গ্রেপ্তারের ২৪ ঘণ্টা পার না হতেই শ্বশুর-জামাইয়ের জামিন
জামিনের তিন ঘণ্টা পর আদালতে এলো জব্দ তালিকা ও রিমান্ড আবেদন

রঘুনাথ খাঁ, সাতক্ষীরা : সৌদি প্রবাসী বেলাল হোসেনের ১৯ লাখ টাকার প্রতারণা ও আত্মসাতের মামলায় গ্রেপ্তারের ২৪ ঘণ্টা পার না হতেই জামিন পেয়েছেন সাতক্ষীরার কালিগঞ্জ উপজেলার ইন্দ্রনগর গ্রামের বহুল আলোচিত শ্বশুর ও জামাই। আজ রবিবার সাতক্ষীরার জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম প্রথম আদালতের বিচারক নয়ন বিশ্বাস উভয়পক্ষের শুনানী শেষে তাদের প্রত্যেককে ৫০০ টাকা বণ্ডে পুলিশ প্রতিবেদন না আসা পর্যন্ত জামিন মঞ্জুর করেন।
জামিনপ্রাপ্ত আসামিরা হলেন, সাতক্ষীরার কালিগঞ্জ উপজেলার ইন্দ্রনগর গ্রামের লোকমান মোড়লের ছেলে ছিদ্দিক মোড়ল (৫৩) ও তার জামাতা একই গ্রামের মোবারেক আলী শেখের ছেলে হাবিবুল্লাহ ওরফে মিঠু (৩৭)।
অভিযোগ, গ্রেপ্তারকৃত জামাই ও শ্বশুরের কাছ থেকে সৌদি প্রবাসী বেলাল হোসেনের খোয়া যাওয়া কিছু মালামাল উদ্ধার হলেও শনিবার আসামী আদালতে পাঠানোর সময় জব্দ তালিকা ও রিমাণ্ড আবেদন না পাঠানোয় আসামীদের জামিনে সহায়ক ভূমিকা রেখেছে। এ ছাড়া আসামীদের শুক্রবার রাত সাড়ে ১১টার দিকে নলতার প্রভাবশালী আরিজুল ইসলামের অফিস থেকে গ্রেপ্তার করা হলেও মামলার ফরোয়ার্ডিং এ শনিবার সকাল সাড়ে ৬টার দিকে ছিদ্দিক মোড়লের বাড়ি থেকে তাদেরকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে।
সাতক্ষীরার জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম প্রথম আদালত সূত্রে জানা গেছে, সৌদি প্রবাসী বরিশাল জেলার বাবুগঞ্জ উপজেলার বাহেরচর গ্রামের আবুল বাশার চুন্নুর ছেলে বেলাল হোসেনের সোনার গহনা ও কসমেটিকস সামগ্রীসহ ১৯ লাখ টাকার মালামাল প্রতারণার মাধ্যমে আত্মসাতের ঘটনায় শনিবার তিনি বাদি হয়ে সাতক্ষীরার কালিগঞ্জ উপজেলার তারালী ইউনিয়নের নওয়াপাড়া গ্রামের সারাকাত আলীর ছেলে আল মামুন হোসেন(৩১), ইন্দ্রনগর গ্রামের লোকমান মোড়লের ছেলে ছিদ্দিক মোড়ল (৫৩) ও তার জামাতা একই গ্রামের মোবারেক আলী শেখের ছেলে হাবিবুল্লাহ ওরফে মিঠরু (৩৭) নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাতনামা ৩/৪ জনের নামে মামলা দায়ের করেন।
পুলিশ আত্মসাতকৃত মালামালের আংশিক ছিদ্দিক মোড়ল ও হাবিবুল্লাহ ওরফে মিঠুর কাছ থেকে উদ্ধার দেখিয়ে শনিবার সকাল সাড়ে ৬টায় ওই দুই আসামীকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে বিকেলে আদালতের মাধ্যমে জেল হাজতে পাঠানো হয়। আসামীদের আদালতে পাঠানোর সময় এজাহারের কপি ও ফরোয়াডিং এর কপি পাঠানো হলেও পাঠানো হয়নি জব্দ তালিকা ও সাত দিনের রিমাণ্ড আবেদন। রবিবার দুপুর পৌনে ১২টার দিকে আসামীদের পক্ষের আইনজীবী অ্যাড. শফিউর রহমান শফি শুনানী করেন। রাষ্ট্রপক্ষে শুনানী করেন আদালতের পুলিশ উপপরিদর্শক হায়দার আলী। শুনানী শেষে দুই আসামির প্রত্যেককে ৫০০ টাকা বণ্ডে পুলিশ প্রতিবেদন না আসা পর্যন্ত জামিন মঞ্জুর করা হয়। বিকেল তিনটার দিকে মামলার তদন্তকারি কর্মকর্তা কালিগঞ্জ থানার উপপরিদর্শক কামাল হোসেন সাক্ষরিত জব্দ তালিকা ও সাত দিনের রিমাণ্ড আবেদন আদালতে পৌঁছায়।
সৌদি প্রবাসী বরিশাল জেলার বাবুগঞ্জ উপজেলার বাহেরচর গ্রামের আবুল বাশার চুন্নুর ছেলে বেলাল হোসেন আসামীদের জামিন মঞ্জুর হওয়ার খবর পাওয়ার খবর শোনার পর এ প্রতিবেদককে বলেন, ১৯ সেপ্টেম্বর রাত ১০টায় তিনি সাদা পোশাকে পুলিশ নিয়ে আসামী ছিদ্দিক মোড়লের বাড়িতে যান। এ সময় সেখানে প্রধান আসামী আল মামুন, ছিদ্দিক মোড়ল, তার জামাতা মিঠু, উত্তর নলতা ঘোড়াপোতার হুকুম আলী ঘটকের ছেলে জাকির হোসেন, ইন্দ্রনগরের কোটিপতি জহুরের ছেলে হত্যাসহ কমপক্ষে হাফ ডজন মামলার আসামী শাহীনুর রহমানসহ কয়েকজন উপস্থিত ছিলো। তার বেলাল) উপস্থিতি টের পেয়েই আল মামুন কৌশলে পালিয়ে যায়। এ সময় তাকে হত্যার হুমকি দেওয়া হয়। এরপর স্থানীয় আরিজুল ইসলামের অফিসে তাকে, সাদা পোশাকে পুলিশসহ ছিদ্দিক, মিঠু, শাহীনুর ও জাকিরকে ডেকে আনা হয়। সেখানে কিছু মালামাল নিয়ে মীমাংসার প্রস্তাব দেওয়া হয়। তিনি রাজী না হওয়ায় সেখান থেকে জাকির ও শাহীনুর চলে যায়। পরে সাদা পোশাকে থাকা পুলিশ জানতে পেরে ছিদ্দিক ও মিঠুকে দুটি লাগেজে থাকা কিছু কসমেটিকস সামগ্রী ও দুটি কম্বলসহ থানায় নিয়ে আসা হয়।
জিজ্ঞাসাবাদে মিঠু জানায় যে, বাদির আত্মসাৎকৃত ১০৮ গ্রাম সোনার গহনা তারা সাতক্ষীরা শহরের আলা মার্কেটের স্বত্বাধিকারী এসডি জুয়েলার্সের মালিক সুবীর দাস পল্টুর কাছে বিক্রি করেছেন। মামলা লেখার পর গ্রেপ্তারের স্থল চেয়ারম্যানের অফিস না দেখিয়ে ছিদ্দিক মোড়লের বাড়ি ও সময় শুক্রবার রাত সাড়ে ১১টার না দেখিয়ে শনিবার সকাল সাড়ে ৬টায় উল্লেখ করায় তিনি আপত্তি করেন। এতে উপপরিদর্শক কামাল ক্ষুব্ধ হয়ে মালামাল উদ্ধারের সুবিধার্থে এজাহারে সাক্ষর করতে বলেন। তবে ছিদ্দিক মোড়ল ও মিঠুর জিম্মায় থাকা কিছু মালামাল উদ্ধার হলেও জব্দ তালিকা না করা বা তাকে ফেরৎ দেওয়া হয়নি। এমনকি জুয়েলারী প্রতিষ্ঠান এসডি এর মালিক সুবীর দাস পল্টুকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা করেননি। এ ঘটনায় পুলিশের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ।
এ ব্যাপারে এসডি জুয়েলার্সের মালিক সুবীর দাস পল্টুর সঙ্গে তার ০১৭৪০-৫৯৬৩৬১ নং মুঠোফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলে তা বন্ধ পাওয়া যায়।
সাতক্ষীরা জজ কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী অ্যাড. মোসলেমউদ্দিন জানান, আসামীদের কাছ থেকে মালামাল উদ্ধার হওয়ার পর তার জব্দ তালিকা না থাকায় আসামীদের জামিনের সহায়ক ভূমিকা রেখেছে। তাছাড়া বর্তমানে অধিকাংশ ক্ষেত্রে আসামীদের রিমাা- আবেদন মামলার সাথে পাঠানো হয়ে থাকে। এছাড়া আসামি ছিদ্দিক মোড়লের বিরুদ্ধে শামনগর ও কালিগঞ্জে এ সময় মামলা হলেও আসামীদের পিসিপিআর ফরোয়ার্ডিং এ উল্লেখ নেই। এ মামলায় জব্দ তালিকা ও রিমাণ্ড প্রতিবেদন এক দিন পরে পাঠানোয় তা আদালতে আসার তিন ঘণ্টা আগে আসামীদের জামিন হয়ে গেলে কিছু করার নেই। এ ব্যর্থতা মামলার তদন্তকারি কর্মকতার।
তবে প্রভাবশালী আজিজুর রমানের অফিস থেকে ছিদ্দিক মোড়ল ও মিঠুকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছিল কিনা তার সত্যতা জানা সম্ভব হয়নি ওই জনপ্রতিনিধির কাছে।
সাতক্ষীরার জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম প্রথম আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে জামিন শুনানীতে অংশ নেওয়া পুলিশের উপপরিদর্শক হায়দার আলী জানান, ৫০০ টাকা ব-ে প্রত্যেককে পুলিশ প্রতিবেদন না আসা পর্যন্ত জামিন দেওয়া হয়েছে। আসামীপক্ষের আইনজীবী ছিলেন অ্যাড. শফিউর রহমান শফি। আসামীদের সাত দিনের রিমা- আবেদন ও জব্দ তালিকা রবিবার বিকেল তিনটায় তাদের অফিসে পৌঁছায়।
মামলার তদন্তকারি কর্মকর্তা কালিগঞ্জ থানার উপপরিদর্শক কামাল হোসেন জানান, শুক্রবার সাতক্ষীরাে বিনেরপোতায় পাওয়ার গ্রীডে আগুন লাগায় বিদ্যুৎ না থাকায় জব্দ তালিকা ও রিমাণ্ড প্রতিবেদন রবিবার পাঠানো হয়েছে। তবে আসামীদের গ্রেপ্তারের স্থান, সময় ভিন্ন উল্লেখ করে আদালতে আসামীদের ফরোয়াডিং দেওয়া ও আত্মসাৎকৃত সোনার গহনা বিক্রি করা এসডি জুয়েলার্সের মালিক সুবীর দাস পল্টুকে গ্রেপ্তার করার উদ্যোগ না নেওয়ার বিষয়টি নিয়ে তিনি কোন মন্তব্য করতে চাননি।
কালিগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোঃ মিজানুর রহমান জানান, আসামি আদালতে পাঠানোর সময় জব্দ তালিকা না পাঠানোর বিষয়টি তিনি জানতেন না। বিষয়টি নিয়ে তিনি তদন্তকারি কর্মকর্তার সাথে কথা বলবেন।
প্রসঙ্গত, সৌদি আরবের রিয়াদে একই মালিকের প্রতিষ্ঠানে কাজ করার সুবাদে বরিশাল জেলার বাবুগঞ্জ উপজেলার বাহেরচর গ্রামের আবুল বাশার চুন্নুর ছেলে বেলাল হোসেনের সঙ্গে সাতক্ষীরার কালিগঞ্জ উপজেলার নওয়াপাড়া গ্রামের আল মামুনের সখ্যতা গড়ে ওঠে। সেই সুবাদে গত ৩১ আগষ্ট সৌদি থেকে বাংলাদেশে ফেরার সময় বেলাল হোসেন দুটি ট্রলি ব্যাগে করে তিন লাখ টাকার কসমেটিকস গুডস ও ১৬ লাখ টাকা মূল্যের ১০৮ গ্রাম ওজনের ৫টি সোনার চুরি, একটি আংটি ও একটি নেকলেস যার বাজার মূল্য ১৬ লাখ টাকা আল মামুনের হাতে তুলে দেন বাড়িতে পৌঁছে দেবার জন্য। আল আমিন ওই ১৯ লাখ টাকার মালামাল বেলাল হোসেনের বাড়িতে না পাঠিয়ে আত্মসাৎ করে। ঢাকার শাহজাজালাল বিমান বন্দর থেকে ওই লাগেজ নিয়ে আসে ছিদ্দিক মোড়ল, তার জামাতা মিঠু, জাকির হোসেন ও শাহীনুর রহমান।
(আরকে/এসপি/সেপ্টেম্বর ২১, ২০২৫)