ওয়াজেদুর রহমান কনক


উদ্যোক্তা ধারণার শিকড় মানব সভ্যতার প্রাচীনতম অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে নিহিত, যেখানে বিনিময় প্রথা, কৃষিকাজ ও ক্ষুদ্র বাণিজ্যের মাধ্যমে ঝুঁকি গ্রহণ ও উদ্ভাবনের সূচনা হয়েছিল। মধ্যযুগে গিল্ড ও বণিক গোষ্ঠীগুলোর উত্থান বাণিজ্য ও সামাজিক সংগঠনে উদ্যোক্তার ভূমিকাকে নতুন মাত্রা দেয়। ১৮শ শতকে রিচার্ড কান্তিলন উদ্যোক্তাকে অর্থনীতির একটি বিশিষ্ট উপাদান হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেন, যেখানে ঝুঁকি গ্রহণ ও অনিশ্চয়তার ব্যবস্থাপনাকে প্রধান বৈশিষ্ট্য হিসেবে তুলে ধরা হয়। ১৯শ ও ২০শ শতকে জোসেফ শুম্পেটার উদ্যোক্তাকে “সৃজনশীল ধ্বংসের” মাধ্যমে অর্থনৈতিক অগ্রগতির চালিকাশক্তি হিসেবে ব্যাখ্যা করেন, আর ইসরায়েল কির্জনার(ইসরায়েল (Israel) একটি দেশ, এবং ইসরায়েল মেয়ার কির্জনার (Israel Kirzner) একজন ব্রিটিশ-জন্মত আমেরিকান অর্থনীতিবিদ, ইতিহাসবিদ, রাব্বি এবং তালমুডিস্ট, যিনি ১৯৩০ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি তার "ইসরায়েল কির্জনার" নামের জন্য পরিচিত, যার সাথে "ইসরায়েল" শব্দটি যুক্ত। তাই "ইসরায়েল কির্জনার" বলতে একজন নির্দিষ্ট ব্যক্তিকে বোঝানো হচ্ছে)  বাজারের অদক্ষতা চিহ্নিত করে সুযোগ কাজে লাগানোর ক্ষমতাকে উদ্যোক্তার মূল শক্তি হিসেবে দেখান। শিল্প বিপ্লব, পুঁজিবাদের প্রসার, এবং বৈশ্বিক বাণিজ্যের বিকাশ উদ্যোক্তা ধারণার সামাজিক প্রভাবকে গভীরতর করে, যেখানে উদ্যোক্তারা শুধু অর্থনৈতিক পরিবর্তন নয়, সাংস্কৃতিক ও প্রযুক্তিগত রূপান্তরেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। আধুনিক কালে স্টার্টআপ সংস্কৃতি, ভেঞ্চার ক্যাপিটাল, এবং ডিজিটাল উদ্ভাবন উদ্যোক্তাবৃত্তিকে বিশ্বায়িত অর্থনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে এসেছে, যা দেখায় যে উদ্যোক্তা ধারণা শুধু অর্থনৈতিক কাঠামো নয়, সমাজের অগ্রগতি ও পরিবর্তনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত।

উদ্যোক্তা ধারণার বিবর্তন বোঝার জন্য অর্থনীতির দীর্ঘ ইতিহাস, তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ, এবং পরিসংখ্যানভিত্তিক তথ্যকে একত্রে বিবেচনা করতে হয়। রিচার্ড কান্তিলন (১৮শ শতক) উদ্যোক্তা শব্দটিকে প্রথম অর্থনৈতিক বিশ্লেষণে নিয়ে আসেন। তাঁর মতে উদ্যোক্তা হলেন সেই ব্যক্তি যিনি বাজারের অস্থিরতার ঝুঁকি গ্রহণ করে কম মূল্যে কিনে বেশি মূল্যে বিক্রি করে মুনাফা অর্জন করেন। ফরাসি ও ইউরোপীয় বাজারের তৎকালীন অবস্থা অনুযায়ী কান্তিলনের ধারণা তখনকার কৃষি, বাণিজ্য ও প্রাথমিক শিল্প কাঠামোর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল। শুম্পেটার (২০শ শতকের প্রথমভাগ) এই ধারণাকে বদলে দেন—তিনি উদ্যোক্তাকে শুধু ঝুঁকি গ্রহণকারী নয়, বরং উদ্ভাবক ও অর্থনৈতিক পরিবর্তনের চালিকা শক্তি হিসেবে দেখান। তাঁর তত্ত্ব অনুযায়ী “creative destruction” বা সৃজনশীল ধ্বংসের মাধ্যমে উদ্যোক্তারা পুরনো পদ্ধতি ও পণ্যকে প্রতিস্থাপন করে নতুন প্রযুক্তি ও ব্যবসার জন্ম দেন। ইস্রায়েল কির্জনার (২০শ শতকের শেষভাগ) আবার উদ্যোক্তার ভূমিকাকে বাজারের অসামঞ্জস্য শনাক্তকারী হিসেবে দেখিয়েছেন; তাঁর মতে উদ্যোক্তা সুযোগ খুঁজে বের করে সম্পদের কার্যকর পুনর্বণ্টন ঘটান এবং বাজারকে ভারসাম্যের দিকে নেন।

ইতিহাসের নির্দিষ্ট পরিসংখ্যান এই ধারণাগুলোর প্রভাবকে সুস্পষ্ট করে। ইউরোপের ১৮শ শতকের শেষভাগ থেকে ১৯শ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত শিল্পবিপ্লবকালীন সময়ে যুক্তরাজ্যের শিল্প উৎপাদন বার্ষিক গড়ে প্রায় ২–৩% হারে বেড়েছিল, যা ১৭০০–১৭৫০-এর ০.৫% বৃদ্ধির হারের তুলনায় বিপুল অগ্রগতি। এই সময় উদ্যোক্তাদের নতুন কারখানা স্থাপন, রেলপথ নির্মাণ এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে অংশগ্রহণ ব্রিটেনের রপ্তানি আয়ে ১৭৮০ থেকে ১৮৪০ সালের মধ্যে প্রায় তিনগুণ বৃদ্ধি ঘটায়। শুম্পেটারের সময়ে, ১৯০০ থেকে ১৯৩০ সালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের মোট শিল্প উৎপাদন প্রায় দ্বিগুণ হয়েছিল—তৎকালীন নতুন প্রযুক্তি যেমন বৈদ্যুতিক শক্তি, অটোমোবাইল ও রাসায়নিক শিল্পের দ্রুত বিকাশের কারণে। মার্কিন শ্রম পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী ১৯০০ সালে অটোমোবাইল শিল্পে মাত্র কয়েক হাজার কর্মী থাকলেও ১৯৩০ সালের মধ্যে এই সংখ্যা ৩ লাখের বেশি হয়, যা শুম্পেটারের “উদ্ভাবক উদ্যোক্তা” ধারণার বাস্তব প্রতিফলন।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে কির্জনারের তত্ত্ব বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। ১৯৫০ থেকে ১৯৭৩ সালের মধ্যে বৈশ্বিক জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার গড়ে ৪.৯% ছিল—এটিকে “Golden Age of Capitalism” বলা হয়। এই সময়ে উদ্যোক্তারা বাজারে অসম্পূর্ণ তথ্য ও সুযোগ শনাক্ত করে দ্রুত বিনিয়োগ ও সম্প্রসারণে এগিয়ে যান। উদাহরণস্বরূপ, জাপানের টয়োটা প্রোডাকশন সিস্টেম বা সিলিকন ভ্যালির সেমিকন্ডাক্টর উদ্যোক্তারা কির্জনারের বাজার আবিষ্কারের নীতিকে বাস্তবে প্রমাণ করে। বিশ্বব্যাংকের তথ্যমতে ১৯৮০ থেকে ২০০০ সালের মধ্যে প্রযুক্তি-নির্ভর স্টার্টআপ ইকোসিস্টেম যুক্তরাষ্ট্রে ভেঞ্চার ক্যাপিটাল বিনিয়োগকে বছরে প্রায় ৬ গুণ বৃদ্ধি করে (প্রায় ৩ বিলিয়ন ডলার থেকে ১৮ বিলিয়ন ডলার)।

২১শ শতাব্দীতে উদ্যোক্তা তত্ত্বের এই বিবর্তন সরাসরি পরিসংখ্যান দ্বারা দৃশ্যমান। গ্লোবাল এন্টারপ্রেনারশিপ মনিটরের (GEM) ২০২3 সালের জরিপ অনুযায়ী বিশ্বব্যাপী প্রাপ্তবয়স্ক জনগোষ্ঠীর প্রায় ১৪.৫% উদ্যোক্তা কার্যক্রমে জড়িত, যা ২০০১ সালের ৯% এর তুলনায় উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি। একই সময়ে, ইউনিকর্ন স্টার্টআপের সংখ্যা ২০১৩ সালের ৩৯ থেকে ২০২৩ সালে ১,২০০-এর বেশি হয়েছে—যা শুম্পেটারের “সৃজনশীল ধ্বংস” ধারণার আধুনিক রূপ। যুক্তরাষ্ট্রের ব্যুরো অফ ইকোনমিক অ্যানালিসিসের তথ্য অনুযায়ী প্রযুক্তি খাতে স্টার্টআপ দ্বারা সৃষ্ট নতুন কর্মসংস্থান ২০১০ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে প্রায় ৩৫% বৃদ্ধি পেয়েছে।

এই পরিসংখ্যান ও ঐতিহাসিক প্রবণতা দেখায় যে উদ্যোক্তা ধারণা কেবল অর্থনৈতিক চিন্তার তত্ত্বগত অংশ নয়, বরং বাস্তব অর্থনৈতিক পরিবর্তনের চালিকাশক্তি। কান্তিলনের ঝুঁকি গ্রহণ থেকে শুরু করে শুম্পেটারের উদ্ভাবন ও কির্জনারের সুযোগ শনাক্তকরণ—এই ধারাগুলি শিল্পবিপ্লব থেকে ডিজিটাল যুগ পর্যন্ত বৈশ্বিক অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি ও কর্মসংস্থানের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত থেকে আধুনিক উদ্যোক্তাবৃত্তির ভিত্তি তৈরি করেছে।

উদ্যোক্তার ধারণার উদ্ভব মানব ইতিহাসের অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিকাশের গভীরে প্রোথিত। প্রাচীন সভ্যতাগুলোতে যখন বিনিময় বাণিজ্য এবং কৃষি উৎপাদন মানুষকে জীবনধারণের বাইরে অতিরিক্ত সম্পদ সঞ্চয়ের সুযোগ করে দিতে শুরু করল, তখনই উদ্যোক্তাবৃত্তির প্রাথমিক বীজ রোপিত হয়। মেসোপটেমিয়ার নগররাষ্ট্রগুলোয় ব্যবসায়ী ও কারিগররা বাজারের চাহিদা বুঝে উৎপাদন পরিকল্পনা তৈরি করতেন। মিশরের ফেরাউন যুগে পিরামিড নির্মাণ বা নীলনদের কৃষি চক্র নিয়ন্ত্রণ—সবই এমন ব্যক্তিদের নেতৃত্বে হতো যারা সম্পদ, শ্রম ও ঝুঁকি ব্যবস্থাপনায় দক্ষ ছিলেন। ভারতীয় উপমহাদেশের সিন্ধু ও গঙ্গা সভ্যতায় পণ্যের মান বজায় রাখতে সিল-মোহর ব্যবহার এবং বাণিজ্যপথ বিস্তৃত করার মতো পদক্ষেপ উদ্যোক্তাদের পূর্বসূরি আচরণের সাক্ষ্য বহন করে।

প্রাচীন গ্রিস ও রোম উদ্যোক্তা চেতনার বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। গ্রিক শহর-রাষ্ট্রগুলোতে দার্শনিকেরা শ্রম, সম্পদ বণ্টন ও বাজার ব্যবস্থার ওপর চিন্তাভাবনা শুরু করেন। এরিস্টটল ও জেনোফনের মতো চিন্তাবিদেরা বাণিজ্যকে সমাজের একটি প্রয়োজনীয় ও নৈতিকভাবে গ্রহণযোগ্য অংশ হিসেবে দেখতে শেখান। রোমান সাম্রাজ্যে সুসংগঠিত আইন ব্যবস্থা, সড়ক ও বন্দর উন্নয়ন এবং বাণিজ্যপথের নিরাপত্তা উদ্যোক্তাদের কাজকে সহজ ও প্রাতিষ্ঠানিক করে তোলে।

মধ্যযুগে ইসলামী বিশ্ব উদ্যোক্তা চেতনায় নতুন মাত্রা যোগ করে। ইসলাম বাণিজ্য ও সততা সম্পর্কে যে নৈতিক শিক্ষা দেয় তা মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা ও এশিয়ায় মুসলিম বণিকদের ব্যাপক প্রভাব বিস্তারে সহায়তা করে। বাগদাদ, দামেস্ক ও কায়রো আন্তর্জাতিক বাণিজ্যকেন্দ্র হিসেবে গড়ে ওঠে। একই সময় ইউরোপে গিল্ড ব্যবস্থা কারিগর ও ব্যবসায়ীদের সংগঠিত করে উৎপাদন মান উন্নয়ন ও বাজার নিয়ন্ত্রণে নতুন মানদণ্ড স্থাপন করে।

রেনেসাঁ ও আলোকায়ন যুগ উদ্যোক্তা ধারণার বৌদ্ধিক ভিত্তি গভীর করে। বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার, প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন ও নৌপথ অনুসন্ধান বাণিজ্যকে বৈশ্বিক আকার দেয়। ইউরোপীয় বণিক ও অভিযাত্রীরা উপনিবেশ স্থাপন ও দূরপাল্লার বাণিজ্যের মাধ্যমে নতুন বাজার, কাঁচামাল ও বিনিয়োগের সুযোগ তৈরি করেন। এই সময়ে অর্থনৈতিক চিন্তায় উদ্যোক্তাদের কার্যক্রম নিয়ে আরও সংগঠিতভাবে আলোচনা শুরু হয়।

আধুনিক অর্থনীতিতে উদ্যোক্তার ধারণা তাত্ত্বিক রূপ পায় ১৮শ শতকের অর্থনীতিবিদ রিচার্ড কান্তিলনের বিশ্লেষণে। তিনি উদ্যোক্তাকে বাজারের অনিশ্চয়তা ও ঝুঁকি গ্রহণকারী হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেন, যিনি কম মূল্যে কিনে বেশি মূল্যে বিক্রি করে মুনাফা অর্জন করেন। পরবর্তীতে জ্যাঁ-বাতিস্ত সে এবং অ্যাডাম স্মিথ উদ্যোক্তাকে উৎপাদন ও বাজার ব্যবস্থার সংগঠক হিসেবে দেখান। ২০শ শতকের শুরুতে জোসেফ শুম্পেটার উদ্যোক্তার ভূমিকাকে আরেক ধাপ এগিয়ে নেন। তাঁর মতে উদ্যোক্তা শুধুমাত্র ঝুঁকি গ্রহণকারী নন, তিনি সমাজ ও অর্থনীতির রূপান্তরকারী উদ্ভাবক—যিনি “creative destruction” বা সৃজনশীল ধ্বংসের মাধ্যমে পুরনো প্রযুক্তি ও পদ্ধতিকে ভেঙে নতুন উদ্ভাবন ও উৎপাদন ব্যবস্থার জন্ম দেন। ইস্রায়েল কির্জনার পরবর্তীতে উদ্যোক্তাকে বাজারের অসম্পূর্ণতার মধ্যে সুযোগ শনাক্তকারী হিসেবে দেখান, যিনি সম্পদের কার্যকর পুনর্বণ্টনের মাধ্যমে অর্থনীতিকে ভারসাম্যের দিকে নিয়ে যান।

শিল্পবিপ্লব উদ্যোক্তা ধারণার বাস্তব প্রমাণ হিসেবে কাজ করে। যন্ত্রপাতি, বাষ্পশক্তি, রেলপথ ও কারখানা ভিত্তিক উৎপাদন পদ্ধতি নতুন ধরনের উদ্যোক্তাদের জন্ম দেয়, যারা পুঁজি, প্রযুক্তি ও শ্রমকে সমন্বিত করে অভূতপূর্ব হারে উৎপাদন ও বাণিজ্য সম্প্রসারণ করেন। পরবর্তীকালে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা, প্রযুক্তি বিপ্লব, তথ্যপ্রযুক্তির উত্থান এবং স্টার্টআপ সংস্কৃতির বিস্তারের মাধ্যমে উদ্যোক্তাবৃত্তির ধারণা আধুনিক ও বহুমাত্রিক রূপ নেয়।

আজকের উদ্যোক্তা ধারণা আর কেবল অর্থনৈতিক লাভের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এটি সামাজিক দায়িত্ব, পরিবেশগত স্থায়িত্ব, এবং প্রযুক্তি-চালিত উদ্ভাবনের সঙ্গে সম্পর্কিত। সামাজিক উদ্যোক্তাবৃত্তি, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যভিত্তিক ব্যবসা এবং ডিজিটাল স্টার্টআপ—সবই সেই দীর্ঘ ঐতিহাসিক যাত্রার আধুনিক প্রকাশ, যা মানব সভ্যতার প্রাচীন বাণিজ্য ও উদ্ভাবনী প্রচেষ্টা থেকে শুরু হয়েছিল। উদ্যোক্তার ধারণার উদ্ভব এভাবে মানুষের সৃজনশীলতা, ঝুঁকি গ্রহণের সাহস এবং সমাজ পরিবর্তনের অদম্য চেষ্টার ধারাবাহিক প্রকাশ।

উদ্যোক্তার ধারণা কেবল অর্থনৈতিক লাভের সীমাবদ্ধতায় সীমাবদ্ধ নয়; এটি সমাজ, প্রযুক্তি, সংস্কৃতি ও পরিবেশের সঙ্গে জড়িত একটি বহুমাত্রিক প্রক্রিয়া। ইতিহাস দেখায়, প্রাচীন বাণিজ্য ও কৃষি উদ্যোগ থেকে শুরু করে মধ্যযুগের গিল্ড ও বণিক সম্প্রদায়, শিল্পবিপ্লবের কারখানা ও আধুনিক স্টার্টআপ—সব ক্ষেত্রেই উদ্যোক্তারা নতুন ধারণা, প্রযুক্তি ও উৎপাদন পদ্ধতির মাধ্যমে সমাজকে পরিবর্তন ও সমৃদ্ধির দিকে নিয়ে গেছেন। আধুনিক সময়ে বিশ্বব্যাপী স্টার্টআপ ইকোসিস্টেমের বিকাশ, ভেঞ্চার ক্যাপিটাল ও ক্রাউডফান্ডিংয়ের প্রসার, এবং তথ্যপ্রযুক্তি ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার উদ্যোক্তাদের সক্ষমতা বহুগুণ বৃদ্ধি করেছে। এছাড়া সামাজিক উদ্যোক্তা ও টেকসই ব্যবসায়িক মডেলের উদ্ভাবন দেখাচ্ছে যে উদ্যোক্তাবৃত্তি এখন শুধুমাত্র অর্থনৈতিক কার্যক্রম নয়, বরং সামাজিক দায়িত্ব, পরিবেশ সংরক্ষণ ও নৈতিক ব্যবসার প্রতিফলন। পরিসংখ্যান ও গবেষণার আলোকে দেখা যায়, গ্লোবাল এন্টারপ্রেনারশিপ মনিটরের তথ্য অনুযায়ী বিশ্বব্যাপী প্রাপ্তবয়স্ক জনগোষ্ঠীর প্রায় ১৪.৫% উদ্যোক্তা কার্যক্রমে জড়িত এবং ইউনিকর্ন স্টার্টআপের সংখ্যা ২০১৩ সালের ৩৯ থেকে ২০২৩ সালে ১,২০০-এর বেশি হয়েছে। এই সমস্ত তথ্য নির্দেশ করে যে উদ্যোক্তা ধারণা ইতিহাস জুড়ে অর্থনীতি ও সমাজের পরিবর্তন ও প্রগতির মূল চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করেছে এবং ভবিষ্যতেও এটি প্রযুক্তি, নৈতিকতা ও সামাজিক অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে মানব সভ্যতার বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

লেখক: গণমাধ্যমকর্মী।