৫ আগস্টের পর কামিয়েছেন শত কোটি টাকা
চোরাচালানি মন্টুর জিরো থেকে হিরো হওয়ার গল্প

রঘুনাথ খাঁ, সাতক্ষীরা : সাতক্ষীরার কুখ্যাত চোরাচালানি হাফিজুর রহমান মণ্টুর জিরো থেকে হীরো হওয়ার কাহিনী বেরিয়ে পড়তে শুরু করেছে। প্রথমে যৌথভাবে গ্যাস সিলি-ার পাচার শুরু করে পরবর্তীতে মাদক, ভারতীয় থ্রিপিচ, শাড়ী, কসমেটিকস গুডস ও অস্ত্র পাচারের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। সর্বপরি গত বছরের ৫ আগষ্ট সরকার পতনের পর আওয়ামী লীগের কয়েকজন সাংসদ, আওয়ামী লীগ নেতা ও কর্মীদের প্রতিবেশী দেশে নিরাপদে পেঁৗঁছে দেওয়ার নামে মাত্র ১৬ দিনেই মন্টু কামিয়েছেন শত কোটি টাকা।
স্থানীয় দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, তার বাবা বিশেষভাবে তাস খেলতেন। বাবু গাজী নামের এক জুয়াড়ি তার বাবার সাথে সুস্পর্ক গড়ে তোলেন। একপর্যায়ে বাবু গাজী তাদের পারিবারিক বন্ধু বনে যান। তাস খেলে হেরে যাওয়ায় দুই বিঘা জমি বিক্রি করে ওই ঋণ শোধ করেন বাবু গাজী। ১৯৮৯ সালে বাড়ি থেকে ডায়াং মটর সাইকেলে করে এক ব্যক্তি ডেকে নিয়ে যাওয়ার পরদিন পুষ্পকাটি বলফিল্ড এলাকায় একটি গাছে মন্টুর বাবার ঝুলন্ত লাশ দেখা যায়। তাকে নির্যাতনের পর শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয় মর্মে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হয়। মন্টুসহ সন্তানরা ছোট হওয়ায় স্বামীর হত্যার ঘটনায় মামলা করেননি নিহতের স্ত্রী মাহফুজা খাতুন।
এক পর্যায়ে মন্টু সাবালক হওয়ার পরপরই গ্যাস সিলি-ার প্রতিবেশী দেশে পাচার শুরু করেন তার এক বন্ধুর সাথে। সহযোগী হিসেবে কাজ করতেন তার ভাই রবিউল ইসলাম। ওই বন্ধুর সাথে সম্পর্কের অবনতি হওয়ায় তিনি নিজেই ব্যবসা শুরু করেন। ব্যবসায়িক অংশীদার হিসেবে এক সময় যুবদল নেতার সঙ্গে যুক্ত হন। তার সঙ্গে সম্পর্ক নষ্ট হওয়ায় লোক দিয়েই ব্যবসা করতেন মন্টু। এক সময় চোরাচালাানি ব্যবসায় মার খেয়ে ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েন মন্টু। তবে খুলনার কুখ্যাত চোরাকারবারি সামছুর এর সঙ্গে পরিচয়ের জের ধরে মন্টু কিছুদূর এগিয়ে যান। একইভাবে সামছুর খুলনা ছেড়ে ঢাকায় চলে যাওয়ার তার ব্যবসা বাড়াতে থাকেন মন্টু। মন্টুর টাকা উপার্জন বেড়ে যাওয়ায়, হাড়দ্দহ গুচ্ছ গ্রামের এক নারী যিনি সাংসদ রবি এর বাড়ির গৃহ পরিচারিকাকে দিয়ে বিপদভঞ্জন মধুসুধন হিসেবে কাজে লাগিয়ে তাকে কোটি টাকার কাবিনে বিয়ে করে শহরতলীর চালতেতলায় জমি কিনে সেখানে দোতলা বাড়ি করে দেন। প্রতিবেশী দেশের বসিরহাটের কোদালিয়ার (রেণ স্টেশনের নিকটবর্তী) আব্দুল লতিফের মেয়ে পুতুলকে বিয়ে করে সেখানে তাকে বাড়ি বানিয়ে দেন।
এ ছাড়া নিজের গ্রামে এক স্ত্রী ও খুলনার ফুলতলায় আরো এক স্ত্রী রয়েছে। এ পর্যন্ত সাতক্ষীরা শহরতলীর তালতলা ঈদগাহ মোড়ে সাত মাস আগে সাড়ে ৬ কোটি টাকা ব্যয়ে বাড়ি কাম সোনার বাংলা চাইনিজ এ- কমিউনিটি সেন্টার, বিনেরপোতায় মাছের সেট (পরিচালনায় ছেলে বাপ্পি), সুলতানপুর বড়বাজারে হীরা-মুক্তা নামে ফজর আলীর সাথে যৌথ মালিকানাধীন মাছের সেটসহ কমপক্ষে স্বনামে -বেনামে ৮৭ বিঘা জমির মালিক বনে গেছেন হাফিজুর রহমান মণ্টু। তবে ২০২০ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি পটুয়াখালি জেলার মহিপুরে ১৩ কোটি ৬০ লাখ টাকা মূল্যের ট্রলার ও চোরাচালানি পণ্যসহ ১৩ জন আটক হওয়ায় মন্টুর আর্থিক সহায়তাকারি ঢাকার সালাম ও বরিশালের বাচ্চু পিছিয়ে আসেন। বড় ভাই চোরাচালানি পণ্যের হিসসা কম দেওয়ায় ২০২১ সালে তার ভাই আব্দুস সবুর গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করেন বলে এলাকায় প্রচার রয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হাফিজুর রহমান মণ্টুর এক আত্মীয় জানান, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে মন্টু স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা ও জেলা আওয়ামী লীগের নেতা শহীদুল ইসলামকে কাজে লাগিয়ে বৈতরণী পার হয়েছেন। সম্প্রতি জেলা বিএনপি’র এক শীর্ষ পর্যায়ের নেতার কাছে ধর্না দিয়ে ভাই রবিউল ইসলামকে হাড়দ্দহ ওয়ার্ড বিএনপির সভাপতি বনে গেছেন। ভোটে জিততে মন্টু কাউন্সিলরদের ম্যানেজ করতে ১৫ লক্ষাধিক টাকা খরচ করেছেন বলে প্রচার রয়েছেন।
স্থানীয় একটি দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, গত বছরের জুন ও জুলাই মাসে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে প্রশাসনের দৃষ্টিভঙ্গি অন্যদিকে থাকায় টেকনাফ এলাকার এক মাদক পাচারকারির সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলে ভারতীয় কাপড়, ত্রি-পিচ, কসমেটিকস গুডস, ইমিটেশান গহনাসহ বিভিন্ন সামগ্রী মায়ানমারে পাঠাতে শুরু করেন। কোলকাতার খিদিরপুর ডক থেকে ট্রলার ভর্তি এসব মালামাল সরাসরি সুন্দরবনের ভিতর সাগরে রেখে নিজের ট্রলারে ভর্তি করে কয়রা হয়ে কলাপাড়া দিয়ে টেকনাফে নিয়ে যেতেন মন্টু। প্রথমে একটি ট্রলার দিয়ে শুরু করলেও বর্তমানে তার চারটি ট্রলার নিয়মিত পণ্য চোরাচালানিতে ব্যবহার হয়। এতে তার অর্থনৈতিক অবস্থার পরিবর্তণ ঘটতে শুরু করে। তার ভাই রবিউল ইসলাম নিজেকে “সেন্টার ফর দা এনফোর্সমেন্ট অব হিউম্যান রাইটস এ- লিগ্যাল এইড পিপল, রিপাবলিক অফ বাংলাদেশ (সরকারি লাইসেন্স নং-১৯৩৪/২) এর সাতক্ষীরা সদর উপজেলার সহ-সভাপতি হিসেবে কর্ডি সংগ্রহ করে নিজেকে বিপদের বাইরে রাখার চেষ্টা করে আসছেন।
সূত্রটি আরো জানায়, গত বছরের ৫ আগষ্ট শেখ হাসিনার দেশত্যাগের পর আওয়ামী লীগের সাংসদ, জেলা পারিষদের চেয়ারম্যান, উপজেলা চেয়ারম্যান, ইউপি চেয়ারম্যানসহ বিশাল সংখ্যক আওয়ামী লীগ নেতা- কর্মী মব ভায়োলেন্স থেকে বাঁচতে দেশ ছাড়ার উদ্যোগ নেন। ৫ আগষ্ট সন্ধ্যার পর থেকে বরিশালের বাচ্চুর সহযোগিতায় খুলনা, বাগেরহাট, পিরোজপুর, পটুয়াখালি জেলার কমপক্ষে চারজন সাংসদ, শতাধিক জনপ্রতিনিধি এবং কয়েক’শ আওয়ামী লীগ নেতাকে সুন্দরবনের ভিতর দিয়ে প্রতিবেশী দেশ ভারতে পৌঁছে দেওয়ার ব্যাপারে হেভিওয়েট নেতা হিসেবে মাথা পিছু এক কোটি থেকে পাঁচ কোটি টাকা নিয়েছেন মন্টু।
এ কাজে মূখ্য সমন্বয়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন মানবাাধিকার কর্মী পরিচয়দানকারি ভাই রবিউল ইসলাম। লোকজন পাচারে সহযোগী হিসেবে অন্যতম ভূমিকা পালন করেন ভারতের সোলাদানার বাসিন্দা বর্তমানে দক্ষিণ হাড়দ্দহ গ্রামে অবস্থানকারি সাগর হোসেন। ৫ আগষ্ট থেকে ২১ আগষ্টের মধ্যে মানব পাচার করে মন্টু শত কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন। ওই টাকার একাংশ দিয়ে তিনি সাত মাস আগে লোক চক্ষুর আড়ালে প্রশাসনকে ম্যানেজ ও বিনোদনের জন্য তালতলা ঈদগাহ মোড়ে সোনার বাংলা চাইনিজ এ- কমিউনিটি সেন্টার বানিয়েছেন। চোরাচালান চলা অবস্থায় গত ১০ সেপ্টেম্বর টেকনাফ ও মায়ানমার এর মধ্যবর্তীস্থানে মন্টুর চোরাচালানীপণ্য ভর্তি ট্রলারসহ ১৩ জন শ্রমিক কোস্টগার্ডের টার্গেটে পড়ে। এতে শাখরা গ্রামের ইমরান সাগরে পড়ে নিখোঁজ হয়।
এ ব্যাপারে হাফিজুর রহমান মন্টুর সঙ্গে সোমবার বিকেল ৬টা ২৬ ও ৬টা ২৯ মিনিটে তার ০১৭১১-১৮৯২১৬ নং মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করলে তিনি রিসিভ করেননি। তবে রবিবার তিনি ইমরান নিখোঁজসহ বিভিন্ন বিষয়ে কোন মন্তব্য করতে অস্বীকার করেন।
এ ব্যাপারে রবিউল ইসলামের সঙ্গে তার ০১৭৫৮-৩৪৬৭৯২ নম্বর মোবাইলে সোমবার বিকেল ৬টা ৩১ মিনিটে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলে তা বন্ধ পাওয়া যায়।
(আরকে/এসপি/সেপ্টেম্বর ১৫, ২০২৫)