তালায় প্রতিমার হাত ভেঙে কাপড় ছিঁড়েছে পাগল!

রঘুনাথ খাঁ সাতক্ষীরা : সনাতন ধর্মাবলম্বীদের অন্যতম প্রধান ধর্মীয় শারদীয় দুর্গাপূজা উপলক্ষ্যে সাতক্ষীরা জেলার সাতটি  উপজেলা জুড়ে শেষ মুহুর্তে  চলছে প্রতিমার গায়ে রং টানার কাজ।  এ বছর জেলায় ৫৯২ টিন মণ্ডপে অনুষ্ঠিত হবে বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় পূজা দুর্গাপূজা। 

সাতক্ষীরা জেলা মন্দির সমিতির সাধারণ সম্পাদক নিত্যানন্দ আমিন জানান, এবার জেলার ৫৯২ টি মণ্ডপে শারদীয়া দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এরমধ্যে সাতক্ষীরা সদরে ১০৭টি, কালিগঞ্জে ৪৯ টি,কলারোয়ায় ৪৯ টি, দেবহাটায় ২১ টি,আশাশুনীতে ১০৫ টি, শ্যামনগরে ৭০টি ও তালায় ১৯৫টি মণ্ডপে পুজা অনুষ্ঠিত হবে। তবে কলারোয়ার মুরারীকাটিতে পাটের তৈরি প্রতিমা, সদরের ধুলিহরে ধানের তৈরি প্রতিমা ও শ্যামনগরের বড়কুপটে ২১ হাত দুর্গা প্রতিমা দর্শনার্থীদের জন্য বিশেষ আকর্ষণ। তবে ২৩ সেপ্টেম্বর মঙ্গলবার ভোরে তালা উপজেলার কলাপোতা পূর্বপাড়া বটতলা মন্দিরের মা দুর্গা, লক্ষী ও সরস্বতীর কাপড় ছিঁড়ে ফেলা ও মা দুর্গার হাত ভেঙে দেওয়ার ঘটনায় হতাশা ব্যক্ত করেন।

কলাপোতা পূর্বপাড়া বটতলা মন্দির কমিটির সভাপতি হরেকৃষ্ণ দাস জানান, সোমবার দিবাগত রাত দুটোর দিকে বৃষ্টি আসায় তিনিসহ কয়েকজন বাড়ি চলে আসেন। সকালে মন্দিরে যেয়ে দুর্গা, লক্ষী ও সরস্বতীর গায়ের কাপড় ছিঁড়ে কুটি কুটি করা অবস্থায় নীচে পড়ে থাকতে দেখে স্থানীয় গন্যমান্য ব্যক্তিসহ প্রশাসনের বিভিন্ন দপ্তরকে অবহিত করেন। খবর পেয়ে সদর সেনা কর্মকর্তা, র‌্যাব-৬ এর সাতক্ষীরা অফিসের কর্মকর্তা, তালা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, তালা সার্কেল অফিসার, তালা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাসহ গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তারা ছুঁটে আসেন।মঙ্গলবার ভোর তিনটার দিকে বিদ্যুৎ না থাকায় সিসি ক্যামেরা সচল ছিল না। বৃষ্টি চলাকালিন পরবর্তীতে রাঁড়িপাড়ার আলম নামের এক পাগল জানায় যে মঙ্গলবার ভোরে সে মন্দিরে ঢুকে প্রতিমার কাপড় ছিঁড়েছে। প্রতিমার হাত ভেঙেছে। এ ঘটনায় তিনি থানায় কোন লিখিত অভিযোগ করেন নি।

সাতক্ষীরা সদরের ঝুটিতলা গ্রামের নির্মাণ শ্রমিক বাবলু দাস জানান, এবার টানা বৃষ্টিতে তাদের এলাকা,পৌরসভা ছাড়াও সদরের বিস্তীর্ণ অঞ্চল প্লাবিত হওয়ার পুজায় নতুন জামা কাপড় কেনা সম্ভব হয়নি। মাছ ও সবজিসহ নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের এতই দাম যে, নুন আনতে পান্তা ফুরানোর মত অবস্থা।

সাতক্ষীরা শহরের বস্ত্র ব্যবসায়ি আমিনুল ইসলাম জানান, পূজায় অন্যবারের মত বেচা- কেনা নেই। তবে শেষ মুহুর্তে খরিদ্দার বাড়তে পারে।

মৃৎশিল্পী আশাশুনির আরআর গ্রামের সুভাস সরকার জানান, প্রতি বছরের মতো এবারও সাতটি প্রতিমার বায়না নিয়েছেন তিনি। তবে প্রতিমা তৈরির কাঁচামালের দাম বেড়ে গেলেও বাড়েনি মজুরি। তবুও এই শিল্পের সঙ্গে আমাদের পূর্বপুরুষদের যে ঐতিহ্য জড়িত, সেটা ধরে রাখার চেষ্টা করছেন। আগামি ২৭ সেপ্টেম্বর পঞ্চমীর আগেই সকল প্রতিমার রং করার কাজ শেষ করতে পারবেন।

আরেক মৃৎশিল্পী মণোরঞ্জন পাল বলেন, প্রতিমা তৈরির কাজ অনেক ধৈর্য ও নিপুণতার। বিশেষ করে মুখ তৈরি করা সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং। সময় মতো কাজ শেষ করতে অনেক সময় রাতেও কাজ করতে হয়। প্রতিমা নির্মাণের কাজ প্রায় শেষের পথে। পূজার শুরুর আগেই প্রতিমার গায়ে রং-তুলির কাজ শেষ করা হবে।

কলারোয়ার মুরারিকাটি গ্রামের হারাধন পাল জানান, ২০২৩ সালে তাদের পাড়ার মন্দির
চিনিকানি ধান দিয়ে দুর্গা প্রতিমা তৈরি করায় দর্শনার্থীদের উপচে পড়া ভিড় ছিলো। এবার পাটের আঁশ দিয়ে তৈরি প্রতিমা দেখতে পুজা শুরুর আগেই দূর দূরান্ত থেকে মানুষ আসা শুরু করেছে। আবহাওয়া ভালো থাকলে ২৭ সেপ্টেম্বর পঞ্চমী থেকে ২ অক্টোবর বিসর্জন পর্যন্ত আনন্দে কাটবে।

সাতক্ষীরা জজ কোর্টের আইনজীবী সহকারি সন্তোষ কুমার সরকার জানান, গত ২১ সেপ্টেম্বর কলা কাটা অমাবস্যার মধ্যে মন্দিরে মন্দিরে ঘট প্রতিস্থাপনের মধ্য দিয়ে মর্তে দেবী দুর্গার আবির্ভাব ঘটেছে। দেবী আসছেন গজে আর যাবেন দোলায়। জেলায় ষষ্ঠী ও সপ্তমীর দিন মণ্ডপে মণ্ডপে প্রতিমা দেখে ডাক্তার দেখাতে কোলকাতায় যাবেন। সেখানেও প্রতিমা দর্শন করবেন। আনন্দ উপভোগ করবেন দুই বাংলায়।

স্থানীয় হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে উৎসবের আমেজ ইতোমধ্যে শুরু হয়ে গেছে। মণ্ডপ সাজানো, আলোকসজ্জা ও সাংস্কৃতিক আয়োজন নিয়েও চলছে জোর প্রস্তুতি। উপজেলা জুড়ে উৎসবের আবহে ব্যস্ততা যেমন বেড়েছে, তেমনি দীর্ঘদিন ধরে টিকে থাকা মৃৎশিল্পীদের ঐতিহ্যও নতুন করে প্রাণ পাচ্ছে এই দুর্গাপূজার মধ্য দিয়ে।

পঞ্জিকা মতে, ২১ সেপ্টেম্বর মহালয়ের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে মর্তলোকে বেজে উঠেছে দেবীর আগমনি বার্তা। ২৭শে সেপ্টেম্বর দেবী দুর্গার মর্তে আগমনী বার্তায় দেবীর বোধন পূজা। ২৮শে সেপ্টেম্বর ষষ্ঠী পূজার মধ্য দিয়ে দেবীর দুর্গার নবপত্র কল্পারম্ভ। ওইদিন মণ্ডপে মণ্ডপে বেজে উঠবে ঢাক-ঢোল আর কাঁসরের শব্দ। ২৯শে মহাসপ্তমী পূজা। ৩০শে সেপ্টেম্বর দেবীর মহাঅষ্টমী পূজা। মহানবমী পূজা ১লা অক্টোবর। ২রা অক্টোবর দশমী বিহিত পূজা সমাপনান্তে দেবী বিসর্জন ও দশ হরার মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে সম্পন্ন হবে পাঁচ দিনব্যাপী শারদীয় দুর্গাপূজার ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।

সাতক্ষীরা পুলিশ সুপার মোঃ মনিরুল ইসলাম জানান, জেলায় দুর্গাপূজা শান্তিপূর্ণ রাখতে চার স্তরেরর নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে।ঝুঁকিপূর্ণ মণ্ডপগুলোতে বিশেষ টহল থাকবে। গুজব সৃষ্টিকারিদের বিরুদ্ধে নেওয়া হবে কঠোর ব্যবস্থা।

(আরকে/এসপি/সেপ্টেম্বর ২৪, ২০২৫)