বিশ্ব রোগী নিরাপত্তা দিবস
নিরাপদ চিকিৎসা, শান্তিময় জীবন

ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ
প্রতিবছর ১৭ সেপ্টেম্বর বিশ্বব্যাপী পালিত হয় বিশ্ব রোগী নিরাপত্তা দিবস ২০২৫। ২০১৯ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ৭২তম বিশ্ব স্বাস্থ্য সমাবেশে ‘গ্লোবাল অ্যাকশন অন পেশেন্ট সেফটি’ তথা রোগীর সুরক্ষায় বিশ্বব্যাপী পদক্ষেপ কর্মসূচি গৃহীত হওয়ার মাধ্যমে ১৭ সেপ্টেম্বরকে বিশ্ব রোগী নিরাপত্তা দিবস হিসাবে ঘোষণা করে। রোগীর স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও নিরাপত্তার স্বার্থে এবং সম্ভাব্য ক্ষতি থেকে রক্ষার লক্ষ্যে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অন্তর্ভুক্ত দেশগুলো একসঙ্গে কাজ করার অঙ্গীকার করে। সেই সঙ্গে সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি, সবাইকে সম্পৃক্ত করা, সারা বিশ্ব যেন একই মনোভাব নিয়ে একসঙ্গে কাজ করার মাধ্যমে রোগীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করে-এসব বিষয়ের ওপর গুরুত্ব দেয়।বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) ঘোষিত এ বছরের প্রতিপাদ্য—“রোগী-কেন্দ্রিক যত্নই নিরাপদ যত্ন”—কেবল একটি শ্লোগান নয়, এটি আধুনিক স্বাস্থ্যসেবার মূল ভিত্তি। কারণ স্বাস্থ্যসেবা মানে কেবল রোগ নিরাময় নয়; বরং রোগীকে নিরাপদ রাখা, তার মর্যাদা রক্ষা করা এবং তাকে চিকিৎসা সেবার কেন্দ্রবিন্দুতে স্থাপন করা। বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্যব্যবস্থা যখন দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে, তখন রোগী নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং রোগী-কেন্দ্রিক যত্নের মাধ্যমে চিকিৎসার মান উন্নয়ন করাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চাবিকাঠি।
রোগী নিরাপত্তার বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট
প্রতিদিন কোটি কোটি মানুষ বিশ্বজুড়ে হাসপাতাল, ক্লিনিক ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রে চিকিৎসা সেবা গ্রহণ করেন। তবে দুঃখজনক হলেও সত্য, চিকিৎসার সময় অসাবধানতা, ভুল ও ব্যবস্থাপনার ঘাটতির কারণে বহু রোগী অপ্রয়োজনীয় ঝুঁকির সম্মুখীন হন। WHO-এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী, হাসপাতালে ভর্তি প্রতি ১০ জন রোগীর মধ্যে অন্তত একজন চিকিৎসা-সম্পর্কিত ত্রুটির শিকার হন। প্রতিবছর প্রায় ২৬ লাখ মানুষ চিকিৎসাজনিত ভুল বা অবহেলার কারণে মৃত্যুবরণ করেন, যার মধ্যে প্রায় ৭০ শতাংশ প্রতিরোধযোগ্য। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এই ঝুঁকি আরও বেশি। কারণ এখানে হাসপাতালের অবকাঠামো, প্রশিক্ষিত জনবল, স্যানিটেশন ও প্রযুক্তির ব্যবহার সীমিত। এই বাস্তবতা স্পষ্টভাবে আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, রোগী নিরাপত্তা কেবল চিকিৎসার মানের ইস্যু নয়, এটি মানবাধিকার এবং জনস্বাস্থ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
কেন রোগী-কেন্দ্রিক যত্ন জরুরি
অতীতে চিকিৎসা ব্যবস্থায় রোগীকে কেবল নির্দেশ গ্রহণকারী হিসেবে দেখা হতো। তবে বর্তমানে ধারণা পাল্টেছে। রোগীকে চিকিৎসা প্রক্রিয়ার সক্রিয় অংশীদার করা হচ্ছে। রোগী-কেন্দ্রিক যত্নের মূল উপাদানগুলো হলো—
* রোগীর মতামত ও অভিজ্ঞতাকে চিকিৎসা সিদ্ধান্তে গুরুত্ব দেওয়া, * রোগীর সংস্কৃতি, ধর্ম, মূল্যবোধ ও ব্যক্তিগত চাহিদাকে সম্মান করা, * জটিল চিকিৎসা তথ্য সহজ ও বোধগম্য ভাষায় ব্যাখ্যা করা, * চিকিৎসক, নার্স, রোগী ও পরিবারের মধ্যে স্বচ্ছ ও সমন্বিত যোগাযোগ নিশ্চিত করা। গবেষণা প্রমাণ করেছে, যখন রোগী চিকিৎসা সিদ্ধান্তে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হন, তখন চিকিৎসার ফলাফল উল্লেখযোগ্যভাবে উন্নত হয়। রোগীর আস্থা বৃদ্ধি পায়, চিকিৎসা ব্যয় কমে এবং পুনর্বাসন প্রক্রিয়া দ্রুত হয়। এছাড়াও, রোগীর মানসিক শান্তি ও সন্তুষ্টি বৃদ্ধি পায়, যা দীর্ঘমেয়াদে সুস্থ জীবন নিশ্চিত করে।
রোগী নিরাপত্তার প্রধান চ্যালেঞ্জ
রোগী নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পথে কিছু বড় চ্যালেঞ্জ রয়েছে—
১. চিকিৎসা জনিত ভুল: ভুল ওষুধ, ভুল ডোজ বা ভুল রোগ নির্ণয় জীবনহানির মূল কারণ।
২. হাসপাতাল-সংক্রমণ: অপরিষ্কার পরিবেশ এবং জীবাণুমুক্ত যন্ত্রপাতি রোগীদের জন্য বড় ঝুঁকি।
৩. জনবল সংকট: প্রশিক্ষিত ডাক্তার, নার্স এবং স্বাস্থ্যকর্মীর অভাব।
৪. যোগাযোগের ঘাটতি: রোগী ও চিকিৎসকের মধ্যে তথ্যের স্বচ্ছ আদান-প্রদানে সমস্যা।
৫. প্রযুক্তির সীমিত ব্যবহার: ই-হেলথ রেকর্ড, টেলিমেডিসিন ও এআই-ভিত্তিক টুলসের সীমিত ব্যবহার।
৬. জবাবদিহিতার অভাব: ত্রুটি গোপন করার প্রবণতার কারণে একই ভুল বারবার ঘটে।
এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা না করলে রোগীর জীবন ও মানসম্মত চিকিৎসা উভয়ই ঝুঁকির মুখে পড়ে।
পরিবারের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা
রোগীর পরিবারকে বলা হয় স্বাস্থ্যসেবার “অদৃশ্য অংশীদার”। কারণ—
* তারা রোগীর চিকিৎসা ইতিহাস ও উপসর্গ ভালোভাবে জানেন, * চিকিৎসকের সঙ্গে তথ্য আদান-প্রদানে সেতুবন্ধন তৈরি করেন, * রোগীকে চিকিৎসা নির্দেশ মেনে চলতে উৎসাহিত করেন, * মানসিক শক্তি যোগান এবং পরিচর্যায় সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। বিশেষ করে বাংলাদেশে, যেখানে নার্স-রোগী অনুপাত এখনো সীমিত, পরিবারের সক্রিয় অংশগ্রহণ রোগীর নিরাপত্তার জন্য অত্যন্ত কার্যকর।
বাংলাদেশে রোগী নিরাপত্তার চিত্র
* বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হলেও রোগী নিরাপত্তা এখনো বড় চ্যালেঞ্জ।
* সরকারি হাসপাতাল: সীমিত বেড, অতিরিক্ত ভিড়, জনবল সংকট ও অবকাঠামোগত দুর্বলতা।
* বেসরকারি হাসপাতাল: উচ্চ খরচ এবং আর্থিক চাপ রোগীকে অসম্পূর্ণ চিকিৎসা বা ঋণের ফাঁদে ফেলে।
* গ্রামীণ অঞ্চল: দক্ষ চিকিৎসক ও মানসম্মত স্বাস্থ্যকেন্দ্রের অভাব।
ইতিবাচক দিকও আছে। বিভিন্ন হাসপাতালে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ কমিটি, অভিযোগ গ্রহণ সেল এবং ডিজিটাল রেজিস্ট্রেশন ব্যবস্থা চালু হয়েছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ও রোগী নিরাপত্তাকে নীতিগত অগ্রাধিকার দিতে শুরু করেছে। তাছাড়া, রোগীর চিকিৎসার নিরাপত্তা নিশ্চিত ও অধিকার রক্ষায় ২০২০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি। এটি রোগী, চিকিৎসক এবং পরিবারের মধ্যে সমন্বয় গড়ে তুলতে কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে যাতে চিকিৎসা ত্রুটি ও অবহেলার প্রতিকার নিশ্চিত সহজ হয়। এবং রোগীর অধিকার সংরক্ষণের জন্য নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের চেষ্টা চালাচ্ছে। এছাড়াও সোসাইটিটি—স্বাস্থ্যসেবা সংক্রান্ত সচেতনতা ও প্রশিক্ষণ কর্মসূচি পরিচালনা করে, বিনামূল্য ফ্রি চিকিৎসা ক্যাম্প পরিচালনা করে, রোগী নিরাপত্তা প্রতিটি চিকিৎসা প্রক্রিয়ায় অঙ্গাঙ্গিভাবে প্রয়োগ নিশ্চিত করতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটির এই কর্মকাণ্ড রোগী, চিকিৎসক ও পরিবারকে একত্রিত করে, যা বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবা খাতকে আরও নিরাপদ ও কার্যকর করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা
বিশ্বের বিভিন্ন দেশ রোগী নিরাপত্তায় সফল উদাহরণ স্থাপন করেছে—
* যুক্তরাজ্য: প্রতিটি হাসপাতালে আলাদা পেশেন্ট সেফটি অফিসার নিয়োগ বাধ্যতামূলক।
* জাপান: প্রতিটি সার্জারির আগে সার্জিক্যাল সেফটি চেকলিস্ট ব্যবহার বাধ্যতামূলক।
* সুইডেন: রোগীর পরিবারকে চিকিৎসা পরিকল্পনার প্রতিটি ধাপে যুক্ত করা হয়।
* সিঙ্গাপুর: ডিজিটাল রোগী রেকর্ডের মাধ্যমে চিকিৎসা ত্রুটি ৫০% কমেছে। বাংলাদেশ চাইলে এসব অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে নিজস্ব স্বাস্থ্যব্যবস্থায় প্রয়োগ করতে পারে।
রোগী নিরাপত্তায় করণীয়
রোগী নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রয়োজন—
১. নীতি ও আইন: রোগীর অধিকার রক্ষায় কঠোর আইন ও কার্যকর বাস্তবায়ন।
২. মানবসম্পদ উন্নয়ন: চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের নিয়মিত প্রশিক্ষণ।
৩. সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ: হাসপাতালের পরিচ্ছন্নতা ও জীবাণুমুক্তকরণ নিশ্চিত করা।
৪. প্রযুক্তির ব্যবহার: ই-হেলথ রেকর্ড, টেলিমেডিসিন এবং এআই-ভিত্তিক টুলস।
৫ . সচেতনতা বৃদ্ধি: গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারণা।
৬. রোগীর অংশগ্রহণ: রোগীকে সিদ্ধান্ত গ্রহণের সক্রিয় অংশীদার করা।
৭. স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা: ত্রুটি গোপন না করে খোলামেলা আলোচনার সংস্কৃতি গড়ে তোলা।
প্রতিপাদ্যের তাৎপর্য
রোগী-কেন্দ্রিক যত্নই নিরাপদ যত্ন”—এই প্রতিপাদ্য মনে করিয়ে দেয়, চিকিৎসার মূল উদ্দেশ্য শুধু রোগ নিরাময় নয়, বরং রোগীকে নিরাপদ রাখা। রোগীকে উপেক্ষা করলে চিকিৎসা অসম্পূর্ণ থাকে। রোগীকে কেন্দ্রবিন্দুতে রাখলে চিকিৎসা মানবিক, কার্যকর এবং দীর্ঘস্থায়ী হয়। চিকিৎসকরা শুধু রোগ নিরাময় করবেন না, রোগীর আস্থা অর্জন করবেন, রোগীর অধিকার রক্ষা করবেন এবং রোগী-কেন্দ্রিক দৃষ্টিকোণ থেকে স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করবেন। এই ধরনের পরিবেশে রোগী এবং পরিবার উভয়ই স্বস্তি এবং আত্মবিশ্বাস অনুভব করে, যা সুস্থ সমাজ ও শক্তিশালী স্বাস্থ্যখাত গঠনে সহায়ক।
পরিশেষে বলতে চাই, রোগী নিরাপত্তা আমাদের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি। প্রতিটি রোগী সঠিক চিকিৎসা, সঠিক তথ্য এবং নিরাপদ পরিবেশ পাওয়ার অধিকার রাখে। চিকিৎসা ভুল, অবহেলা বা অপর্যাপ্ত নজরদারির কারণে রোগীর জীবনের ওপর গুরুতর প্রভাব পড়তে পারে। তাই হাসপাতাল, ক্লিনিক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের কাছে রোগী নিরাপত্তা সর্বোচ্চ প্রাধান্য পাওয়া উচিত। এতে কেবল রোগীর জীবন রক্ষা হয় না, বরং চিকিৎসা কার্যক্রমের মানও বৃদ্ধি পায়। রোগী ও পরিবারের সচেতনতা, স্বাস্থ্যকর্মীদের নিয়মিত প্রশিক্ষণ, সঠিক প্রোটোকল এবং প্রযুক্তির ব্যবহার—সব মিলিয়ে একটি নিরাপদ স্বাস্থ্যপরিবেশ নিশ্চিত করা যায়। বিশ্ব রোগী নিরাপত্তা দিবস আমাদের মনে করিয়ে দেয়, যে রোগী-কেন্দ্রিক সেবা শুধু কর্তব্য নয়, বরং মানবিক ও সামাজিক দায়িত্বও। এককভাবে নয়, সমষ্টিগত প্রচেষ্টার মাধ্যমে আমরা রোগী নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারি, যা স্বাস্থ্যসেবার বিশ্বাসযোগ্যতা ও মান উন্নয়নের মূল চাবিকাঠি।
লেখক: সংগঠক,কলাম লেখক ও গবেষক, প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি।