কেয়া হত্যা মামলা: হুমকির মুখে বাবার পরিবার
নিরাপত্তাহীনতায় ভিটেমাটি ছেড়ে চুয়াডাঙ্গায় আশ্রয়

স্ট্যাফ রিপোর্টার : ঝিনাইদহ জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার ইউনিয়নের ত্রিলোচনপুর গ্রামের এক দরিদ্র ভ্যান চালক মোঃ সামাউল ইসলামের সংসারে জন্ম নেয় কেয়া খাতুন। দুই কন্যা ও এক পুত্রের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার বড়, বাবা-মায়ের স্বপ্ন আর স্নেহের কেন্দ্রবিন্দু।
২০১৯ সালের ২৯ অক্টোবর পারিবারিকভাবে তার বিয়ে সম্পন্ন হয় কালীগঞ্জ পৌরসভার নরেন্দ্রপুর গ্রামের মরহুম মনসুর মালিতার পুত্র মোঃ সাবজাল হোসেনের সাথে। কিন্তু আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে দরিদ্র পিতা সামাউল ইসলাম তখনই তার কন্যাকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বামীর ঘরে তুলে দিতে সক্ষম হননি। উভয় পরিবারের আলোচনার মাধ্যমে পরবর্তীতে ২০২০ সালের ১ মার্চ সামাজিকভাবে কন্যা সম্প্রদানের দিনক্ষণ নির্ধারিত হয়। এই সময়টুকু পেয়ে স্বস্তি অনুভব করেছিলেন সামাউল ইসলাম, কারণ তিনি তার স্নেহধন্য কন্যাকে যথাযথ মর্যাদায় বিদায় দিতে চেয়েছিলেন।
কিন্তু নির্মম ভাগ্যের পরিহাসে সেই স্বপ্ন আর পূর্ণ হলো না। নির্ধারিত অনুষ্ঠানের মাত্র ৪ দিন আগে, ২০২০ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি, হঠাৎ করেই নিজ বাড়ি থেকে নিখোঁজ হয়ে যান কেয়া খাতুন। পরিবার ও আত্মীয়স্বজন অনেক খোঁজাখুঁজি করেও তাকে আর খুঁজে পায়নি। যে দিনে তার পিতার ঘরে আনন্দ-উৎসবমুখর পরিবেশ থাকার কথা ছিল, সেই ১ মার্চ দিনেই সামাউল ইসলামকে যেতে হয় কালীগঞ্জ থানায় তার প্রিয় কন্যাকে খুঁজে না পাওয়ার বেদনা নিয়ে সাধারণ ডায়েরি করতে।
শোকের সেই ছায়া আরও ঘনীভূত হয় ২০২০ সালের ১৩ মার্চ সকালে। ঐদিন সকাল ৮টার দিকে একই গ্রামের মরহুম খালেকের ছেলে মোঃ ওমর ফোন করে জানান, ধলা দাদপুর মাঠের ভেতরে চুল, একটি চুলের ক্লিপ ও একটি জুতা পাওয়া গেছে এবং আশপাশে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। খবর পেয়ে সামাউল ইসলাম ও তার পরিবার ঘটনাস্থলে ছুটে যান। সেখানে স্থানীয় জনগণ ও তৎকালীন ইউপি চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম ছানার উপস্থিতিতে পুলিশ মাটি খুঁড়ে উদ্ধার করে একটি অর্ধগলিত নারীর লাশ।
লাশের পরনে থাকা জামাকাপড়, জুতা ও চুলের ক্লিপ দেখে সামাউল ইসলাম ও তার স্ত্রী নিশ্চিত হন এ লাশ তাদেরই আদরের কন্যা কেয়া খাতুনের। পুলিশ মরদেহ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য ঝিনাইদহ সদর হাসপাতালে প্রেরণ করে।
এই হৃদয়বিদারক ঘটনায় কেয়ার পিতা সামাউল ইসলাম একই দিনে, ১৩ মার্চ ২০২০, কালীগঞ্জ থানায় পেনাল কোডের ধারা-৩০২/২০১/৩৪ অনুযায়ী ধর্ষণের পথ হত্যার অভিযেগে মামলা দায়ের করেন। মামলায় তিনি একই গ্রামের মোঃ সলেমানের পুত্র মোঃ মিলন হোসেনকে ১ নং আসামি, আশাদুল ইসলামের পুত্র ইসরাফিল হোসেনকে ২ নং আসামি এবং আজগর আলীর পুত্র মোঃ আজিম হোসেনকে ৩ নং আসামি হিসেবে চিহ্নিত করেন, সাথে আরও কয়েকজন অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিকে এই হত্যার সঙ্গে জড়িত বলে উল্লেখ করেন।
মামলার এজাহারে তিনি স্পষ্ট অভিযোগ করেন, আজিম হোসেন তার কন্যাকে দীর্ঘদিন ধরে প্রেমের প্রস্তাব দিয়ে হয়রানি করত এবং এতে সহযোগিতা করত মিলন হোসেন ও ইসরাফিল হোসেন। অবশেষে তার সেই স্নেহধন্য কন্যা নির্মমভাবে হত্যার শিকার হন। অভিযোগে বলা হয়েছে, প্রেমে ব্যর্থ হয়ে আজিম হোসেন ও অভিযুক্ত তার দুই বন্ধু প্রথমে তাকে ধর্ষণ করে হত্যা করেন এবং পরে লাশ মাটিচাপা দিয়ে গোপন করেন।
মামলা দায়েরের পর আসামিরা আত্মগোপনে গেলেও পরবর্তীতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের গ্রেফতার করে আদালতে প্রেরণ করে।মামলার দ্বিতীয় শুনানিতে আসামিপক্ষ জামিনে মুক্তি পান।
কিন্তু বর্তমানে মামলার “নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল, ঝিনাইদহ” আদালতে বিচার প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। ইতিমধ্যে পাবলিক সাক্ষী সম্পূর্ণ হয়েছে, সরকারি সাক্ষী হলে মামলার দ্রুত রায় হবে হবে বলে আশা করছেন কেয়ার পরিবার।
তবে গত ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ভোরে জামিনে থাকা আসামি মিলন, ইসরাফিল ও আজিম সানাউল ইসলামের বাড়ির সামনে এসে মামলা প্রত্যাহারের জন্য চাপ সৃষ্টি করেন। অভিযোগ রয়েছে, আসামিপক্ষ দেশীয় ধারালো অস্ত্র প্রদর্শন করে সামাউল ও তার পরিবারকে হত্যা করার উদ্দেশ্যে সামাউলের বাড়ি আক্রমণ করে। সামাউল অনুপায় হয়ে ৯৯৯ এর সাহায্য নিলে কালীগঞ্জ থানা পুলিশ তাকে উদ্ধার করে। নিজের ও তার পরিবারের জীবন বাঁচাতে তিনি বাপ-দাদার ভিটা ছেড়ে চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদা থানার কুলগাছি গ্রামে আশ্রয় নেয়।
এ ঘটনায় ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫ তারিখে সানাউল ইসলাম কালীগঞ্জ থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছেন, জিডি নং ৭৪৬। তার দাবি, পুলিশ ও প্রশাসনের সহযোগিতায় আসামিদের দ্রুত গ্রেফতার করা হলে তিনি ও তার পরিবার নিরাপদে নিজ বাড়িতে ফিরতে পারবেন। তিনি আরও জানান, কেয়া হত্যা মামলার পরবর্তী শুনানি আগামী ৬ জানুয়ারি ২০২৬ নির্ধারিত হয়েছে। তিনি কোন অবস্থাতেই মামলা প্রত্যাহার করবেন না এবং আদালতের রায়ের প্রতি আস্থা রাখবেন।
(এসএস/এসপি/সেপ্টেম্বর ১৫, ২০২৫)