ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ


আজ মঙ্গলবার ১৬ সেপ্টেম্বর এই তারিখটি মানবসভ্যতার ইতিহাসে এক অনন্য মাইলফলক। কারণ এ দিনটি পালিত হয় আন্তর্জাতিক ওজোন স্তর সুরক্ষা দিবস হিসেবে। ১৯৯৪ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ এ দিবস ঘোষণা করে, যা মূলত ১৯৮৭ সালের ঐতিহাসিক মন্ট্রিয়াল প্রটোকল গৃহীত হওয়ার স্মৃতিকে ধারণ করে। এটি কেবল একটি দিনে সীমাবদ্ধ নয়; বরং এটি মানবজাতিকে সচেতন করে ওজোন স্তরের গুরুত্ব, এর হুমকি এবং আমাদের করণীয় সম্পর্কে।

ওজোন স্তর ও এর বৈজ্ঞানিক গুরুত্ব

ওজোন (O₃) হলো অক্সিজেনের তিন অণুর সমন্বয়ে গঠিত একটি গ্যাস। এটি পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের স্ট্রাটোস্ফিয়ারে, প্রায় ১০–৫০ কিলোমিটার ওপরে একটি প্রতিরক্ষামূলক স্তর তৈরি করে। সূর্যের ক্ষতিকর UV-B ও UV-C রশ্মি শোষণ করে এই স্তর। UV-B রশ্মি ত্বক ক্যান্সার, চোখের ছানি এবং রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস করতে পারে।

যদি ওজোন স্তর না থাকত

প্রতিবছর কোটি কোটি মানুষ ত্বক ক্যান্সারে আক্রান্ত হতো।

চোখে ছানি হয়ে অন্ধত্ব ব্যাপক হারে ছড়িয়ে যেত।

রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা মারাত্মকভাবে দুর্বল হয়ে যেত।

প্রধান খাদ্যশস্য যেমন ধান, গম ও ভুট্টার ফলন ২০–২৫% কমে যেত।

সামুদ্রিক শৈবাল ও প্ল্যাঙ্কটন ধ্বংস হয়ে সমুদ্রের খাদ্যশৃঙ্খল ভেঙে যেত।

একটি গবেষণায় দেখা গেছে, মাত্র ১০% অতিবেগুনি রশ্মি বৃদ্ধিই কৃষিজ উৎপাদন প্রায় ২৫% হ্রাস করতে পারে। FAO-এর তথ্যমতে, ওজোন স্তর ধ্বংস ঠেকানো না গেলে বৈশ্বিক খাদ্য নিরাপত্তা চরম সংকটে পড়ত।

স্বাস্থ্য বিষয়ক প্রভাব

ওজোন স্তর মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ ঢাল হিসেবে কাজ করে। UV-B রশ্মি ত্বকে সরাসরি প্রভাব ফেলে। অতিরিক্ত UV-B ত্বক ক্যান্সারের ঝুঁকি বৃদ্ধি করে। WHO-এর তথ্য অনুযায়ী, ওজোন স্তরের ক্ষয় না হলে ২০৬০ সালের মধ্যে ২০ কোটি নতুন ত্বক ক্যান্সারের রোগী এবং ৪ কোটি চোখের ছানি (cataract) রোগী সৃষ্ট হতো।

UV-B রশ্মি সৃষ্ট ফ্রি র‌্যাডিক্যাল ত্বকের কোষকে আক্রমণ করে। এটি প্রাকৃতিক কোষ পুনর্নির্মাণ প্রক্রিয়ায় ব্যাঘাত ঘটায়, যার ফলে অকাল বার্ধক্য, ত্বকের রঙ পরিবর্তন এবং বিভিন্ন চামড়ার রোগ দেখা দেয়। বিশেষ করে শিশুরা ও বৃদ্ধ ব্যক্তিরা এই প্রভাবে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকে।

চোখের স্বাস্থ্যের জন্যও ওজোন স্তরের গুরুত্ব অপরিসীম। UV-B রশ্মি লেন্স ও কর্নিয়াকে আক্রমণ করে। দীর্ঘমেয়াদি সংস্পর্শে অন্ধত্ব বা চোখের ছানি বৃদ্ধি পেতে পারে। WHO-এর রিপোর্ট অনুযায়ী, ওজোন স্তরের সুরক্ষা এবং CFC ব্যবহার হ্রাসের কারণে প্রতিবছর প্রায় ২ মিলিয়ন মানুষ অন্ধত্ব থেকে বাঁচছে।

রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতার ক্ষেত্রে ওজোন স্তরের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। অতিবেগুনি রশ্মি শরীরের ইমিউন সিস্টেমে প্রভাব ফেলে। এটি T-সেল কার্যক্রম কমিয়ে দেয়, যার ফলে সংক্রমণজনিত রোগ যেমন ইনফ্লুয়েঞ্জা, ভাইরাসজনিত সংক্রমণ এবং ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ বৃদ্ধি পেতে পারে। বিশেষ করে শিশু ও বয়স্কদের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

মনিটরিং ও গবেষণায় দেখা গেছে, CFC-এর ব্যবহার কমানোর মাধ্যমে UV-B রশ্মি ২০% কমানো সম্ভব হয়েছে, যা মানবস্বাস্থ্য রক্ষায় কার্যকর ভূমিকা রেখেছে। FAO-এর হিসাব অনুযায়ী, খাদ্যশস্য উৎপাদন স্থিতিশীল থাকা এবং পুষ্টির হ্রাস প্রতিরোধে ওজোন স্তর রক্ষা বিশেষ ভূমিকা রেখেছে।

ওজোন গর্তের আবিষ্কার ও পরিসংখ্যান

১৯৭৪ সালে বিজ্ঞানী মারিও মোলিনা ও শেরউড রোল্যান্ড প্রথম জানালেন, মানুষ তৈরি রাসায়নিক যেমন CFC বায়ুমণ্ডলে গিয়ে ওজোন ধ্বংস করছে।
১৯৮৫ সালে ব্রিটিশ অ্যান্টার্কটিক সার্ভের বিজ্ঞানীরা দক্ষিণ মেরুর আকাশে বিশাল ওজোন গর্ত শনাক্ত করেন।

পরিসংখ্যান অনুযায়ী

১৯৯০-এর দশকে গর্তের আকার প্রায় ২৫ মিলিয়ন বর্গকিলোমিটার।

২০০৬ সালে রেকর্ডকৃত সবচেয়ে বড় গর্ত ছিল ২৭ মিলিয়ন বর্গকিলোমিটার।

২০২৪ সালে সর্বোচ্চ আকার দাঁড়ায় ২১.৯ মিলিয়ন বর্গকিলোমিটার।

মন্ট্রিয়াল প্রটোকল: মানবজাতির সম্মিলিত জয়

ওজোন রক্ষায় প্রথম বড় পদক্ষেপ ছিল ১৯৮৫ সালের ভিয়েনা কনভেনশন। এর ভিত্তিতে ১৯৮৭ সালে মন্ট্রিয়ালে গৃহীত হয় মন্ট্রিয়াল প্রটোকল। এতে ১৯৭টি দেশ স্বাক্ষর করে।

সাফল্য

ওজোন ধ্বংসকারী পদার্থের ব্যবহার কমেছে ৯৯%।

অনুমান করা হয়, ২০৬০ সাল পর্যন্ত ২০ কোটি ত্বক ক্যান্সার এবং ৪ কোটি চোখের ছানি প্রতিরোধ হবে।

প্রতিবছর ২ মিলিয়ন মানুষ ত্বক ক্যান্সার থেকে বেঁচে যাচ্ছে।

স্বাস্থ্য ব্যয়ে সাশ্রয় হয়েছে প্রায় ১.৮ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার সমপরিমাণ।

বর্তমান পরিস্থিতি ও ভবিষ্যৎ পূর্বাভাস

মধ্য অক্ষাংশে ওজোন স্তর ২০৪০ সালের মধ্যে ১৯৮০-এর দশকের স্তরে ফিরতে পারে।

উত্তর মেরু অঞ্চলে পূর্ণ পুনরুদ্ধার হবে ২০৪৫ সালের মধ্যে।

দক্ষিণ মেরু অঞ্চলে পুরোপুরি সুস্থ হতে সময় লাগবে ২০৬৬ সাল পর্যন্ত।

ODGI অনুযায়ী:

২০০০ সালে সূচক ছিল প্রায় ১০০।

২০২৪ সালে নেমে এসেছে—অ্যান্টার্কটিকায় ৭২, মধ্য অক্ষাংশে ৪৫।

ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জ

১. HFCs: ওজোন ক্ষয় করে না, তবে শক্তিশালী গ্রিনহাউস গ্যাস।

২. প্রাকৃতিক প্রভাব: আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত, অস্বাভাবিক সৌর কার্যকলাপ সাময়িক ক্ষতি বাড়াতে পারে।

৩. অবৈধ ব্যবহার: কিছু দেশে গোপনে ওজোন ধ্বংসকারী পদার্থ ব্যবহার হচ্ছে।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট

বাংলাদেশ ১৯৯০ সালে মন্ট্রিয়াল প্রটোকলে স্বাক্ষর করেছে। এরপর—

জাতীয় ওজোন অফিস গঠন।

পুরনো ফ্রিজ, এয়ারকন্ডিশনার থেকে CFC গ্যাস অপসারণ।

শিল্পে HCFC বিকল্প প্রযুক্তি ব্যবহার।

শিক্ষা ও মিডিয়ায় সচেতনতা বৃদ্ধির প্রচারণা।

তবে সাধারণ মানুষের সচেতনতা এখনও পর্যাপ্ত নয়।

করণীয়

দৈনন্দিন জীবনে CFC-free ও ozone-friendly পণ্য ব্যবহার।

পুরনো যন্ত্রপাতি পরিবেশবান্ধবভাবে রিসাইক্লিং।

শিশু-কিশোরদের পরিবেশবান্ধব জীবনধারায় অভ্যস্ত করা।

সরকার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সাথে সমন্বয় বৃদ্ধি।

পরিশেষে বলতে চাই, আন্তর্জাতিক ওজোন স্তর সুরক্ষা দিবস আমাদের শেখায় যে, মানবজাতি চাইলে বৈশ্বিক সমস্যার সমাধান করতে পারে। ওজোন স্তর আমাদের জীবন ও স্বাস্থ্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। UV-B রশ্মি থেকে ত্বক, চোখ এবং রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা সুরক্ষিত রাখতে ওজোন স্তর অপরিহার্য। মন্ট্রিয়াল প্রটোকল দেখিয়েছে, ঐক্যবদ্ধ আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টায় কোটি কোটি মানুষকে ত্বক ক্যান্সার, চোখের ছানি এবং সংক্রমণজনিত রোগ থেকে রক্ষা করা সম্ভব। এটি শুধু পরিবেশ রক্ষা নয়; এটি মানব স্বাস্থ্য ও সমগ্র জীববৈচিত্র্য রক্ষায় কার্যকর।

পৃথিবীর আকাশঢাকা অদৃশ্য ছাতা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দেয়। যদি আমরা সচেতন না হই, ত্বক ক্যান্সার, চোখের সমস্যা, রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতার হ্রাস এবং খাদ্যশস্যের ক্ষতির মতো জটিলতা আরও বৃদ্ধি পাবে। তাই ১৬ সেপ্টেম্বর আমাদের নতুন অঙ্গীকার নিতে হবে—ওজোন স্তর রক্ষায় সক্রিয় হওয়া, স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধি করা এবং পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি ব্যবহার নিশ্চিত করা। আমাদের শিশু-কিশোরদের মধ্যে পরিবেশবান্ধব অভ্যাস গড়ে তোলা, শিক্ষা ও গণমাধ্যমে সচেতনতা প্রচার, এবং সরকারি ও আন্তর্জাতিক উদ্যোগে সমর্থন জোরদার করা অতীব জরুরি। একত্রিত প্রচেষ্টায় আমরা শুধু আজকের প্রজন্মকে নয়, আগামী প্রজন্মকেও নিরাপদ ও সুস্থ জীবন দিতে পারব।

লেখক: কলাম লেখক ও গবেষক, প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি।