রূপক মুখার্জি, নড়াইল : প্রত্যেক গ্রামেরই ইতিহাস ও ঐতিহ্য থাকে। সেই ইতিহাস সুখকর হতে পারে, আবার দু:খের হতে পারে। আর ঐতিহ্য এখানে জীবিকার সাহসী উচ্চারণ, বাঁচার হাতিয়ার। সে রকম একটি ইতিহাস আর ঐতিহ্যের গ্রাম হলো 'ডহর রামসিদ্ধি '। নৌকা তৈরীর ইতিহাস আর ঐতিহ্যের জীবন্ত পীঠস্থান ডহর রামসিদ্ধি গ্রাম জনপদ। 

নড়াইল সদর উপজেলার ভদ্রবিলা ইউনিয়নের ডহর রামসিদ্ধি গ্রাম ‘নৌকার গ্রাম’ নামেই সর্বাধিক পরিচিত। প্রায় ২০০ বছরের ঐতিহ্য ধরে রেখে এ অঞ্চলের কারিগররা নৌকা তৈরি করে আসছেন।

বর্ষা মৌসুমের আগ থেকে শুরু হয়ে প্রায় ছয় মাস ধরে চলে এ নৌকার হাট। নৌকা তৈরিও চলে অবিরাম ধারায়। বর্তমানে এই গ্রামে অন্তত ৩০টি কারখানা আছে যেখানে প্রতিদিন নতুন নতুন নৌকা তৈরি হচ্ছে।

প্রতিটি কারখানায় তিন থেকে পাঁচজন কারিগর কাজ করেন। ছয় হাজার টাকা থেকে শুরু করে এক লাখ টাকা পর্যন্ত দামের নৌকা তৈরি হয় এসব কারখানায়। প্রতি বুধবার ভোর থেকে সকাল ১০টা পর্যন্ত বসে জমজমাট নৌকার হাট। প্রতিবারের হাটে গড়ে ১০০টিরও বেশি নৌকা বিক্রি হয়। তুলনামূলক কম দামে এখান থেকে নৌকা কেনা যায় বলে দূর-দূরান্ত থেকে ক্রেতারা আসেন এই রামসিদ্ধি গ্রামে।

নৌকা ক্রেতাদের মধ্যে অনেকে ব্যক্তিগত শখ, আবার অনেকে কৃষিকাজ ও মাছ ধরার প্রয়োজনে নৌকা কিনে নেন।

নৌকা কিনতে আসা হবখালী ইউনিয়নের সাথীমনি বলেন, শখের বশে শুধু ঘুরে বেড়ানোর জন্য সাড়ে সাত হাজার টাকায় একটি নৌকা কিনেছি।

কালিয়ার মান্নান জানান, ধানকাটা ও ঘাস পরিবহনের কাজে আমার নৌকার প্রয়োজন পড়ে।

কালডাঙ্গার আমিনুল শেখ বলেন, স্থানীয় হাটে সাত থেকে ৯ হাজার টাকায় সাশ্রয়ী দামে নৌকা পাওয়া যায়, যা সাত-আট বছর ব্যবহার করা সম্ভব।

মাগুরার জয়নাল ও আয়নাল হোসেন ৮ হাজার ২০০ টাকায় একটি নৌকা কিনেছেন। তারা জানান, তাদের মাছের ঘেরে খাবার দেয়ার জন্য নৌকা কিনেছেন তারা।

নৌকাহাট কমিটির সদস্য শান্তিরাম বিশ্বাস জানান, আষাঢ় ও শ্রাবণ বর্ষাকাল হলেও এখানে প্রায় ছয় মাস ধরে নৌকা কেনাবেচা চলে। মেহগনি, উড়িআম, রয়না ও পাউয়া কাঠ দিয়ে নৌকা তৈরি হয় এখানে। একটি ১২ হাতের নৌকা চারজন কারিগর এক দিনেই তৈরি করতে পারে। এর খরচ পড়ে প্রায় চার হাজার টাকা। সাত থেকে ১০ হাজার টাকায় সেটি বিক্রি করা যায়। বড় নৌকা তৈরিতে সময় লাগে তিন থেকে চার দিন।

শুধু নড়াইল নয়, মাগুরা, যশোর, খুলনা ও আশপাশের জেলা থেকেও পাইকাররা এখানে আসেন নৌকা কিনতে। ফলে ডহর রামসিদ্ধি হাটের পরিচিতি আরো বেড়ে যাচ্ছে। বিস্তৃত হচ্ছে নৌকার ব্যবসা।

রামসিদ্ধি গ্রামের প্রবীণরা আলাপকালে জানিয়েছেন, তাদের পূর্বপুরুষরা নৌকা তৈরি শুরু করেছিলেন দুই শতাব্দী আগে। সেই ঐতিহ্য এখনো ধরে রাখা হয়েছে। প্রযুক্তির উন্নয়ন ও সময়ের পরিবর্তন সত্ত্বেও ডহর রামসিদ্ধি আজও ‘নৌকার গ্রাম’ পরিচিতি ধরে রাখতে পেরেছে।

(আরএম/এএস/সেপ্টেম্বর ২৩, ২০২৫)