আর কয়টি মাজার ভাঙা হলে টনক নড়বে

মারুফ হাসান ভূঞা
ধর্মকে পুঁজি করে গড়ে ওঠা দল বা গোষ্ঠী। যারা ধর্মকে তরবারির ঝনঝনানি, উগ্রতা, সন্ত্রাস ও বিভাজনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতা গ্রহণের কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়ার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছে সে-সব দল, গোষ্ঠী দেশে ভয়াবহ অরাজকতা তৈরি করে চলছে। একের পর এক ধর্মীয় সহিংসতা সৃষ্টিতে লিপ্ত হয়ে পড়েছে। তারই অংশ হিসেবে ইসলাম ধর্মের বৃহৎ অংশের অনুসারীদের তীর্থস্থান মাজারগুলো ধারাবাহিকভাবে ভেঙে ফেলছে উগ্রপন্থী এসব ইসলামী সংগঠন বা দল। বাংলাদেশে ইসলামি দলগুলোর ভোটের অপরাজনীতি, ধর্মের দোহাই দিয়ে সহিংসতা ও উগ্রবাদী চর্চার বিরুদ্ধে মাজারের অনুসারীরা প্রতিরোধের ভূমিকায় অবস্থান গ্রহণ করেছে বহুবার। যার ফলে সে আতঙ্কের ভয়ে গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে মাজার ভেঙে দেওয়ার প্রজেক্ট নিয়ে হাজির হয়েছে উগ্রপন্থী ইসলামি দলগুলো। কোথাও নির্দিষ্ট দলের নামে, কোথাও তৌহিদী জনতা কিংবা ঐক্যবদ্ধ আলেম সমাজ নামে দেশের প্রায় ৮০ শতাংশ জায়গায় মাজার ভাঙা হয়েছে। এখনো সে ধারাবাহিকতা অব্যাহত রয়েছে। উগ্রবাদী এই গোষ্ঠীগুলো কি আদৌ জানে ইসলাম ধর্মের বিস্তার ও প্রচারে বাংলাদেশে এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্য দিয়েই হয়েছে? নাকি উগ্রতায় ওদের ধর্ম? নাকি সব কিছুর আড়ালে ক্ষমতা?
মানুষের হৃদয়ে আল্লাহ ও রাসুলের প্রতি প্রেম জাগিয়ে ইসলামের সর্বজনীন বার্তাকে বছরের পর বছর এদেশের মানুষের নিকট পৌঁছে দিয়েছিল আউলিয়াদের দরগাহ-মাজার। মাজারের মধ্য দিয়ে এদেশের মানুষ মানবতা, মনুষ্যত্ব অর্জনের পথে অগ্রগামী হতে শুরু করে। বৈষম্যহীন সমাজ বিনির্মাণে স্ফুলিঙ্গের মতো আবির্ভূত হয় মাজার। মাজার থেকেই সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, প্রতিরোধের আওয়াজ তোলা হতো। সব জাত, ধর্ম, বর্ণের মানুষকে একীভূত করে, মানুষের মাঝে মানবতা চর্চাই যে মহান ইবাদত সেটিকে রীতিমতো মানুষের প্রাণে সঞ্চিত করে দিয়েছিল মাজার। বাংলাদেশে মাজারের মধ্য দিয়ে ধর্মের দাওয়াত সীমাহীনভাবে প্রচার ও বিস্তার হয়।
সমাজে মানবপ্রেম, শান্তি ও সমতার শিক্ষা নিয়ে মধ্যযুগে আরব, পারস্য, ইয়েমেন, মধ্য এশিয়া থেকে বাংলায় আসেন হজরত শাহ জালাল ইয়েমেনি, হজরত শাহ পরান, শাহ মখদুম রূপোশ, শাহ মুহাম্মদ গরীবুল্লাহ। বাংলার মানুষকে নতুন এক সংস্কৃতি ও ধর্মের সাথে পরিচয় করান। মানুষও সে সংস্কৃতি ও ধর্মকে আপন মনে গ্রহণ করে স্রষ্টাকে আবিষ্কার করেন। মাজারের সাফা মাহফিল, ওরশ, লোকসংগীত, বাউল-সুফি, মুর্শিদি, মারফতি, জারি, শরিয়তি ও হামদ-নাত-গজলে মানুষ স্রষ্টার পক্ষ থেকে খুঁজে পেত মানুষের জন্য মানুষের সমাজ গড়ে তোলবার আহ্বান। বাংলাদেশে জনসংখ্যার বৃহৎ অংশ ইসলামকে খুঁজে পেয়েছিল এ মাজার, মাজারের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে। হাসন রাজা, লালন ফকির, দৌলত শাহ, গরীবুল্লাহ, রাধারমণ দত্ত, হযরত খাজা মইনুদ্দিন চিশতি, নিজামুদ্দিন আউলিয়াদের গানে মানুষ সীমাহীনভাবে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে।
অথচ রীতিমতো উগ্রপন্থী এসব গোষ্ঠী ধর্মের নামে উগ্রতা, সহিংসতা ও তরবারির ঝনঝনানিতে এসব প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করছে।গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে সারা দেশে এখন পর্যন্ত প্রায় ৪৪টি মাজারে হামলার ঘটনা ঘটেছে, এবং এই হামলা সংগঠিত করতে গিয়ে এই উগ্রবাদী গোষ্ঠীরা বীভৎস সব কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেছে। সন্ত্রাসী কায়দায় ঘোষণা দিয়ে হামলা, মাজারের ভক্ত ও মাজার পরিচালকদের হত্যার উদ্দেশ্যে হামলার ফাঁদ এঁকে আক্রমণ সংগঠিত করেছে। কোথাও কোথাও আগুন দিয়ে সম্পূর্ণ জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। রাজবাড়ী জেলার গোয়ালন্দঘাটে নুরুল হক ওরফে নুরাল পাগলার দরবারে আক্রমণ করে নুরাল পাগলার দেহ কবর থেকে উঠিয়ে বীভৎসভাবে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। কেবল জ্বালিয়ে দিয়ে ক্ষান্ত হয়নি, দেশীয় অস্ত্র শস্ত্র মহড়া দিয়ে বেড়িয়েছে। ঘটনাস্থলের মাজারের এক ভক্তকে নৃশংসভাবে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। সর্বশেষ ১৮ই সেপ্টেম্বর ২০২৫ বৃহস্পতিবার সকাল ১০টা থেকে বেলা ১১টার মধ্যে কুমিল্লা উপজেলার আসাদপুর ইউনিয়নে আসাদপুর গ্রামের আলেক শাহের বাড়িতে অবস্থিত তাঁর বাবা কফিল উদ্দিন শাহের মাজার, একই গ্রামের আবদু শাহের মাজার, কালাই (কানু) শাহের মাজার এবং হাওয়ালি শাহের মাজারে হাওয়া বেগম নামে এক নারী ‘হাওয়ালি শাহ’ মাজারে হামলা ও আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেওয়ার ঘটনা ঘটায়। এই হামলায়ও নেতৃত্ব দেয় উগ্রপন্থী ইসলামি দলের ক্যাডাররা।
দেশের প্রশাসন নীরব ভূমিকা পালন করছে, এসব হামলার অধিকাংশ ঘটনা ঘটেছে পুলিশ ও সেনাবাহিনীর নাকের ডগায়। এবং এমনও কিছু ঘটনা রয়েছে, হামলা-সহিংসতায় মৌন সমর্থন যুগিয়েছে প্রশাসন। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারও এসব হামলা, সহিংসতার বিরুদ্ধে কঠোরভাবে দমনের বিপরীতে নিশ্চুপ থাকার চেষ্টাই করছে। ঘটনার পর এক টুকরো প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে সীমাবদ্ধ হয়ে আছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এখনো কোনো মাজারের হামলার দৃশ্যমান বিচার লক্ষ করা যায়নি। কোথাও কোথাও আসামিদের গ্রেফতারও করা হয়নি। বরং আসামিদের রক্ষার জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নানা কৌশল অবলম্বন করছে। মাজারের অনুসারীদের প্রতিনিয়ত আসামিরা ভয়, ভীতি, হত্যার হুমকি দিয়ে যাচ্ছে। যার ফলে মাজারের মতো ঐতিহ্যবাহী গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ধারাবাহিকভাবে এখনো ভাঙা হচ্ছে, দেশের বাকি বিভিন্ন জায়গায় মব তৈরি করে মাজার ভাঙার প্রচেষ্টা চলছে। পাশাপাশি এর সাথে যুক্ত অনুসারীরা একদিকে উগ্রবাদীদের আক্রমণ, আক্রমণের আতঙ্ক অন্যদিকে বিশাল ক্ষয়ক্ষতির বোঝা নিয়ে মানবতার জীবন অতিবাহিত করছে। রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা একেবারেই নেই বললে চলে। তবে কি মাজার ভাঙায় রাষ্ট্র মদদ কিংবা প্রলুব্ধ করছে?
লেখক : লেখক ও প্রাবন্ধিক।