শিতাংশু গুহ


বাংলাদেশে মূর্তিভাঙ্গা জানান দিচ্ছে দুর্গাপূজা এসে গেছে। শুধু দুর্গাপূজা নয়, যেকোন পূজার আগে বাংলাদেশে মুমিন মুসলমানের একাংশ তাঁদের ঈমানী দায়িত্বে হিসাবে মূর্তি ভাঙ্গে। প্রায়শ: ওয়াজ মাহফিলে মূর্তি ভাঙ্গার পক্ষে জোরালো বক্তব্য দেয়া হয়। মাওলানা রাজ্জাক তো জোরের সাথেই বলেন: ‘আমি মুসলিম, আমার জন্ম হয়েছে মূর্তি ভাঙ্গার জন্যে’। তিনি নিজহাতে মুর্ক্তি ভেঙ্গেছেন এমত সংবাদ অবশ্য কখনো চোখে পড়েনি। অন্য মুসলমানরা মূর্তিভাঙ্গা নিয়ে উচ্চবাচ্য করেনা। সরকার উদার, অপরাধীর বিচার করেনা। পুলিশ প্রায়শ: যাঁরা মূর্তিভাঙ্গে তাদের ‘পাগল’ বলে ছেড়ে দেয়। একই পাগল দুইবার ভেঙ্গেছে এমন ঘটনাও আছে। এসব পাগল কিন্তু ‘জাতে মাতাল তালে ঠিক’-এঁরা মন্দির-প্যাগোডা-চার্চ ভাঙ্গে, মসজিদ ভাঙ্গে না? 

জামালপুর সরিষাবাড়ীতে প্রতিমা ভাঙচুর হয়েছে, সিসি ক্যামেরায় অপরাধীর ছবি দেখা গেছে, ১ জন প্রেফতার হয়েছে। এ অপরাধে মাঝেমধ্যে গ্রেফতার হয় বটে, চার্জশিট হয়না। কারণ হয়তো পুলিশ মূর্তিভাঙ্গা ‘জায়েজ’ মনে করেন? গাজীপুর কাশিমপুরে কয়েকটি প্রতিমা ভাঙচুর হয়েছে। পুলিশ বলছে বাতাসে মূর্তি ভেঙ্গে থাকতে পারে। এটি নুতন থিওরী। মিডিয়া জানিয়েছে, ঘটনার দিন কাশিমপুরে আবহাওয়া চমৎকার ছিলো, বাতাস ছিলোনা। অপরাধী আগে ছিলো ‘পাগল’, এখন এর সাথে যুক্ত হয়েছে, ‘বাতাস’। নেত্রকোনায় দুর্গাপূজা মণ্ডপে দুই প্রতিমা ভাঙচুর হয়েছে, আতঙ্কে স্থানীয়রা। কুষ্টিয়ায় মন্দিরে প্রতিমা ভাঙচুর, দুর্বৃত্তরা ক্যামেরা নিয়ে গেছে। ইত্যাকার ঘটনা বাংলাদেশে নুতন নয়, ৫৪ বছরের ধারাবাহিকতা, বরং বলা যায় পাকিস্তানের ধারাবাহিকতা।

সদ্য হুজুররা প্রাথমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গানের শিক্ষক নিয়োগের প্রতিবাদে রাজধানীতে বিক্ষোভ করেছেন। যারা গান ভালবাসে না, তাঁরা মুর্ক্তি ভাঙ্গবে না তো কি? ভাঙ্গাই তো এদের একমাত্র কাজ? এঁরা কখনো কিছু গড়েনি, শুধু ভেঙ্গেছে? পূজার আগে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা নসিহত দিয়েছেন যে মদ খাওয়া চলবে না, পূজার আশেপাশে মেলা বসানো যাবেনা। গ্রামে-গঞ্জে পূজাকে কেন্দ্র করে আশেপাশে ছোটখাট মেলা বসে থাকে, এবার তা বন্ধ। মেলা বন্ধের কারণ হচ্ছে, হুজুররা মেলাতে হিন্দুয়ানী খুঁজে পায়, একই কারণে গ্রামীণ সংস্কৃতি ‘যাত্রা’ বন্ধ হয়ে গেছে। বাংলাদেশে নাকি এবারো পূজা বেড়েছে, সরকার এটিকে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি হিসাবে প্রচার চালায়। ‘সম্প্রীতি’ শুনতে শুনতে কান ঝালাপালা হয়ে গেছে। পূজা হয় সশস্ত্র প্রহরায়, নিরাপত্তা বাহিনী উঠিয়ে দিলে ‘বোঝা যেতো ‘সম্প্রীতি’ কত প্রকার ও কি কি!

চিন্ময় কৃষ্ণ দাস প্রভু’র মুক্তির দাবীতে এবার ঘপাৎ পূজা করার বিষয় নিয়ে কথাবার্তা হয়, হিন্দুরা সাহস পায়নি কারণ সরকার বারোটা বাজিয়ে দেবে, মব হামলার আশংকা ছিলো। ড. ইউনুস জাতিসংঘ সম্মেলনে যোগ দিতে নিউইয়র্ক এসেছেন। আসার আগে তিনি ঢাকেশ্বরী মন্দিরে যান, এবং বলেন, দেবী দুর্গার সম্মিলিত শক্তি বাংলাদেশকে সকল দুর্গতি থেকে রক্ষা করুক। সুন্দর বক্তব্য। তিনি হিন্দুদের মাঝে দাঁড়িয়ে ভারতের বিরুদ্ধে কিছু বলেননি। আপাতত: তিনি ভারতের প্রতি কিছুটা প্রসন্ন। ২০২১-এ কুমিল্লার ঘটনার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঢাকেশ্বরী মন্দিরে গিয়ে বললেন, ভারতে কিছু ঘটলে এর প্রভাব বাংলাদেশে পড়বে, তিনি বলেন, আপনারা মোদিকে বলেন যাতে ভারতে সাম্প্রদায়িক ঘটনা না ঘটে। কুমিল্লার ঘটনার পর হাইকোর্ট ‘জুডিশিয়াল ইনকোয়ারি’-র নির্দেশ দেন, এটর্নি জেনারেল সেই নির্দেশ বাতিলের জন্যে আবেদন করে তা ‘স্থগিত’ করে দেন, যা ওঠানো সম্ভব হয়নি।

রংপুরের ঘটনার পর ওবায়দুল কাদের বলেছিলেন, সরকারের সাথে ভারতের সম্পর্কের অবনতি ঘটানোর জন্যে এসব করা হচ্ছে। এ বক্তব্য অন্যের ওপর দোষ চাপিয়ে পাশ কাটানো। অথচ ঐ সরকারটি নাকি ছিলো প্রগতিশীল। বাংলাদেশে কোন সরকারই কখনো হিন্দুর পক্ষে কোন পদক্ষেপ নেয়নি, বর্তমান সরকার তো বৈরী। বাংলাদেশে সকল সরকারের আমলে মূর্তি ভেঙ্গেছে, এখনো ভাঙ্গছে, এর শেষ কোথায় কেউ জানেনা। মূর্তিভাঙ্গা বা হিন্দু’র ওপর নির্যাতন কিছুটা হলেও কমতো যদি রাজনৈতিক নেতারা এসব নিয়ে কথা বলতেন। তাঁরা মুসলিম, মূর্তিভাঙ্গার বিরুদ্ধে কথা বলতে পারেন না? বাংলাদেশে কেউ কি কখনো শুনেছে, কোন মুসলমান প্রকাশ্যে মূর্তিভাঙ্গার বিপক্ষে কথা বলেছেন? কেউ ভাঙ্গে, কেউ চুপ থাকে, এটাই চলছে। অনেকে বিশ্বাস করেনা যে হিন্দুরা নির্যাতীত। অনেকে বলতে পছন্দ করেন, হিন্দুরা জামাই-আদরে আছে। তাদের বলি, ঠিক আছে, তাহলে ভারত-সহ পুরো বিশ্বে মুসলমানরা বাংলাদেশের হিন্দুর মত জামাই-আদরে থাকুক, এতে কিন্তু তাঁরা রাজি নন।

লেখক : আমেরিকা প্রবাসী।