শহরকে নিঃশ্বাস দিন, পরিবেশ বান্ধব জীবন বাঁচান

ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ
২২ সেপ্টেম্বর বিশ্বব্যাপী পালিত হয় বিশ্ব ব্যক্তিগত গাড়িমুক্ত দিবস (World Car Free Day)। আধুনিক নগর সভ্যতায় পরিবহন মানুষের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। তবে ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা ক্রমাগত বৃদ্ধি, যানজট, বায়ুদূষণ, জ্বালানি অপচয় এবং মানসিক চাপ বৃদ্ধির প্রধান কারণ হয়ে উঠেছে।
শহরে প্রতিদিন কোটি কোটি মানুষ রাস্তায় আটকে থাকে, ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় নষ্ট হয়। হর্নের শব্দ, ধোঁয়া ও যানজট মানুষের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য ক্ষতিগ্রস্ত করে। বিশেষ করে ঢাকার মতো শহরে, যেখানে প্রতিটি ছোট রাস্তা ব্যক্তিগত গাড়ি ও মোটরসাইকেলের কারণে প্রায় অচল হয়ে যায়।
দিবসটির মূল লক্ষ্য হলো—মানুষকে ব্যক্তিগত গাড়ির উপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে গণপরিবহন, হাঁটা, সাইকেল বা পরিবেশবান্ধব যানবাহনের দিকে আকৃষ্ট করা। এটি কেবল প্রতীকী নয়; বরং টেকসই উন্নয়ন, পরিবেশ রক্ষা এবং স্বাস্থ্য সচেতনতার একটি বিশ্বব্যাপী আন্দোলন।
এছাড়াও, ব্যক্তিগত গাড়ির উপর অতিরিক্ত নির্ভরতা শুধু পরিবেশ নয়, সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনকেও প্রভাবিত করে। শহরের পথচারী, শিশু ও বৃদ্ধসহ সকল জনগণ যানজটের কারণে মানসিক ও শারীরিক চাপের মধ্যে পড়ে। তাই এই দিবস আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, নগর জীবনে স্থায়িত্ব ও সুস্থতার জন্য পরিবর্তন অত্যন্ত জরুরি।
ইতিহাস ও উৎপত্তি
বিশ্ব ব্যক্তিগত গাড়িমুক্ত দিবসের ইতিহাস প্রায় পাঁচ দশক পুরনো। ১৯৭৪ সালে সুইজারল্যান্ডে প্রথমবার পরীক্ষামূলকভাবে গাড়িমুক্ত দিবস পালন করা হয়। মূল উদ্দেশ্য ছিল তেল সংকট মোকাবিলা এবং শহরের পরিবেশগত প্রভাব পর্যবেক্ষণ করা। বিশেষ করে শহরের বায়ু ও শব্দ দূষণ কতটা কমে যায় তা লক্ষ্য করা হয়েছিল।
পরবর্তীতে ফ্রান্স, জার্মানি, স্পেনসহ ইউরোপের অন্যান্য দেশ উদ্যোগ গ্রহণ করে। ১৯৯৪ সাল থেকে ইউরোপের শহরগুলোতে আনুষ্ঠানিকভাবে দিবসটি পালিত হতে শুরু করে। ধীরে ধীরে এ আন্দোলন ইউরোপ ছাড়িয়ে লাতিন আমেরিকা, এশিয়া এবং আফ্রিকার শহরগুলোতেও ছড়িয়ে পড়ে।
বর্তমানে শতাধিক দেশের হাজারো শহরে নানা কর্মসূচির মাধ্যমে দিবস পালিত হয়। কোথাও নির্দিষ্ট রাস্তা বন্ধ রাখা হয়, কোথাও পুরো শহর এক দিনের জন্য গাড়িমুক্ত ঘোষণা করা হয়। এসব উদাহরণ দেখায়, রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকলেই নগর পরিবহন ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনা সম্ভব।
কেন প্রয়োজন গাড়িমুক্ত দিবস?
১. যানজট নিরসন: ঢাকা, দিল্লি, জাকার্তা, মুম্বাইয়ের মতো শহরে প্রতিদিন ঘণ্টার পর ঘণ্টা মানুষ যানজটে আটকে থাকে। ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা বেশি হওয়াই প্রধান কারণ। একেকটি গাড়ি সাধারণত ১–২ জন যাত্রী বহন করে, অথচ এটি বাসের সমান জায়গা দখল করে।
ফলস্বরূপ রাস্তার সক্ষমতা হ্রাস পায়, অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়, এবং মানুষের মূল্যবান সময় নষ্ট হয়। যানজট শুধু সময়ের অপচয় নয়, বরং মানুষের মানসিক চাপ ও দৈনন্দিন জীবনেও প্রভাব ফেলে।
২. বায়ুদূষণ রোধ: তেলচালিত গাড়ি থেকে কার্বন-ডাই-অক্সাইড, নাইট্রোজেন অক্সাইড, কার্বন মনো-অক্সাইডসহ নানা ক্ষতিকর গ্যাস নির্গত হয়। এসব দূষণ পদার্থ মানুষের শ্বাসযন্ত্র, হৃদপিণ্ড ও স্নায়ুতন্ত্রের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানায়, প্রতি বছর প্রায় ৭০ লাখ মানুষ বায়ুদূষণজনিত রোগে মারা যায়। এছাড়া দীর্ঘমেয়াদে ফুসফুস, হার্ট ও অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গের সমস্যাও বেড়ে যায়।
৩. জ্বালানি সাশ্রয়: বিশ্বের জ্বালানি সম্পদ সীমিত। তেলের দাম ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। ব্যক্তিগত গাড়ি কম ব্যবহার করলে জ্বালানি সাশ্রয় হয় এবং জাতীয় অর্থনীতিও লাভবান হয়।
৪. পরিবেশবান্ধব শহর গঠন: গাড়ির সংখ্যা কমলে শুধু বায়ুদূষণ নয়, শব্দদূষণও কমে। শহরে হাঁটা ও সাইকেলবান্ধব অবকাঠামো গড়ে তোলা সহজ হয়। ছায়াযুক্ত ও সবুজ রাস্তায় মানুষ চলাচল করতে উৎসাহিত হয়।
৫. মানসিক স্বস্তি: যানজট, হর্নের শব্দ ও ধোঁয়া মানুষের মানসিক চাপ বাড়ায়। শান্ত, পরিচ্ছন্ন ও সবুজ শহর মানুষের মানসিক স্বস্তি ও কর্মদক্ষতা বৃদ্ধি করে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট
বাংলাদেশ, বিশেষ করে ঢাকা, বিশ্বের অন্যতম যানজটপূর্ণ শহর। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঢাকার যানজটে বছরে প্রায় ৩ বিলিয়ন কর্মঘণ্টা নষ্ট হয়।
বর্তমান পরিসংখ্যান
* মোট নিবন্ধিত যানবাহন: প্রায় ৬৫ লাখ * মোটরসাইকেল: ৫৩% * প্রাইভেট কার ও জিপ: ১৫% * বাস ও মিনিবাস: ৭% * ট্রাক, পিকআপ ও পণ্যবাহী গাড়ি: ১৮% * অন্যান্য (রিকশা-ভ্যান, বিশেষায়িত যান): ৭%
ঢাকায় প্রতিদিন গড়ে ৪০০টির বেশি নতুন গাড়ি রাস্তায় নামছে, যার বড় অংশ ব্যক্তিগত গাড়ি। ফলে যানজট ও বায়ুদূষণ দিনে দিনে বেড়ে চলেছে।
২০২২ সালে ঢাকায় সীমিত পরিসরে গাড়িমুক্ত দিবস পালন করা হয়। নির্দিষ্ট কয়েকটি সড়ক কিছু সময়ের জন্য গাড়িমুক্ত রাখা হলে মানুষ হাঁটা, সাইকেল ও রিকশা ব্যবহার করতে উৎসাহিত হয়। তবে উদ্যোগটি নিয়মিত হয়নি।
ব্যক্তিগত গাড়ির সমস্যা
একটি ব্যক্তিগত গাড়ি সাধারণত ১–২ জন যাত্রী বহন করে, অথচ বাসের সমান জায়গা দখল করে।এতে প্রচুর জ্বালানি অপচয় হয় এবং যানজট বৃদ্ধি পায়। ব্যক্তিগত গাড়ির ধোঁয়া ঢাকার বায়ুদূষণের অন্যতম বড় কারণ। মানুষ গণপরিবহনে উঠতে অনাগ্রহী হয়, ফলে বাস সার্ভিস টেকসই হয় না। শিশু, বৃদ্ধ ও প্রতিবন্ধীদের চলাচল কঠিন হয়।
সমাধানের উপায়
১. গণপরিবহন উন্নয়ন: মেট্রোরেল, বাস র্যাপিড ট্রানজিট (BRT), এক্সপ্রেস বাস চালু করা। আরামদায়ক, নিরাপদ ও সময়নিষ্ঠ পরিবহন নিশ্চিত করা। সাশ্রয়ী ভাড়া প্রদান করা।
২. সাইকেল সংস্কৃতি প্রচলন: আলাদা সাইকেল লেন তৈরি করা। অফিস ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সাইকেল পার্কিং সুবিধা। শিক্ষার্থীদের সাইকেল ব্যবহার উৎসাহিত করা।
৩. হাঁটার উপযোগী শহর: ফুটপাত প্রশস্ত ও দখলমুক্ত রাখা। ছায়াযুক্ত, নিরাপদ এবং সবুজ হাঁটার রাস্তা তৈরি। পথচারীদের অগ্রাধিকার দেওয়া।
৪. নীতিমালা ও আইন: সপ্তাহে অন্তত একটি দিন গাড়িমুক্ত পালন বাধ্যতামূলক করা। শহরের নির্দিষ্ট এলাকায় নির্দিষ্ট সময় ব্যক্তিগত গাড়ি নিষিদ্ধ করা। বিদ্যুৎচালিত গাড়ি, রাইডশেয়ার ও কারপুলিং উৎসাহিত করা।
৫. সচেতনতা বৃদ্ধি: স্কুল–কলেজ, অফিস ও সামাজিক স্থানে প্রচারণা। গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সচেতনতা বৃদ্ধি।
আন্তর্জাতিক উদাহরণ
* প্যারিস, ফ্রান্স: বছরে একাধিক দিন শহর পুরোপুরি গাড়িমুক্ত থাকে। শুধুমাত্র হাঁটা, সাইকেল বা রিকশা চলাচল অনুমোদিত। * বোগোটা, কলোম্বিয়া: “Ciclovía” নামে প্রতি রবিবার প্রায় ১২০ কিমি রাস্তা গাড়িমুক্ত থাকে। * বেইজিং, চীন: সপ্তাহে নির্দিষ্ট দিনে গাড়ি চালানো সীমিত করা হয়। এগুলো প্রমাণ করে, রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও পরিকল্পনা থাকলে গাড়িমুক্ত শহর ও টেকসই নগরায়ণ সম্ভব।
গাড়িমুক্ত দিবসের সুফল
* শহরের বায়ুমান সাময়িকভাবে উন্নত হয়।
* মানুষ বিকল্প পরিবহন ব্যবহারে অভ্যস্ত হয়।
* শিশু, বৃদ্ধ ও প্রতিবন্ধীদের চলাচল সহজ হয়।
* শারীরিক ব্যায়ামের অভ্যাস গড়ে ওঠে।
* দীর্ঘমেয়াদে শহর টেকসই, বাসযোগ্য ও সবুজ হয়।
* মানসিক চাপ কমে এবং জনস্বাস্থ্য ভালো থাকে।
সমালোচনা ও সীমাবদ্ধতা
অনেকেই এটিকে কেবল প্রতীকী দিবস মনে করেন। একদিন গাড়ি কম চালালেই সমস্যার সমাধান হবে না। উন্নয়নশীল দেশে বিকল্প গণপরিবহন পর্যাপ্ত নয়। মানুষ আরাম-আয়েশ ত্যাগ করতে অনিচ্ছুক।ফলে, দিবসটি কার্যকর করতে হলে শুধু প্রতীকী পালন নয়, নীতিমালা, পরিকাঠামো উন্নয়ন এবং সচেতনতা—সব একসাথে প্রয়োগ করা প্রয়োজন।
পরিশেষে বলতে চাই, বিশ্ব ব্যক্তিগত গাড়িমুক্ত দিবস আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, শহরের স্থায়িত্ব এবং মানুষের সুস্থ জীবনের জন্য পরিবহন ব্যবস্থায় মৌলিক পরিবর্তন জরুরি। প্রতিদিন বাড়তে থাকা যানজট, বায়ুদূষণ এবং শহরের জীবনযাত্রার মান হ্রাস পাচ্ছে। একদিন গাড়ি ব্যবহার না করা মানে শুধু একটি প্রতীকী পদক্ষেপ নয়, বরং এটি আমাদের সচেতন হওয়ার আহ্বান। প্রতিদিনই যদি আমরা কিছুটা হলেও ব্যক্তিগত গাড়ির ব্যবহার কমাই, সাইকেল বা হাঁটার মাধ্যমে যাতায়াত করি, তাহলে শহরের দূষণ ও যানজট অনেকাংশে হ্রাস পাবে। বাংলাদেশসহ বিশ্বের সব দেশের নাগরিকরা যদি গণপরিবহন ব্যবস্থাকে উন্নত করে, নিরাপদ এবং সাশ্রয়ী করে তুলতে সচেষ্ট হয়, তাহলে শহরগুলো হবে অধিক বাসযোগ্য। সাইকেল পথ, হাঁটার জন্য নিরাপদ রাস্তাঘাট, পরিবেশবান্ধব গণপরিবহন ব্যবস্থার প্রসার—এসবই নগরায়ণের মান বৃদ্ধি করবে। এই ধরনের উদ্যোগ আগামী প্রজন্মকে পরিচ্ছন্ন, শান্তিপূর্ণ ও সুন্দর শহরে বসবাসের সুযোগ দেবে। বিশ্ব ব্যক্তিগত গাড়িমুক্ত দিবস আমাদের শুধু সচেতন করে না, বরং একটি সামাজিক অঙ্গীকারেরও আহ্বান জানায়। প্রতিটি মানুষ যদি ভাববে—“গাড়ি কম চালাই, পরিবেশ বাঁচাই,”—তাহলে শহরগুলো হবে স্বাস্থ্যসম্মত, টেকসই এবং আনন্দময়। তাই এই দিবসের মর্মকথা আমাদের হৃদয়ে ধারণ করে প্রতিদিনের জীবনে প্রয়োগ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
লেখক: কলাম লেখক ও গবেষক, প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি।