক, অখণ্ড ভাঙ্গা অক্ষুন্ন থাকুক।
সরেজমিনে ভাঙ্গা উপজেলার চলমান অবরোধ পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায়, সকালে, অতিরিক্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের অবস্থানের কারণে কয়েকটি পয়েন্টের জায়গা কিঞ্চিত পরিবর্তন করে প্রথমে সড়কগুলোতে নিজেদের অবস্থান নিশ্চিত করেন আন্দোলনকারীরা। একটু পরে জনসমাগম বাড়তে থাকলে মহাসড়কগুলো আটকিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের টানা তিন দিন অবরোধের প্রথম দিনের কর্মসূচি শুরু করেন ভাঙ্গার সাধারণ জনগণ।
এদিকে, সকালে ভাঙ্গা বাজার বাসস্ট্যান্ডে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপস্থিতি বেশি থাকায় আন্দোলনকারীরা বরিশাল মহাসড়ক দখল করেন হাসপাতাল গেট খ্যাত ভাঙ্গা থানা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মূল ফটকের সামনে থেকে। এসময় তারা ভাঙ্গা-বরিশাল মহাসড়ক বন্ধ করে দিয়ে সেখানে অবস্থান নেন।
প্রায় একই সময়ে সুয়াদীতে মহাসড়কে অবস্থান নিয়ে চলে ভাঙ্গা উপজেলা বাসীর শান্তিপূর্ণ লাগাতার অবরোধ কর্মসূচি। সে সময় পুলিয়া বাসস্ট্যান্ডেও মহাসড়ক বন্ধ করে দিয়ে অবরোধ করে ভাঙ্গার জনসাধারণ।
সকাল থেকেই হামিরদীতে রেল লাইন অবরোধ করেক বেশকিছু নারী ঝাড়ু হাতে অবস্থান নেন। পরে ট্রেন আসার শব্দ শুনে রেল লাইনের মাঝখানে উঠে আসেন কিছু নারী। চলন্ত ট্রেনের সামনে আবু সাঈদ স্টাইলে দুই হাত প্রশাসিত করে একজন নারী দাঁড়িয়ে যান। তাঁর পিছনেই আরও কিছু নারী ও শিশু-কিশোর রেললাইনে অবস্থান নেন। চলন্ত ট্রেনটি তাঁদের কাছাকাছি এসে থেমে যাওয়ার পরপরই রেলপথেরও অবরোধ নিশ্চিত হয় ভাঙ্গা উপজেলাবাসীর। এরই মধ্যে পুখুরিয়া রাসস্ট্যান্ডের অবস্থান নিশ্চিত করে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ ও মুহুর মুহুর স্লোগান-বক্তৃতার মধ্যদিয়ে অবরোধ কর্মসূচি পালন করতে থাকেন হামিরদি ইউনিয়ন সহ স্থানীয় জনতা।
সকাল ৬টা থেকেই মুনসুরাবাদ বাসস্ট্যান্ডে অবস্থান নিশ্চিত করে আলগী ইউনিয়ন সহ ভাঙ্গা উপজেলার স্থানীয় জনগণ। এসময় গাছ ফেলে মহাসড়ক আটকিয়ে তার একটু পিছনেই সড়কের ওপর তাবু টাঙিয়ে অবস্থান নেন তারা। এই স্পষ্টে অবরোধে অংশগ্রহণ করা অনেককেই কাফনের কাপড় নিয়ে আন্দোলন করতে দেখা যায়।
এদিকে, শনিবার রাতে আলগী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ম. ম. সিদ্দিক মিয়া'র গ্রেপ্তারের খবরে আলগী ইউনিয়ন সহ ফুঁসে উঠেছে ভাঙ্গা উপজেলার আন্দোলন জনসাধারণ।
এরই ধারাবাহিকতায় আজ (রবিবার) অবরোধ চলাকালীন ভাঙ্গাবাসী বিভিন্ন স্পষ্টে তাদের দাবির সংখ্যা বৃদ্ধি করে বক্তব্য দিতে দেখা গেছে।
অখণ্ড ভাঙ্গা উপজেলা অক্ষুন্ন রাখার দাবি নিয়ে নিয়ে শুরু হওয়া এ আন্দোলনটি গত বৃহস্পতিবার আরেকটি দাবি যোগ করেন স্থানীয় জনতা। আর তা হলো- ফরিদপুরের আসন সংখ্যা বৃদ্ধি করে পুনরায় ভাঙ্গা উপজেলাকে আলাদা সংসদীয় আসন ঘোষণার দাবি। কিন্তু রবিবার থেকে ভাঙ্গা উপজেলাবাসী আরও দু'টি দাবি বৃদ্ধি করেছেন। আর তা হলো- সদ্য গ্রেপ্তারকৃত আলগী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ম. ম. সিদ্দিক মিয়া ওরফে সিদ্দিক চেয়ারম্যানের নিঃশর্ত মুক্তি এবং ভাঙ্গা উপজেলা থেকে আলগী ও হামিরদি ইউনিয়নে কেটে নিয়ে ফরিদপুর -২ নেওয়ার পিছনের ষড়যন্ত্রকারী বা মীরজাফরদের নাম প্রকাশ করতে হবে।
উল্লেখ করা যেতে পারে, সম্প্রতি আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য ৩০০ সংসদীয় আসনের পুনর্নির্ধারিত সীমানার তালিকা প্রকাশ করে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এতে ফরিদপুর-৪ আসনের অন্তর্ভুক্ত ভাঙ্গা উপজেলার আলগী ও হামিরদি ইউনিয়নকে কেটে নগরকান্দা ও সালথা উপজেলা নির্বাহী গঠিত ফরিদপুর-২ আসনের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তবে ইসির এ সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে ওই তালিকা প্রকাশের পর থেকেই ক্ষোভ প্রকাশ ও অবরোধ শুরু করে স্থানীয়রা। এরপর থেকে দফায় দফায় এই সড়ক অবরোধ কর্মসূচি পালন করছে ভাঙ্গা উপজেলাবাসী। সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণ এ আন্দোলনে এখনও কোনো সহিংসতার ঘটনা ঘটেনি। তবে এ আন্দোলনের অন্যতম নেতা আলগী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ম. ম. সিদ্দিক মিয়াকে গ্রেপ্তারে ক্ষোভ বেড়েছে আন্দোলনকারীদের মধ্যে।
এ বিষয়ে ভাঙ্গা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. মিজানুর রহমান উত্তরাধিকার ৭১ নিউজকে জানান, 'জন সাধারণের নিরাপত্তা ও দুর্ভোগ কমাতে চেষ্টা কাজ করে যাচ্ছি। আন্দোলনকারীদের সাথে এবং জেলা প্রশাসনের সাথে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রেখে এ আন্দোলনের শান্তিপূর্ণ সমাধানের চেষ্টা চলছে। এছাড়া, আন্দোলনকে কেন্দ্র করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায়- সেনাবাহিনী, র্যাব ও পুলিশ সদস্য সহ অতিরিক্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের মোতায়েন করা হয়েছে বলেও জানান ইউএনও।
এ বিষয়ে ভাঙ্গা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আশরাফ হোসেন 'দৈনিক বাংলা ৭১'কে জানান, 'ভাঙ্গায় জনগণের জননিরাপত্তার বিষয়টি মাথার রেখে কাজ করে যাচ্ছি। অবরোধ বা আন্দোলনের নামে কোনো ধরণের অপ্রীতিকর ঘটনা যাতে কেউ ঘটাতে না পারে, সে বিষয়েও সতর্ক রয়েছে ভাঙ্গা থানা পুলিশ বলেও জানান তিনি।'
ভাঙ্গা হাইওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. রোকিবুজ্জামান চলমান অবরোধ বিষয়ে উত্তরাধিকার ৭১ নিউজকে জানান, 'ভাঙ্গার চৌরাস্তার চার দিকের সকল রাস্তায় অবরুদ্ধ করে রেখেছেন আন্দোলনকারীরা। আগে থেকে এখন আন্দোলনকারী ও আন্দোলন স্পটও সংখ্যায় বেশি। নারী- শিশু, ছাত্র-জনতা সহ এবার সকল শ্রেনি পেশার জনগণ রাস্তায় নেমেছেন মনে হচ্ছে। আমরা আমাদের দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছি।'
এই রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত রোদ-বৃষ্টি উপেক্ষা করেই মহাসড়ক অবরোধ কর্মসূচি করে যাচ্ছিলেন ভাঙ্গা উপজেলাবাসী। এখন পর্যন্ত কোনো অপ্রীতিকর ঘটনার খবর পাওয়া যায়নি। দুপুরের পরে ভাঙ্গার কয়েকটি স্কুল ও মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষকদেরও নতুন করে অবরোধে যোগ দিতে দেখা গেছে। দাবি না মানা পর্যন্ত এই আন্দোলন চলবে বলে আন্দোলনকারীদের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।
(আরআর/এসপি/সেপ্টেম্বর ১৪, ২০২৫)