মো: ইমদাদুল হক সোহাগ


শরতের ভোর। শিশিরভেজা ঘাসে হঠাৎ কিছুর জন্য পা থেমে যায়—বাতাসে শীতলতার এক নিঃশ্বাস, আকাশে তুলোর মতো সাদা মেঘ, নদীর ধারে কাশফুলের দোল। যেন প্রকৃতিই পূজার আলপনা এঁকে বসেছে। ঠিক তখনই দূরে ভেসে আসে ঢাকের প্রথম আওয়াজ—“ধুপধুপ…”। সেই তালের সঙ্গে মিশে হৃদয় কেঁপে ওঠে; মনে হয় মা আসছেন, মণ্ডপ জেগে উঠছে, দিনটা পূজার। শৈশবের স্মৃতি তখনই ভেসে ওঠে—মণ্ডপের আলোয় ভেজা রাত, ঢাকের তালে ছুটে বেড়ানো পাড়ার ছেলেমেয়ে, কাশফুলের ঝোপে লুকোচুরি। কখনও কটকটের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে খেলনা কেনা, কখনও আবার হার-জিতের ঠাট্টায় মেতে ওঠা। ঢাকের ছন্দ যেন স্মৃতির হাত ধরেই আমাদের বিকেলের মাঠে নামিয়ে দেয়—ভোরের শিশির থেকে বিকেলের ধুলোয় দৃশ্য বদলালেও সুরটা থাকে একটাই। আর সেই মার্বেলের খেলাটা! বিকেলের আধো আলোয়, বাড়ির দেয়ালে লম্বা ছায়া পড়ছে, মাঠের মাঝখানে কাদা মাটির বৃত্তে সাজানো রঙিন মার্বেল। হাতে ডাংগুলী পিস্তল—একটা হালকা টান দিলেই ‘ক্লিক—শাং’, আর মার্বেলটা ছুটে যায় সামনে। “দেখ, একেবারে লাইনে পড়েছে!”—কেউ চেঁচিয়ে উঠলে হাসি-ঠাট্টায় ভরে ওঠে মাঠ। গীতা তখন খেলায় নামত; শান্ত হলেও চোখে একগুঁয়ে দীপ্তি। প্রথমে এগোলেও হঠাৎ তার মার্বেলটা পাশের কুঁড়েতে গড়িয়ে যায়—“ক্লাং!” সঙ্গে সঙ্গে সবাই মিলে চিৎকার—“ওই গীতা, হেরে গেলি!” গীতা মাথা নিচু করে হেসে ফেলে; রাগ নেই, বরং লাজুক এক ঝিলিক। “আবার খেলবি তো?”—কেউ ঠাট্টা করে জিজ্ঞেস করলে সে উত্তর দেয় চোখে আলো নিয়ে: “পরেরবার আমার পালা বড় জিতব!” এমন ছোটখাটো হার-জিত, ঠাট্টা ও রোলাই মিলেই গড়ে উঠত পূজার আসল সুর—যেখানে বন্ধুত্বের বাঁধন ছিল ঢাকের তালের মতোই দৃঢ়। এপার বাংলা আর ওপার বাংলা—দুই বাংলার প্রতিটি হৃদয়ে একই ঢাক বাজে শরতের ভোরে। কলকাতার আলো ঝলমলে মণ্ডপ হোক বা ঢাকার বনানীর প্রতিমা—সবখানেই বাঙালির প্রাণে জেগে ওঠে একই সুর: পূজা মানেই মিলন, পূজা মানেই শিকড়ে ফেরা।

মেলার আবহ: নাগরদোলা, জিলাপি, কটকটের দোকান

তখন পূজা মানে ছিল কেবল প্রতিমা দেখা নয়—ছিল গ্রামের প্রাণের মেলা। মাঠজুড়ে নাগরদোলা ঘোরে, কটকটের দোকানে ভিড় জমে, বাতাস ভরে যায় জিলাপির মিষ্টি গন্ধে। শিশুরা লাটিম ঘোরায়, মার্বেল খেলে, মায়েরা একে অপরের হাতে মেহেদি আঁকেন—সবাই মিলে উৎসবে ভেজে ওঠে আঙিনা। হকারদের টানা গলায় ভেসে আসে—“কটকটে খেলনা, বাঁশি, পিস্তল!”—আর মেহেদির শিঞ্জি থেকে ঝরে পড়ে নকশা। গন্ধে–শব্দে–রঙে মেলায় ইন্দ্রিয়গুলো একসাথে জেগে ওঠে।

সম্প্রীতির পূজা: ধর্ম-বর্ণের বাঁধন ছাপিয়ে

ধর্ম-বর্ণের কোনো বিভাজন ছিল না। হিন্দু বন্ধু মুসলিম বন্ধুর হাত ধরে একসাথে ঢাকের তালে নাচত, কেউবা মেলায় ঘুড়ি উড়াত। পূজা হয়ে উঠত সেই একমাত্র উৎসব যেখানে সবাই একই আঙিনায় মিলিত হত। মেলার ভিড়ের মাঝেই বোঝা যায়—উৎসব মানে সঙ্গ, ধর্ম মানে আস্থা; আর দুটোর মিলেই তৈরি হয় সংহতি। আজও সেই আবহ টিকে আছে। দেশের কোনো প্রান্তে পূজার নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা দেখা দিলে মুসলিম ধর্মীয় নেতারাই এগিয়ে আসেন পাহারায়। তাঁরা বলেন: “তোমরা নির্ভয়ে পূজা করো; আমরাই আছি।” কখনও তাঁরা গীতার শ্লোক উচ্চারণ করেন, কখনও পাহারায় দাঁড়ান সারারাত। এই দৃশ্য প্রমাণ করে—মানবতার উৎসব কোনো ধর্মের দেয়ালে আটকে থাকে না। ওপার বাংলার পূজায় যেমন মুসলিম স্বেচ্ছাসেবীরা দায়িত্ব নেন, তেমনি এপার বাংলার ঈদে হিন্দু বন্ধুরা আনন্দ ভাগ করে নেন। নজরুলের সেই অমর বাণী আজও সত্য—“গাহি সাম্যের গান, যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা-অবস্থান।”

ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার

দুর্গাপূজা বাংলার ইতিহাসের প্রাণ। এর ভেতরে আছে সমাজের পরিবর্তন, মানুষের ঐক্য আর যুগযুগান্তরের স্মৃতি। জমিদারি যুগে পূজা ছিল ঐশ্বর্যের প্রতীক। জমিদারবাড়ির আঙিনায় বিশাল আয়োজন হলেও আনন্দ ভাগাভাগি করত গ্রামের সাধারণ মানুষও। ১৭৯০-এর দশকে কলকাতায় প্রথম শুরু হয় বারোয়ারি পূজা—জমিদারের নয়, পাড়ার মানুষ মিলে। এখান থেকেই জন্ম নেয় সর্বজনীন দুর্গোৎসবের ধারা। স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় পূজামণ্ডপ হয়ে ওঠে সাংস্কৃতিক প্রতিরোধের কেন্দ্র। নাটক, গান, কবিতার ভেতর দিয়ে সেখানে জেগে উঠত জাতীয়তাবোধ। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় অনেক পূজা মণ্ডপ হয়ে উঠেছিল মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয়কেন্দ্র। কেউ সেখানে খাবার পেত, কেউ সাহস পেত, আবার কারও জন্য সেটি ছিল নিরাপদ আশ্রয়। এই ধারাবাহিকতার কারণেই পূজা জমিদারের আঙিনা পেরিয়ে পাড়ার হৃদয়ে এসে ঠেকেছে—সবার, সর্বজনের হয়ে উঠেছে। আজ যখন পৃথিবীজুড়ে বিভাজনের রাজনীতি মাথা তোলে, তখন বাংলার পূজামণ্ডপ থেকে যে সুর ওঠে তা হলো: ঐক্যই সত্য, বিভেদ কৃত্রিম।

আগামীর পূজা: প্রযুক্তির আলোয় উৎসব

চোখ বন্ধ করে কল্পনা করুন ২০৭০ সালের পূজা। প্রবাসে থাকা ছেলে তার হলোগ্রাফিক অবতার নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মায়ের পাশে। মা আরতি করছেন, চোখের কোণে চিকচিক করছে অশ্রু—মনে হচ্ছে, ছেলে সত্যিই পাশে আছে। আকাশে হাজার ড্রোনের আলোয় ফুটে উঠছে মহিষাসুর বধের দৃশ্য। নিচে ভিড় জমেছে, কিন্তু সেই ভিড় শুধু কলকাতার নয়—ঢাকা, লন্ডন, নিউইয়র্কের মানুষও একইসাথে যুক্ত আছে গ্লোবাল ভার্চুয়াল মণ্ডপে। অগমেন্টেড রিয়ালিটি চশমা চোখে দিলেই প্রতিমার চোখে প্রাণ জেগে উঠছে। দেবীর ত্রিশূল থেকে আলো ঝলসে বেরোচ্ছে, যেন সত্যিই অশুভ শক্তির বিনাশ হচ্ছে। মায়ের হাতের নাড়ুর স্বাদ পৌঁছে যাচ্ছে দূরে থাকা সন্তানের কাছে সেন্সরি টেকনোলজি দিয়ে। স্পেস স্টেশনে থাকা বাঙালি নভোচারীও শুনছেন ঢাকের কম্পন। তাই ‘প্রযুক্তির আলোয় উৎসব’ মানে ঐতিহ্যকে ঢাকা নয়—ঐতিহ্যকে দৃশ্যত, শ্রুতিতে, গন্ধে–স্পর্শে আরও কাছে আনা। ভবিষ্যতের পূজা হবে প্রযুক্তি আর আবেগের মিলনক্ষেত্র—যেখানে ঐতিহ্য মুছে যাবে না, বরং হয়ে উঠবে আরও জীবন্ত ও রঙিন।

তরুণ প্রজন্ম: নবরূপের স্থপতি

আগামী দিনের পূজার মুখ হয়ে উঠবে তরুণ প্রজন্ম। তাঁদের কাছে পূজা মানে শুধু মণ্ডপের আলো নয়, বরং সমাজ গড়ার দায়িত্ব। তাঁদের হাতে আলোকসজ্জার তার যেমন জ্বলে, তেমনি জ্বলে ওঠে দায়বদ্ধতার আলোরেখা। রক্তদান শিবিরে দেওয়া প্রতিটি ফোঁটা রক্ত হবে দেবীর পায়ে অঞ্জলি; দুঃস্থকে বস্ত্রদান হবে পূজার পুষ্পাঞ্জলি; হাসপাতালের অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেন হবে ঘণ্টাধ্বনির মতোই পবিত্র। তরুণেরা মণ্ডপ সাজাবে আলো দিয়ে, আবার একইসাথে শিক্ষার আলো পৌঁছে দেবে দরিদ্র শিশুর কাছে। প্রতিমার সামনে প্রদীপ জ্বালাবে, আবার অন্ধকার ঘরে আলো জ্বালাতে এগিয়ে আসবে। ভবিষ্যতের পূজায় আমরা দেখব—বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা যেমন অঞ্জলি দিচ্ছে, তেমনি রক্তদান শিবিরেও লাইন দিচ্ছে। তরুণ উদ্যোক্তারা যেমন মণ্ডপে আলোকসজ্জা করছে, তেমনি শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিচ্ছে গ্রামের স্কুলে। কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগে মানুষ গৃহহীন হলে, পূজার বাজেটের একটি অংশ তরুণেরা ব্যয় করছে ত্রাণে। আগামী দিনের পূজা হবে কর্মযজ্ঞের পূজা। নজরুলের ভাষায়—“তোমরা ভোরের পাখি, উঠরে জেগে উঠরে।”

পূজার কবিতা: সেবার আরাধনা

ভবিষ্যতের কোনো কবি হয়তো এই নতুন পূজার প্রতিচ্ছবিই আঁকবেন—
“ভাঙবে প্রাচীর, পুরোহিতের উঠবে না আর স্বর,
কোটি প্রাণের প্রদীপ জ্বেলে সাজবে মায়ের ঘর।
মানুষেরই মাঝে সেদিন দেবতা পাবে প্রাণ,
সেবার অঞ্জলি দিয়েই হবে পূজার আহ্বান।”
দেবতা তখন মূর্তিতে নয়—মানুষের কাজে, মানুষের কণ্ঠে। এটাই হবে আগামীর পূজার মন্ত্র: মানুষের মাঝে ঈশ্বর, সেবার ভেতরেই দেবতা।

ঐক্যের মহামঞ্চ

আগামী দিনের দুর্গাপূজা আর কেবল দেবী আরাধনা নয়। এটি হবে মানুষের মিলনক্ষেত্র, হৃদয়ের বিনিময়ের প্রাঙ্গণ, সংস্কৃতির প্রদর্শনী এবং প্রযুক্তির বিস্ময়ের এক মহামঞ্চ। হয়তো একদিন ইতিহাস লিখবে—“দুর্গাপূজা শুধু দেবী আরাধনার উৎসব ছিল না; এটি ছিল মানুষের উৎসব, যেখানে ভিন্নতার গভীরেও মানুষ খুঁজে পেয়েছিল একতার আলো।” এই উৎসব কেবল হিন্দুদের আনন্দে সীমাবদ্ধ নয়। এখানে মুসলিম পাহারায় দাঁড়ায়, বৌদ্ধ বন্ধু আসে প্রদীপ জ্বালাতে, খ্রিস্টান তরুণেরা মণ্ডপ সাজাতে যোগ দেয়। দুই বাংলার পথ আলাদা হলেও উৎসবের সুর একই—ঢাকের তালে তাল মেলায় দু’ পারে দু’টি হৃদয়। দুর্গাপূজা তাই বাংলার সর্বজনীন উৎসব—মানুষের উৎসব। এপার বাংলার মাঠে যেমন ঢাক বাজে, ওপার বাংলার শহরেও একই সুর বাজে। কলকাতার আলো ঝলমলে মণ্ডপ আর ঢাকার বনানীর প্রতিমা—দুটোই আসলে এক স্রোতের রূপ। পূজা তাই দুই বাংলাকে বাঁধে এক অদৃশ্য সেতুতে, যেখানে মানুষ খুঁজে পায় মিলনের আলো, ঐক্যের উৎসব।

লেখক: উদ্যোক্তা, কলাম লেখক ও ভূ-রাজনৈতিক বিশ্লেষক।