ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ


প্রতিবছর ২৫ সেপ্টেম্বর বিশ্বব্যাপী বিশ্ব ফুসফুস দিবস পালিত হয়। ফুসফুস আমাদের শরীরের অন্যতম প্রধান অঙ্গ, যা না থাকলে জীবন সম্ভব নয়। শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে অক্সিজেন গ্রহণ ও কার্বন-ডাই-অক্সাইড নির্গমন ফুসফুসের কাজ। কিন্তু আধুনিক জীবনযাত্রা, ধূমপান, বায়ুদূষণ, অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, সংক্রমণ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে প্রতিদিন কোটি কোটি মানুষ ফুসফুসজনিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO), আন্তর্জাতিক শ্বাসতন্ত্র সংস্থার ফোরাম (FIRS), হাঁপানি নিয়ন্ত্রণে গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভ (GINA) এবং দীর্ঘস্থায়ী ফুসফুস রোগ নিয়ন্ত্রণে গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভ (GOLD) সহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা যৌথভাবে এই দিবসটি পালন করে। উদ্দেশ্য হলো—মানুষকে সচেতন করা, ঝুঁকির কারণ বোঝানো এবং প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণে উৎসাহিত করা।

কারণ

ফুসফুসের রোগের পেছনে প্রধান কারণগুলো হলো—

১. ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য : ধূমপান ফুসফুস ক্যানসার, ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ (COPD), এমফিসেমা এবং দীর্ঘস্থায়ী ব্রঙ্কাইটিসের প্রধান কারণ।

২. বায়ুদূষণ : শহরাঞ্চলের ধোঁয়া, শিল্পকলার নির্গত গ্যাস, যানবাহনের ধোঁয়া এবং গ্রামে রান্নার কাঠ/কয়লা চুলার ধোঁয়া ফুসফুসের জন্য ক্ষতিকর।

৩. সংক্রমণ : যক্ষ্মা, নিউমোনিয়া, ইনফ্লুয়েঞ্জা, কোভিড-১৯ ইত্যাদি ফুসফুসের স্বাভাবিক কার্যক্ষমতা ক্ষতিগ্রস্ত করে।

৪. অ্যালার্জি ও জেনেটিক কারণ : হাঁপানি বংশগতভাবে হতে পারে। সিস্টিক ফাইব্রোসিস একটি জেনেটিক রোগ, যা শ্বাসনালীতে অতিরিক্ত শ্লেষ্মা জমায়।

৫. পেশাগত ঝুঁকি :- কয়লা, সিলিকা, অ্যাসবেস্টসের ধুলিকণা দীর্ঘসময় শ্বাস নেওয়া ফুসফুসের স্থায়ী ক্ষতি ঘটায়।

৬. জীবনযাত্রাজনিত কারণ : শারীরিক অনিয়ম, অস্বাস্থ্যকর খাদ্য, স্থূলতা ও ব্যায়ামের অভাব ফুসফুসের কার্যক্ষমতা হ্রাস করে।

ফুসফুস ও অক্সিজেনের সম্পর্ক

ফুসফুসের প্রধান কাজ হলো অক্সিজেন গ্রহণ ও কার্বন-ডাই-অক্সাইড ত্যাগ। আমরা যখন শ্বাস নেই, বাতাস ফুসফুসের ভেতর প্রবেশ করে এবং অ্যালভিওলাই নামক ক্ষুদ্র থলিগুলিতে পৌঁছায়। এখানে রক্তনালীর সাথে গ্যাসের আদান-প্রদান ঘটে।

* অক্সিজেন গ্রহণ: অ্যালভিওলাই থেকে অক্সিজেন রক্তে প্রবেশ করে এবং হিমোগ্লোবিনের মাধ্যমে শরীরের প্রতিটি কোষে পৌঁছায়।

* শক্তি উৎপাদন: কোষ অক্সিজেন ব্যবহার করে খাদ্য ভেঙে শক্তি তৈরি করে, যা জীবনধারণের জন্য অপরিহার্য।

* কার্বন-ডাই-অক্সাইড ত্যাগ: কোষ থেকে উৎপন্ন বর্জ্য গ্যাস রক্তের মাধ্যমে ফুসফুসে ফিরে আসে এবং শ্বাস ছাড়ার সময় বের হয়।

অক্সিজেনের ঘাটতির প্রভাব

যদি ফুসফুস ঠিকভাবে কাজ না করে, শরীর পর্যাপ্ত অক্সিজেন পায় না। এর ফলে—

* মস্তিষ্কে অক্সিজেনের অভাবে অজ্ঞান বা কোমা হতে পারে। * হৃদযন্ত্র দুর্বল হয়ে হৃদরোগ বা হার্ট অ্যাটাক ঘটতে পারে। * অঙ্গপ্রত্যঙ্গ পর্যাপ্ত অক্সিজেন না পেলে কিডনি, লিভার, মাংসপেশি বিকল হতে পারে। * দীর্ঘমেয়াদে অক্সিজেনের ঘাটতি মৃত্যুঝুঁকি বৃদ্ধি করে।এ কারণেই বলা হয়—শ্বাস-প্রশ্বাস মানেই জীবন, আর ফুসফুস মানেই অক্সিজেনের ভান্ডার।

লক্ষণ

* দীর্ঘস্থায়ী কাশি * শ্বাসকষ্ট বা হাঁপ ধরা * বুকের মধ্যে চাপ বা ব্যথা * শ্বাসের সময় শোঁ শোঁ শব্দ
* কাশির সঙ্গে রক্ত আসা * বারবার জ্বর হওয়া ও দুর্বলতা * হঠাৎ ওজন কমে যাওয়া * প্রাথমিক পর্যায়ে সনাক্ত করলে অধিকাংশ রোগ নিয়ন্ত্রণযোগ্য।

প্রকারভেদ

ফুসফুসের রোগগুলো সাধারণত চার ভাগে ভাগ করা যায়—

১. সংক্রামক রোগ : * যক্ষ্মা * নিউমোনিয়া * ব্রঙ্কাইটিস * কোভিড-১৯ ও ইনফ্লুয়েঞ্জা

২. অসংক্রামক রোগ : * হাঁপানি * ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ * ফুসফুস ক্যানসার

৩. পেশাগত ফুসফুস রোগ : * সিলিকোসিস * অ্যাসবেস্টোসিস * কয়লা খনি শ্রমিকদের ফুসফুস রোগ

৪. জেনেটিক ও অন্যান্য রোগ : * সিস্টিক ফাইব্রোসিস * পালমোনারি ফাইব্রোসিস * স্লিপ অ্যাপনিয়া ও হাইপোভেন্টিলেশন সিন্ড্রোম

পরিসংখ্যান

* WHO অনুযায়ী প্রতি বছর বিশ্বে প্রায় ৪০ লাখ মানুষ ফুসফুসজনিত রোগে মারা যায়। * COPD বিশ্বে মৃত্যুর তৃতীয় প্রধান কারণ। * বিশ্বে প্রায় ২৬ কোটি মানুষ হাঁপানিতে আক্রান্ত। * যক্ষ্মা প্রতি বছর প্রায় ১৫ লাখ মানুষের মৃত্যু ঘটায়। * ফুসফুস ক্যানসার বছরে প্রায় ১৮ লাখ মানুষের মৃত্যু ঘটায়। * বাংলাদেশে প্রায় ৭০ লাখ মানুষ হাঁপানিতে ভোগে, যক্ষ্মা রোগীর সংখ্যা প্রায় ৪ লাখ। ঢাকা শহরে বায়ুদূষণজনিত কারণে ফুসফুস ক্যানসারের ঝুঁকি অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় অনেক বেশি।

> জটিলতা

ফুসফুসের রোগ দীর্ঘস্থায়ী হলে বিভিন্ন জটিলতা দেখা দেয়— * অক্সিজেনের ঘাটতির কারণে হৃদরোগ ও স্ট্রোক * দীর্ঘস্থায়ী সংক্রমণে শ্বাসযন্ত্র ব্যর্থতা (Respiratory failure) * সংক্রমণ ছড়িয়ে সেপসিস ও অঙ্গ বিকল * যক্ষ্মা অবহেলা করলে মৃত্যুঝুঁকি বৃদ্ধি * ক্যানসার শরীরের অন্য অঙ্গে ছড়িয়ে পড়া * শিশুদের ক্ষেত্রে শারীরিক ও মানসিক বিকাশে ব্যাঘাত

রোগ নির্ণয়

ফুসফুসের রোগ নির্ণয়ে ব্যবহৃত প্রধান পরীক্ষা—

১. এক্স-রে ও সিটি স্ক্যান – টিউমার, ইনফেকশন বা ফাইব্রোসিস শনাক্ত। ২ . স্পাইরোমেট্রি টেস্ট – হাঁপানি ও COPD নির্ণয়ে। ৩. রক্ত পরীক্ষা ও ABG টেস্ট – রক্তে অক্সিজেন ও কার্বন-ডাই-অক্সাইডের মাত্রা। ৪. ব্রঙ্কোস্কপি – ফুসফুসের ভেতরের টিস্যু পর্যবেক্ষণ। ৫. থুতুর পরীক্ষা – যক্ষ্মা বা ক্যানসার সেল শনাক্ত। ৬. পালস অক্সিমিটার – অক্সিজেন স্যাচুরেশন পরিমাপ। ৭. MRI ও PET Scan – ক্যানসারের স্টেজ নির্ধারণ।

প্রতিকার

> ধূমপান ও তামাক ত্যাগ : * সিগারেট, বিড়ি, হুক্কা, চুরুট সম্পূর্ণ ত্যাগ। * ভেপ বা ই-সিগারেট থেকেও দূরে থাকা। * ধূমপায়ী পরিবেশ এড়িয়ে চলা।

> বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণ : * ঘরে ও বাইরে পরিষ্কার বাতাস নিশ্চিত করা। * শিল্পকারখানা ও যানবাহনের ধোঁয়া নিয়ন্ত্রণ। * আবর্জনা পোড়ানো থেকে বিরত থাকা।

> রান্নার সময় ভেন্টিলেশন: * রান্নাঘরে জানালা-দরজা খোলা রাখা। * এক্সহস্ট ফ্যান বা চিমনি ব্যবহার।* ধোঁয়াবিহীন চুলা ও নিরাপদ জ্বালানি ব্যবহার।

> স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস : * শাকসবজি, ফলমূল, আঁশযুক্ত ও ভিটামিনসমৃদ্ধ খাবার খাওয়া।* পর্যাপ্ত পানি পান। * অতিরিক্ত তেল, ফাস্টফুড ও নেশা এড়িয়ে চলা।

> নিয়মিত ব্যায়াম : * প্রতিদিন হাঁটা ও শ্বাস-প্রশ্বাস ব্যায়াম করা। * খেলাধুলা ও যোগব্যায়ামে অভ্যস্ত হওয়া। * অন্তত ৩০ মিনিট সক্রিয় থাকা।

> নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা: * বছরে অন্তত একবার চেকআপ। * ফুসফুস ফাংশন টেস্ট ও ডাক্তারের ফলোআপ।

> জীবনযাপন ও সচেতনতা: * পর্যাপ্ত ঘুম ও মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণ। * পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা। * পরিবার ও সমাজে সচেতনতা বৃদ্ধি।

ঘরোয়া সমাধান

১. আনারসের রস – ফুসফুসে জমে থাকা নিকোটিন বা দূষিত পদার্থ দূর করতে সহায়ক।

২. বাদামজাতীয় খাবার – কাজু, আখরোট, পেস্তা, চিনাবাদাম ও কুমড়ার বীজে রয়েছে ভিটামিন E, ওমেগা-৩ ও খনিজ পদার্থ, যা অক্সিজেন সরবরাহ ও প্রদাহ প্রতিরোধে সাহায্য করে।

৩. মধু – অ্যান্টি-মাইক্রোবায়াল ও প্রদাহনাশক গুণাগুণ ফুসফুসকে পরিষ্কার রাখে। প্রতিদিন এক চা চামচ মধু খাওয়া উপকারী।

৪. ভিটামিন D সমৃদ্ধ খাবার – সূর্যের আলো, দুধ, ডিম, দই, মাছ ও মাংসে পাওয়া যায়; যা ফুসফুসের প্রদাহ প্রতিরোধে কার্যকর।

৫. তুলসী পাতা – অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ তুলসী শ্বাসযন্ত্রকে দূষণ থেকে রক্ষা করে। তুলসীর রস বা পানিতে ফোটানো তুলসী পান করা উপকারী।

৬. কালোজিরা – শ্বাসনালির প্রদাহ রোধ করে। আধা চা চামচ কালোজিরার গুঁড়া এক চা চামচ মধুর সঙ্গে খেলে ভালো ফল মেলে।

৭. ভিটামিন C সমৃদ্ধ খাবার – লেবু, আমলকি, কমলা, আপেল, পেয়ারা ইত্যাদি ফুসফুসের জন্য অপরিহার্য।

৮. রসুন – এতে থাকা সেলেনিয়াম ও অ্যালিসিন শ্বাসযন্ত্রকে সংক্রমণ থেকে রক্ষা করে।

৯. শারীরিক ব্যায়াম – এরোবিক্স, ইয়োগা ও কার্ডিও এক্সারসাইজ ফুসফুস শক্তিশালী করে।

১০. গ্রিন টি – ফ্ল্যাভোনয়েড নামক অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট ফুসফুস পরিষ্কারে সহায়তা করে।

১১. হলুদ – কারকিউমিন উপাদান ফুসফুসকে দূষণ থেকে রক্ষা করে। সর্দি-কাশিতে কাঁচা হলুদ মধু বা ঘি দিয়ে খেলে উপকার পাওয়া যায়।

১২. সামুদ্রিক মাছ – ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড ফুসফুস সুস্থ রাখতে সহায়ক।

১৩. গাজরের রস – ফুসফুস পরিষ্কার রাখতে কার্যকর।

১৪. লেবু-মধুর পানি – রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে ও ফুসফুসকে দূষণমুক্ত রাখে।

হোমিও সমাধান

হোমিওপ্যাথি চিকিৎসায় রোগ নয়, রোগীকে চিকিৎসা করা হয়। একজন অভিজ্ঞ হোমিও চিকিৎসক রোগীর ইতিহাস, শারীরিক ও জেনেটিক অবস্থা বিবেচনা করে ওষুধ নির্বাচন করেন। পাশাপাশি সঠিক খাদ্যাভ্যাস, নিয়মিত ঘুম, ব্যায়াম, মানসিক চাপমুক্ত জীবনযাপন ও কাউন্সেলিংকেও গুরুত্ব দেওয়া হয়। অভিজ্ঞতা সম্পন্ন চিকিৎসক প্রাথমিকবাবে যেইসব ঔষধ লক্ষণের নির্ভর করে ব্যবহার করে থাকেন:- অ্যান্টিমোনিয়াম আর্স, অ্যান্টিমোনিয়াম টার্ট, আর্সেনিকাম অ্যালব, অ্যাসপিডোস্পার্মা, ব্রায়োনিয়া অ্যালবা, ক্যালকেরিয়া হাইপোফস, কোকা কিউ, এলাপস কর, হাইড্রোসায়ানিকাম অ্যাসিডাম, কুয়েব্রাচো, সেনেগা, স্পঞ্জিয়া।

সতর্কতা: চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কখনো নিজে নিজে ওষুধ গ্রহণ করবেন না।

পরিশেষ, ফুসফুস মানবদেহের একটি অপরিহার্য অঙ্গ। বায়ুদূষণ, ধূমপান ও অস্বাস্থ্যকর জীবনযাপন এ অঙ্গকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। তাই আমাদের উচিত সচেতন থাকা, স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস গড়ে তোলা, নিয়মিত ব্যায়াম করা এবং প্রয়োজনীয় চিকিৎসা গ্রহণ করা। সুস্থ ফুসফুসই আমাদের সুস্থ জীবনের মূল ভিত্তি।

লেখক : চিকিৎসক, কলাম লেখক ও গবেষক, প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি।