বহাল তবিয়তে সাতক্ষীরার হাড়দ্দহের চোরাচালানী মণ্টু
ভারতীয় পণ্যভর্তি চারটি ট্রলারসহ ৫০ জন টেকনাফ সীমান্তে আটক, খুঁজে পেতে স্বজনদের দৌড়ঝাঁপ

রঘুনাথ খাঁ, সাতক্ষীরা : চলতি সেপ্টেম্বরের প্রথম থেকে থ্রিপিচ, শাড়ী, কসমেটিকস গুডস, ইমিটেশান গহনা ও বিভিন্ন ভারতীয় চোরাইপণ্য ভর্তি চারটি ট্রলারসহ কমপক্ষে ৫০ কোটি টাকার মালামাল ও ৫০ জন শ্রমিক গত ১০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে টেকনাফ সীমান্তে আটক হয়েছে। এদের মধ্য তিনটি ট্রলারসহ ৩৬ জন শ্রমিককে আরাকান আর্মি জেলে হিসেবে ধরে নিয়ে গেছে মর্মে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার হলেও সর্বশেষ গত ১০ সেপ্টেম্বর টেকনাফ এলাকায় কোস্টগার্ডের হাতে আটক সাতক্ষীরা সদরের দক্ষিণ হাড়দ্দহ, ভোমরা ও শাখরা গুচ্ছ গ্রামের ১৩জনের পরিবার উৎকণ্ঠার মধ্যে রয়েছেন। তাদের উদ্ধারে পরিবারের স্বজনরা দৌঁড়ঝাঁপ শুরু করেছেন। দক্ষিণ হাড়দ্দহ গ্রামের ইমরান হোসেন সাগরে নিখোঁজ হলেও মণ্টু ও তার সিণ্ডিকেটের ভয়ে মুখ খুলতে সাহস পাচ্ছেন না।
দেবহাটার পারুলিয়া বলফিল্ড এলাকার এক ব্যক্তি জানান, তিনি এক সময় সদর উপজেলার দক্ষিণ হাড়দ্দহ গ্রামের আবুল হোসেনের ছেলে হাফিজুর রহমান মণ্টু ও তার ব্যবসায়িক পার্টনারের ভারতে গ্যাস সিলিণ্ডার পাচারে শ্রমিক হিসেবে কাজ করতেন। ১৯৮৯ সালে শ্যামনগরের নওয়াবেকী খেয়াঘাটে ট্রলারে গ্যাস সিলিণ্ডার তোলার আগেই ট্রাকের চাকা দেবে যাওয়ায় স্থানীয় জনতা তা দেখতে পেয়ে পুলিশে খবর দেয়। যদিও মালিকপক্ষ পুলিশকে ম্যানেজ করে তা ছাড়িয়ে আনে।
খুলনার কয়রা সদরের আবু সাঈদ জানান, দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে যুবদল নেতা মিঠুর সাথে সুন্দরবন দিয়ে ভারতীয় চোরাইপণ্য, অস্ত্র ও মাদক নদীপথে পটুয়াখালি ও খুলনাসহ দেশের বিভিন্নস্থানে পাচারকাজে তিনি শ্রমিক হিসেবে কাজ করেছেন। তাকে অর্থনৈতিক সহায়তা দিয়েছেন বরিশালের সামাদ (বর্তমানে ঢাকার বঙ্গ বাজারে তার কাপড়ের দোকান রয়েছে) ও বাচ্চু। এখন মন্টু সাহেব বনে গিয়েছেন। ব্যবসা তার একার। ভারতীয় পণ্যবাহি ট্রলার টেকনাফ সীমান্তে খালাস করে সেখান থেকে মাদক ও অস্ত্র ভর্তি করে দেশের বিভিন্ন স্থানে পাচার করে থাকেন। গত বছরের জুন ও জুলাই মাসে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে প্রশাসনের দৃষ্টিভঙ্গি অন্যদিকে থাকায় টেকনাফ এলাকার এক মাদক পাচারকারির সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলে ভারতীয় কাপড়, ত্রি-পিচ, কসমেটিকস গুডস, ইমিটেশান গহনাসহ বিভিন্ন সামগ্রী মায়ানমারে পাঠাতে শুরু করেন।
কোলকাতার খিদিরপুর ডক থেকে ট্রলার ভর্তি এসব মালামাল সরাসরি সুন্দরবনের ভিতর সাগরে রেখে নিজের ট্রলারে ভর্তি করে কয়রা হয়ে কলাপাড়া দিয়ে টেকনাফে নিয়ে যেতেন মন্টু। প্রথমে একটি ট্রলার দিয়ে শুরু করলেও বর্তমানে তার চারটি ট্রলার নিয়মিত পণ্য চোরাচালানিতে ব্যবহার হয়। এতে তার অর্থনৈতিক অবস্থার পরিবর্তণ ঘটতে শুরু করে। তার ভাই রবিউল ইসলাম নিজেকে মানবাধিকার কর্মী হিসেবে রক্ষাকবচ তৈরি করে নিজেকে বিপদের বাইরে রাখার চেষ্টা করে আসছেন।
গত বছরের ৫ আগষ্ট শেখ হাসিনার দেশত্যাগের পর আওয়ামী লীগের সাংসদ, জেলা পারিষদের চেয়ারম্যান, উপজেলা চেয়ারম্যান, ইউপি চেয়ারম্যানসহ বিশাল সংখ্যক আওয়ামী লীগ নেতা- কর্মী মব ভায়োলেন্স থেকে বাঁচতে ৫ আগষ্ট আগষ্ট সন্ধ্যার পর থেকে বরিশালের বাচ্চুর সহযোগিতায় খুলনা, বাগেরহাট, পিরোজপুর, পটুয়াখালি জেলার কমপক্ষে চারজন সাংসদ, শতাধিক জনপ্রতিনিধি এবং কয়েক’শ আওয়ামী লীগ নেতাকে সুন্দরবনের ভিতর দিয়ে প্রতিবেশী দেশ ভারতে পৌঁছে দেওয়ার ব্যাপারে হেভিওয়েট নেতা হিসেবে মাথা পিছু এক কোটি থেকে পাঁচ কোটি টাকা নিয়েছেন মন্টু।
১৬ দিনে মণ্টু আয় করেছেন শত কোটিরও বেশি টাকা। বর্তমানে মন্টু চোরাচালানি থেকে ২০০ কোটি টাকারও বেশি মালিক হয়েছেন। এতে ভাগ্য খুলেছে বেশ কিছু আইনপ্রয়োগকারি সংস্থার সদস্য, রাজনৈতিক নেতার। তবে সময় ভাল না যাওয়ায় চলতি মাসের প্রথম দিকে ভারতীয় পণ্যবহনকারি তিনটি ট্রলার ৩৮জন শ্রমিকসহ মায়ানমার সীমান্ত সাগরে আরাকান সেনাদের হাতে ধরা পড়ে। যাহা সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ পায়। তবে টেকনাফ সীমান্ত থেকে ৩৮ জন জেলে আরাকার সেনারা ধরে নিয়ে গেছে বলে প্রচার হয়। ওই সব শ্রমিকরা কয়রা, পাইকগাছা, আশাশুনি ও শ্যামনগরের বাসিন্দা। বর্তমানে তাদের সন্ধানে পরিবারের সদস্যরা দৌড়ঝাঁপ করছেন। তবে মন্টু ও তার ভাই রবিউলের পক্ষ থেকে তাদের মুক্তির জন্য সব ধরণের চেষ্টা করা হচ্ছে বলায় তারা মুখ খুলতে সাহস পাচ্ছে না।
শাখরা গুচ্ছগ্রামের এক বৃদ্ধ জানান, সাংসদ মীর মোস্তাক আহম্মেদ রবির বাড়িতে পরিচারিকার কাজ করতো তাদের গ্রামের এক নারী। ওই নারীর হাত দিয়ে ওই সাবেক সাংসদকে ম্যানেজ করতে মন্টু। একপর্যায়ে তাকেই বিয়ে করে চালতেতলায় দোতলা বাড়ি বানিয়ে দেন মন্টু। ওই নারীর এক আত্মীয় তিনি। তার ছেলে গত ৪ সেপ্টেম্বর হাড়দ্দহের ইয়াছিন হোসেন বাবলুর ছেলে ইমরান, একই গ্রামের আনিছ সরদারের ছেলে আসাদুল ইসলাম আশু, আব্দুস সাত্তারের ছেলে সেলিম, আব্দুর রহিমের ছেলে চোট্টু, আব্দার গাজীর ছেলে কবীর, গোলাম সরদারের ছেলে রণি, শাহজাহানের ছেলে ইউসুফ আলী, ফজর আলীর ছেলে ইউনুছ আলী, খালেকের ছেলে রজব আলী, হাসানের ছেলে পল্টু, আকবরের ছেলে আরিফুল, হাফিজউদ্দিনের ছেলে আবলু হোসেন, খালেকের ছেলে জাহিদুল, আব্দুল হামিদের চেলে খাদিবুল, খালেকের ছেলে সোহেল ও ভোমরা ফুলতলার আব্দুল্লাহর ছেলে শাওন বাড়ি থেকে মন্টুর ট্রলারে শ্রমিক হিসেবে কাজ করতে যায়। ওই রাতেই সুন্দরবন সংলগ্ন সাগর থেকে ভারতীয় ট্রলার থেকে পণ্য মন্টুর ট্রলারে ভর্তি করা হয়। ওই ট্রলারের চালক ছিল মন্টুর ভাই রবি। ১০ সেপ্টেম্বর রাতে ওই ট্রলার টেকনাফ এলাকা থেকে প্রায় এক ঘণ্টা অতিক্রম করার পর মায়ানমার সীমান্তের সাগরে কোষ্ট গার্ডের হাতে ধরা পড়ে। এ সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে ইমরান সাগরে পড়ে যায়। একই সাথে সাগরে পড়ে ভোমরার শাওন। তবে শাওনসহ ১২ জন শ্রমিককে উদ্ধার করে ট্রলার ভর্তি মালামালসহ আটক করে কোষ্টগার্ড। এরপর থেকে মন্টু আটককৃতদের স্বজনদের বিভিন্নভাবে আশ^স্ত করছেন ও কোথাও মুখ না খোলার জন্য হুমকি ধামকি দিচ্ছেন।
সরেজমিনে বুধবার হাড়দ্দহ, শাখরা, গুচ্ছগ্রামে ও ভোমরায় যেয়ে জানা গেছে, আটককৃত চারটি ট্রলারে ওইসব গ্রামের ২৮ জন যুবক শ্রমিক হিসেবে মায়ানমার সীমান্তে আটক হয়েছেন। তাদের ভবিষ্যৎ কি তা কেউ বলতে পারে না। তবে রনি নামে শাখরার এক যুবকের ফেইসবুক থেকে তারা ওই ট্রলার কোষ্টগার্ডের হাতে সেন্টমার্টিনের কাছে অঅটক রয়েছে ও ইমরান সাগরের পানিতে পড়ে নিখোঁজ রয়েছে মর্মে জানতে পারেন।
ভোমরা ফুলতলা এলাকার আব্দুল্লার বাড়িতে (চোরাচালানী মন্টুর ভাই মৃত সবুরের ভায়রাভাই) যেয়ে যেয়ে দেখা গেছে লোকজন নেই। আব্দুল্লার শ্যালক বিএনপি নেতা সাদ্দাম হোসেনের আত্মীয় পরিচয়ে এক বৃদ্ধা বলেন, আব্দুল্লাহ, তার স্ত্রীসহ কয়েকজন বুধবার সকালে ছেলে শাওনকে কোস্টগার্ডের হাত থেকে ফিরিয়ে আনতে সেন্টমার্টিনের উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছেন।
এদিকে ১৪ সেপ্টেম্বর প্রথম খবর প্রকাশ হলেও চোরাচালানি মন্টু ভেঙে পড়েননি। তিনি প্রশাসনসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতাদের পরামর্শ নেন। রেজগি, অনলাইন ও অফ লাইনের সাংবাদিকদের তার বাড়িতে লাইন দেখে তিনি বিপদে পড়েন। একপর্যায়ে তিনি বাইরে রাত কাটালেও ১৫ সেপ্টেম্বর দুপুরে মটর সাইকেলে বাড়ি ফেরেন। তবে আইনপ্রয়োগকারি সংস্থার লোকজনও সাদা পোশাকে মন্টুর এলাকায় ঘোরাঘুরি করতে দেখেছেন বলে জানিয়েছেন একাধিক ব্যক্তি। তবে এত বড় অপরাধের পর থেকে দেশের শীর্ষ চোরাচালানি মন্টু কিভাবে প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে তা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন সাধারণ মানুষ।
(আরকে/এসপি/সেপ্টেম্বর ১৭, ২০২৫)