রিয়াজুল রিয়াজ, বিশেষ প্রতিনিধি : মামলা, গ্রেপ্তার ও বিপুল পরিমাণ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের মোতায়েন করেও আটকানো যায়নি ভাঙ্গা উপজেলার জনসাধারণকে।

আজ সোমবার সকাল থেকেই ভাঙ্গায় সেনাবাহিনী, র‌্যাব, বিজিবি ও পুলিশ সহ হাজার হাজার অতিরিক্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের উপস্থিতি ছিলো ভাঙ্গায়। সোমবার সকালে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পাহাড় ঠেলে আন্দোলনকারীরা তাঁদের নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে মহাসড়ক দখল করে অবরোধ কর্মসূচি পালন করতে না পারলেও, সকাল ৬টা থেকে রাস্তার পাশে শান্তিপূর্ণ অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করতে থাকে। এসবের মধ্যে দিয়ে বাস চলাচল স্বাভাবিক রাখতে রাস্তায় অবস্থানের পাশাপাশি যৌথ বাহিনীর টহল অব্যাহত রাখেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। কিন্তু চার-পাঁচ ঘন্টার বেশি আটকানো যায়নি ভাঙ্গা উপজেলার জনসাধারণকে।

সোমবার (১৫ সেপ্টেম্বর) সকাল ১০টা থেকে ১১ টার মধ্যে ভাঙ্গা চৌরাস্তার সব মহাসড়ক দখলে নিয়ে অবস্থান নেয় স্থানীয় সকল শ্রেনী-পেশার জনগণ।

এতে আবারও ভাঙ্গা হয়ে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার সঙ্গে ঢাকার যোগাযোগ সম্পূর্ণ রুপে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। ভাঙ্গা-ঢাকা এক্সপ্রেসওয়ে-সহ ভাঙ্গা চৌরাস্তা ঘিরে থাকা চারটি মহাসড়কে আটকা পড়ে আছে শতশত যানবাহন। সোমবার সকাল থেকে মহাসড়ক আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দখলে আছে ও যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক আছে এমন খবর ছড়িয়ে পড়লে এই রুটে চলাচল করা প্রায় সকল কম্পানীর যাত্রীবাহী বাস ও অন্যান্য পরিবহনগুলো চলাচল শুরু করে। কিন্তু হঠাৎ ভাঙ্গাবাসীর সড়ক অবরোধের মুখে আটকে পড়ায় শতশত যানবাহন সহ হাজার হাজার যাত্রীরও আটকা পড়ে ভোগান্তির শিকার হয়েছে।

আন্দোলনেে আলগী ও হামিরদি ইউনিয়নের জনসাধারণ ছাড়া অখণ্ড ভাঙ্গার মাটি রক্ষার উপজেলার ১২টি ইউনিয়ন ও ভাঙ্গা পৌরসভার সকল শ্রেনী-পেশার জনগণ অংশগ্রহণ করেছে। ভাঙ্গা উপজেলার বিভিন্ন স্থান ঘুরে দেখা গেছে দল-মত নির্বিশেষে ওই এলাকার গণমানুষের প্রধান দাবি এখন একটাই- ইসি'র প্রজ্ঞাপন বাতিল করে আলগী ও হামিরদি কে আবারও ভাঙ্গা কাছে ফেরত দেওয়া হোক, অখণ্ড ভাঙ্গা অক্ষুন্ন থাকুক।

এদিকে, সকাল থেকে ভাঙ্গা বাজার বাসস্ট্যান্ডে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপস্থিতি বেশি থাকায় আলগী ইউনিয়ন ও ভাঙ্গা পৌরসভার জনগণ ফরিদপুর-বরিশাল মহাসড়ক দখল করেন হাসপাতাল গেট খ্যাত ভাঙ্গা থানা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মূল ফটকের সামনে থেকে সকাল ১০টার দিকে। তাঁরা মহাসড়ক বন্ধ করে দিয়ে সেখানে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করতে থাকলে হয়তো একটু দূরে অবস্থান নেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা।

প্রায় একই সময়ে সুয়াদীতে মহাসড়কে অবস্থান নিয়ে চলে ভাঙ্গা উপজেলা বাসীর শান্তিপূর্ণ লাগাতার অবরোধ কর্মসূচি। সে সময় পুলিয়া বাসস্ট্যান্ডেও মহাসড়ক বন্ধ করে দিয়ে অবরোধ করে ভাঙ্গার জনসাধারণ।

এরই মধ্যে পুখুরিয়া রাসস্ট্যান্ডের অবস্থান নিশ্চিত করে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ ও মুহুর মুহুর স্লোগান-বক্তৃতার মধ্যদিয়ে অবরোধ কর্মসূচি পালন করতে থাকেন হামিরদি ইউনিয়ন সহ স্থানীয় জনতা।

সকাল সাড়ে দশটার দিকে মুনসুরাবাদ বাসস্ট্যান্ডে অবস্থান নিশ্চিত করে আলগী ইউনিয়ন সহ ভাঙ্গা উপজেলার স্থানীয় জনগণ। এসময় গাছ ফেলে মহাসড়ক আটকিয়ে তার একটু পিছনেই সড়কের ওপর তাবু টাঙিয়ে অবস্থান নেন তারা। এই স্পষ্টে অবরোধে অংশগ্রহণ করা অনেককেই কাফনের কাপড় নিয়ে আন্দোলন করতে দেখা যায়।

এদিকে, শনিবার রাতে আলগী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ম. ম. সিদ্দিক মিয়া'র গ্রেপ্তারের খবরে আলগী ইউনিয়ন সহ ফুঁসে উঠেছে ভাঙ্গা উপজেলার আন্দোলন জনসাধারণ। পরে আন্দোলন থামাতে একটি মামলাও করে সেই মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়েছে চেয়ারম্যান সিদ্দিক মিয়াকে।

রবিবার ও সোমবার অবরোধ চলাকালীন ভাঙ্গাবাসী বিভিন্ন স্পষ্টে তাঁদের পূর্বের দাবি থেকে বর্তমানে তাদের দাবির সংখ্যা বৃদ্ধি করে বক্তব্য দিতে দেখা গেছে।

অখণ্ড ভাঙ্গা উপজেলা অক্ষুন্ন রাখার একমাত্র দাবি নিয়ে নিয়ে শুরু হওয়া এ আন্দোলনটি গত বৃহস্পতিবার আরেকটি দাবি যোগ করেন স্থানীয় জনতা, তা ছিলো- ফরিদপুরের সংসদীয় আসন সংখ্যা বৃদ্ধি করে পুনরায় ভাঙ্গা উপজেলাকে আলাদা সংসদীয় আসন (ফরিদপুর-৫) ঘোষণার দাবি। কিন্তু এই দু'দিন ভাঙ্গা উপজেলাবাসীকে আরও তিনটি দাবি বৃদ্ধি করে বক্তব্য দিতে দেখা গেছে। আর তা হলো- সদ্য গ্রেপ্তারকৃত আলগী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ম. ম. সিদ্দিক মিয়া ওরফে সিদ্দিক চেয়ারম্যানের নিঃশর্ত মুক্তি, মামলা প্রত্যাহার ও পুলিশি হয়রানি বন্ধ করতে হবে এবং ভাঙ্গা উপজেলা থেকে আলগী ও হামিরদি ইউনিয়নে কেটে নিয়ে ফরিদপুর -২ নেওয়ার পিছনের ষড়যন্ত্রকারী বা মীরজাফরদের নাম প্রকাশ করতে হবে।

এর আগে, গত শুক্র-শনি দু'দিন বিরতির পর রবিবার থেকে আবারও শুরু হয়েছে তাদের টানা তিন দিনের লাগাতার সড়ক অবরোধ কর্মসূচি। প্রতিদিন সকাল ৬টা থেকে এ অবরোধ সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত চলার কথা থাকলেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বাধার মুখে তারা সময় মতো সড়ক অবরোধ করতে পারেনি। তবে, একটু দেরি হলেও ভাঙ্গাবাসী তাঁদের আন্দোলন সফল করে যাচ্ছেন।

উল্লেখ করা যেতে পারে, সম্প্রতি আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য ৩০০ সংসদীয় আসনের পুনর্নির্ধারিত সীমানার তালিকা প্রকাশ করে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এতে ফরিদপুর-৪ আসনের অন্তর্ভুক্ত ভাঙ্গা উপজেলার আলগী ও হামিরদি ইউনিয়নকে কেটে নগরকান্দা ও সালথা উপজেলা নির্বাহী গঠিত ফরিদপুর-২ আসনের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তবে ইসির এ সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে ওই তালিকা প্রকাশের পর থেকেই ক্ষোভ প্রকাশ ও অবরোধ শুরু করে স্থানীয়রা। এরপর থেকে দফায় দফায় এই সড়ক অবরোধ কর্মসূচি পালন করছে ভাঙ্গা উপজেলাবাসী। সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণ এ আন্দোলনে এখনও কোনো সহিংসতার ঘটনা ঘটেনি। তবে এ আন্দোলনের অন্যতম নেতা আলগী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ম. ম. সিদ্দিক মিয়াকে গ্রেপ্তারে ক্ষোভ বেড়েছে আন্দোলনকারীদের মধ্যে।

এ বিষয়ে ভাঙ্গা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. মিজানুর রহমান উত্তরাধিকার ৭১ নিউজকে জানান, 'জন সাধারণের নিরাপত্তা ও দুর্ভোগ কমাতে চেষ্টা কাজ করে যাচ্ছি। আন্দোলনকারীদের সাথে এবং জেলা প্রশাসনের সাথে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রেখে এ আন্দোলনের শান্তিপূর্ণ সমাধানের চেষ্টা চলছে। এছাড়া, আন্দোলনকে কেন্দ্র করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায়- সেনাবাহিনী, র‌্যাব ও পুলিশ সদস্য সহ অতিরিক্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের মোতায়েন করা হয়েছে বলেও জানান ইউএনও।

এ বিষয়ে ভাঙ্গা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আশরাফ হোসেন উত্তরাধিকার ৭১ নিউজকে জানান, 'ভাঙ্গায় জনগণের জননিরাপত্তার বিষয়টি মাথার রেখে কাজ করে যাচ্ছি। অবরোধ বা আন্দোলনের নামে কোনো ধরণের অপ্রীতিকর ঘটনা যাতে কেউ ঘটাতে না পারে, সে বিষয়েও সতর্ক রয়েছে ভাঙ্গা থানা পুলিশ।'

ভাঙ্গা হাইওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. রোকিবুজ্জামান চলমান অবরোধ বিষয়ে উত্তরাধিকার ৭১ নিউজকে জানান, 'ভাঙ্গার চৌরাস্তার চার দিকের সকল রাস্তায় অবরুদ্ধ করে রেখেছেন আন্দোলনকারীরা। আগে থেকে এখন আন্দোলনকারীরা সংখ্যায় অনেক বেশি। নারী- শিশু, ছাত্র-জনতা সহ এবার সকল শ্রেনি পেশার জনগণ রাস্তায় নেমেছেন মনে হচ্ছে। আমরা আমাদের দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছি। '

এই রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সকল বাধা উপেক্ষা করেই মহাসড়ক অবরোধ কর্মসূচি করে যাচ্ছিলেন ভাঙ্গা উপজেলাবাসী। এখন পর্যন্ত কোনো অপ্রীতিকর ঘটনার খবর পাওয়া যায়নি। দুপুরের ১ টার পরে ভাঙ্গার কয়েকটি স্কুল ও মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষকদেরও অবরোধে যোগ দিতে দেখা গেছে। দাবি না মানা পর্যন্ত এই আন্দোলন চলবে বলে আন্দোলনকারীদের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।

(আরআর/এসপি/সেপ্টেম্বর ১৫, ২০২৫)