ইলিশের আবাসস্থলে ইলিশ নেই, পরিবেশ বিপর্যয় ও সামুদ্রিক দুর্যোগে কমছে উৎপাদন দাবি গবেষক ও পরিবেশবিদদের

মিলন কর্মকার রাজু, কলাপাড়া : নদী ও সমুদ্রবেষ্টিত পটুয়াখালীর কলাপাড়া। বিস্তীর্ণ বঙ্গোপসাগরে অন্তত ৫০ হাজার জেলে মাছ ধরা পেশায় নিয়োজিত রয়েছে। বছরে অন্তত প্রায় ৩৫ হাজার মেট্রিক টন ইলিশ আহরিত হয় বঙ্গোপসাগর থেকে। সাগরবক্ষ থেকে আহরিত মাছের জেলেরা যাতে ন্যায্য মূল্য পায় এজন্য ২৮ কোটির বেশি টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা হয়েছে আলিপুর ও মহিপুর মৎস্য বন্দর। কিন্তু এ বছর এ বন্দর দুটিতে ইলিশের আমদানি কমে গেছে। এর প্রভাব পড়েছে পাইকারি ও খুচরা বাজারে। ইলিশের ভরা মৌসুম চলছে, কিন্তু বাজার ইলিশের দাম কমছে না। এর কারণ হিসেবে জেলেরা বলছেন, এখন গভীর সাগরে সাত থেকে দশ দিন জাল ফেললেও মাছ পাওয়া যায়না। তাই দাম বেশি।
ইলিশ গবেষক ও পরিবেশবিদরা বলছেন, ইলিশের অভয়াশ্রমগুলো ক্রমশ সংকুচিত হয়ে আসছে। এ কারণে ইলিশের উৎপাদন যেমন কমেছে, তেমনি নির্বিচারে মাছের রেনু পোনা শিকার বাড়ছে। এর প্রভাব পড়ছে ইলিশ অর্থনীতিতে। উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা বলেন, গতবছরের চেয়ে এ বছর গত তিন মাসে অন্তত চার হাজার মেট্রিকটন ইলিশ কম আহরিত হয়েছে। তবে মৌসুম শেষে এ ঘাটতি কিছুটা পুষিয়ে ওঠা সম্ভব হবে বলে তিনি আশা করছেন।
কলাপাড়ার মৎস্য বন্দরসহ বিভিন্ন সাগর ও মদী মোহনা থেকে প্রতিদিন এভাবে ঝুঁকি নিয়ে হাজার হাজার ট্রলার গভীর সমুদ্র যাত্রা করে মাছ শিকারের জন্য। ছোট ডিঙি ট্রলার গুলো সমুদ্রের তিন থেকে ১৫ কিলোমিটারের মধ্যে মাছ শিকার করে। মাঝারি ট্রলারগুলো সমুদ্রের ৫০ থেকে ২০০ কিলোমিটারের মধ্যে মাছ শিকার করে। আর বড় ট্রলারের জেলেরা সমুদ্রের ৩০০ থেকে ৭০০ কিলোমিটার দূরে মাছ শিকার করে। কিন্তু এবছর মৌসুম শুরু হওয়ার পর থেকেই জেলেরা বারবার সমুদ্রে যাচ্ছে আবার প্রাকৃতিক ও সামুদ্রিক দুর্যোগের কারনে ফিরে আসতে বাধ্য হচ্ছে। এর প্রভাব পড়ছে ইলিশসহ সামুদ্রিক মাছের আহরণে।এ কারণে ইলিশের মৌসুম চললেও বাজারে ইলিশের দাম কমছে না। কিন্তু কেন।
উপকূলীয় জেলে ও ট্রলার মালিকরা বলেন, এক দশক আগেও সমুদ্রের তিন থেকে পাঁচ কিলোমিটার গভীরে যত ইলিশ পাওয়া যেতো এখন ৫০০ কিলোমিটার গভীরেও সেই ইলিশ মিলছে না। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সাগরের গতি প্রকৃতি পরিবর্তন হওয়ায় মাছের উৎপাদন কমছে বলে জেলেদের ধারণা।
জেলেরা বলেন, প্রতিবার সমুদ্রে যাত্রা করতে প্রতিটি মাঝারি মানের ট্রলারে দুই থেকে তিন লাখ এবং বড় ট্রলারে অন্তত ৫ লাখ টাকার জ্বালানি, বরফ ও খাদ্য সামগ্রী বাজার করতে হয়। সেই সাথে রয়েছে জেলেদের বেতন।
সাগরে মাছ ধরা পড়লে তা বিক্রি করে খরচ উঠে যাওয়ার পর জেলেরা লভাংশ পায়। আর মাছ কম ধরা পড়লে তীরে এসে তাদের মুখ অন্ধকার হয়ে যায়। কিন্তু এ বছর সমুদ্রগামী জেলেরা বারবার সমুদ্রে গেছে আবার ফিরে আসতে হয়েছে বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও সিগন্যালের কারণে। এ কারণে এ বছর কলাপাড়ার মৎস্য বন্দর গুলোতে মাছের আমদানি গত বছরের চেয়ে অর্ধেক কমে গেছে।
জেলেরা বলছেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগের বাইরেও সমুদ্রে নির্বিচারে মাছের রেণু শিকার, ভিনদেশের জেলেদের অবাদ বিচরণ, অবৈধ ট্রলিং দিয়ে মাছ শিকার এবং নিষিদ্ধ জালের ব্যবহার কমাতে না পারলে ইলিশসহ সামুদ্রিক মাছের উৎপাদন আরো কমতেই থাকবে।
মৎস্য ব্যবসায়ীরা বলেন, বর্তমানের সামুদ্রিক মাছসহ ইলিশের যে আকাল চলছে তাতে মৎস্য বন্দরের ব্যবসায়ীদের পথে বসার উপক্রম হয়েছে। কোটি কোটি টাকা দাদন দিলেও প্রতিদিন পাঁচ থেকে দশ মনের বেশি মাছ পাওয়া যাচ্ছে না। অথচ আগে শত শত মন মাছ আড়তে আসতো। সমুদ্র সম্পদ রক্ষায় সরকার উদ্যোগী না হলে দেশের এই বৃহৎ মৎস্যবন্দর মৎস্য শূন্য হয়ে পড়বে। এজন্য সবার আগে দরকার মৎস্য উৎপাদন ও আহরণের প্রতিবন্ধকতা গুলো দূর করা।
মৎস্য অধিদপ্তরের হিসেবে দেখা গেছে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে আগের বছরের শেষ সাত শতাংশ ইলিশ কম উৎপাদন হয়েছে। দেশের মোট মৎস্য উৎপাদনের প্রায় ১২ শতাংশই আসে ইলিশ প্রজাতি থেকে। এ বছর ইলিশের উৎপাদন কমে যাচ্ছে, যার পেছনে রয়েছে একাধিক প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট কারণ।
বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর এবং নরওয়েজিয়ান মেটিওরোলজিক্যাল ইনস্টিটিউটের একটি যৌথ গবেষণায় দেখা গেছে, দেশের প্রায় সর্বত্র বৃষ্টির পরিমাণ কমে গেছে। আর সেই সঙ্গে বেড়েছে তাপমাত্রা। গবেষণা অনুযায়ী, ১৯০১ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে বাংলাদেশের বার্ষিক গড় তাপমাত্রা প্রায় ২°সেলসিয়াস বৃদ্ধি পেয়েছে। ইলিশের প্রজনন ও বেড়ে ওঠার আদর্শ তাপমাত্রা ২৬ থেকে ২৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তাপমাত্রা বেড়ে গেলে ডিম ফোটার হার কমে যায়। বাচ্চা মাছের মৃত্যুহার বেড়ে যায়।
ওয়ার্টার্স কিপার্স বাংলাদেশ'র গবেষণা ও বাস্তবায়ন প্রধান মো. ইকবাল ফারুক বলেন, ইলিশ সমুদ্র বেড়ে উঠলেও ইলিশের ডিম ছাড়ার উপযুক্ত স্থান নদী। কিন্তু পটুয়াখালীর প্রধান নদী গুলো দূষণ, দখল ও পলিপড়ে ভরাট হয়ে যাচ্ছে। এ কারণে এখন আর নদীতে তেমন ইলিশ ডিম ছাড়ার জন্য আসতে পারেনা। ইলিশের অভয়াশ্রম নষ্ট হয়ে যাওয়ার কারণে দিক পরিবর্তন করে প্রজননকালীন সময়ে ইলিশ পার্শ্ববর্তী দেশ সহ অন্যত্র চলে যাচ্ছে। এ কারণে কমছে ইলিসের উৎপাদন।
বরিশাল বিভাগীয় পরিবেশ ও জনসুরক্ষা ফোরামের আহবায়ক শুভঙ্কর চক্রবর্তী বলেন, কলাপাড়ার আন্ধার মানিক, টিয়াখালী, খাপড়াভাঙ্গা ও রাবনাবাদ নদীর নাব্যতা কমে গেছে। ইলিশের অভয়াশ্রম আন্ধার মানিক নদীতে এখন আর ইলিশ নেই। এর মূল কারণ হচ্ছে পরিবেশ বিপর্যয়। সমুদ্র মোহনা থেকেনদী মোহনা পর্যন্ত খনন করা হলে ইলিশের প্রজননকালীন সময়ে এই নদীতে ইলিশ ধরা পড়তো। তাই ইলিশ সম্পদ রক্ষায় শুধু ৫৮ দিন কিংবা ২২ দিনের মাছ শিকারে নিষেধাজ্ঞা দিলেই কাজ হবে না, সমুদ্র ও নদী দূষণ রোধে কাজ করতে হবে।
ওয়ার্ল্ড ফিসের তথ্য অনুযায়ী ইলিশ উৎপাদনে ১১ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান শীর্ষে। ৮৬ শতাংশ ইলিশ বাংলাদেশের উৎপাদিত হয় ।
মৎস্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থ বছরে দেশে ইলিশ উৎপাদন হয়েছিল ৫ লাখ ৭১ হাজার মেট্রিকটন। অথচ ২০১৩-২৪ অর্থ বছরে ৪২ হাজার টন ইলিশের উৎপাদন কমে গেছে। গত বছর উৎপাদন হয়েছিল ৫ লাখ ২৯ হাজার টন।
এ বিষয়ে কলাপাড়া উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা অপু সাহা বলেন, শুধুমাত্র কলাপাড়ায় গত তিন মাসে গত বছরের চেয়ে ৪ হাজার মেট্রিক টন ইলিশ কম উৎপাদন হয়েছে। সামুদ্রিক অন্যান্য মাছের আহরণও কমেছে। তবে তার ধারণা মৌসুম শেষ হওয়ার আগে ইলিশের এই ঘাটতি থাকবে না।
(এমকেআর/এএস/সেপ্টেম্বর ২০, ২০২৫)