পরিবেশ ও স্বাস্থ্য: বাংলাদেশের জন্য সমন্বিত পদক্ষেপের প্রয়োজন

ওয়াজেদুর রহমান কনক
২৬ সেপ্টেম্বর পালিত বিশ্ব পরিবেশ স্বাস্থ্য দিবস (World Environmental Health Day) বিশ্বের জনগণকে স্মরণ করিয়ে দেয় যে পরিবেশগত ঝুঁকি মানুষের স্বাস্থ্যকে কতটা গভীরভাবে প্রভাবিত করে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO)-এর তথ্য অনুযায়ী, প্রতিবছর প্রায় ১৩ মিলিয়ন মানুষ পরিবেশ-সম্পর্কিত প্রতিরোধযোগ্য কারণে মৃত্যুবরণ করে, যার মধ্যে ৯০% মানুষ উন্নয়নশীল দেশে বসবাস করে। দূষিত বায়ু, অনিরাপদ পানি, অপর্যাপ্ত স্যানিটেশন এবং রাসায়নিক ও হোস্টাইল পরিবেশজনিত উপাদানগুলো শিশু, বৃদ্ধ ও স্বাস্থ্যহীন জনগোষ্ঠীর জন্য সবচেয়ে বড় ঝুঁকি তৈরি করে। এই দিবসটি মূলত আমাদেরকে সচেতন করে যে সুস্থ জীবনযাপন ও স্বাস্থ্যকর পরিবেশ গাঁথা, এবং বিশ্বের প্রতিটি দেশ ও সমাজকে এই সংযোগকে নীতি, পরিকল্পনা ও ব্যক্তিগত জীবনযাপনের কেন্দ্রবিন্দুতে রাখতে হবে।
বিশ্বব্যাপী জনস্বাস্থ্য এবং পরিবেশের সম্পর্ক এতটাই গভীর যে আজকের দিনে এ দুটিকে আলাদা করে ভাবা প্রায় অসম্ভব। ২৬ সেপ্টেম্বর পালিত বিশ্ব পরিবেশ স্বাস্থ্য দিবস (World Environmental Health Day) এই সম্পর্ককে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরে। মূলত ২০১১ সালে International Federation of Environmental Health (IFEH)-এর উদ্যোগে দিবসটি আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়। এর উদ্দেশ্য হলো পরিবেশ-জনিত স্বাস্থ্যঝুঁকি সম্পর্কে বৈশ্বিক সচেতনতা বৃদ্ধি করা এবং নীতি নির্ধারক, গবেষক ও সাধারণ জনগণকে সমন্বিত কর্মপন্থার দিকে ধাবিত করা।
মানব সভ্যতার ইতিহাসে পরিবেশ ও স্বাস্থ্য একে অপরের সাথে অবিচ্ছেদ্যভাবে যুক্ত। কৃষিভিত্তিক সমাজে অতিরিক্ত সেচ ব্যবস্থার কারণে জলাবদ্ধতা এবং মশাবাহিত রোগ যেমন ম্যালেরিয়া ও ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব ঘটেছে। শিল্পবিপ্লবের পর থেকে বায়ুদূষণ, শিল্পবর্জ্য, ভারী ধাতু এবং রাসায়নিক পদার্থের প্রভাবে মানুষের শ্বাসযন্ত্র ও স্নায়ুতন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আধুনিক নগরায়ণে শব্দদূষণ, প্লাস্টিক দূষণ ও পানিদূষণ পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করছে, যার প্রত্যক্ষ প্রভাব মানুষের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর পড়ছে।
পরিবেশ স্বাস্থ্য বিজ্ঞানে একটি মৌলিক ধারণা হলো—মানুষ ও তার পরিবেশের পারস্পরিক ক্রিয়া স্বাস্থ্য-অবস্থার নির্ধারক। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) হিসাব অনুযায়ী, প্রতিবছর প্রায় ১৩ মিলিয়ন মানুষ পরিবেশ-সম্পর্কিত প্রতিরোধযোগ্য কারণে মৃত্যুবরণ করে। এর মধ্যে প্রধান কারণ হলো দূষিত বায়ু, অনিরাপদ পানি, অপর্যাপ্ত স্যানিটেশন এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট তাপপ্রবাহ, বন্যা, ঘূর্ণিঝড় ও অগ্নিকাণ্ড জনস্বাস্থ্যকে নতুন মাত্রায় বিপন্ন করছে। এই প্রেক্ষাপটে পরিবেশ স্বাস্থ্য আর কেবল একটি জনস্বাস্থ্য বিষয় নয়, বরং বৈশ্বিক নীতিনির্ধারণ ও নিরাপত্তা আলোচনার অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়েছে।
বিশ্ব পরিবেশ স্বাস্থ্য দিবসের মাধ্যমে প্রতি বছর একটি নির্দিষ্ট থিম নির্ধারণ করা হয়, যা গবেষক ও নীতিনির্ধারকদের নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে সমস্যাটি পর্যালোচনা করতে সাহায্য করে। উদাহরণস্বরূপ, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে “One Health” ধারণা বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে, যেখানে মানুষ, প্রাণী ও পরিবেশের স্বাস্থ্যকে সমন্বিতভাবে বিবেচনা করা হয়। করোনাভাইরাস মহামারীর প্রেক্ষিতে এটি বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে, কারণ প্রাণী থেকে মানুষের মধ্যে সংক্রমিত রোগগুলো (zoonotic diseases) পরিবেশগত ভারসাম্যহীনতার সাথে নিবিড়ভাবে যুক্ত।
গবেষণার দৃষ্টিকোণ থেকে পরিবেশ স্বাস্থ্য বহুমাত্রিক একটি ক্ষেত্র। এখানে জীববিজ্ঞান, চিকিৎসাবিজ্ঞান, ভূগোল, নৃবিজ্ঞান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান এমনকি অর্থনীতির সাথেও ঘনিষ্ঠ সংযোগ রয়েছে। পরিবেশ দূষণের অর্থনৈতিক ক্ষতি যেমন বিশাল, তেমনি স্বাস্থ্যঝুঁকির কারণে উৎপাদনশীলতার হ্রাসও রাষ্ট্রীয় অর্থনীতিকে দুর্বল করে। এই বাস্তবতা থেকে বিশ্বব্যাপী “green economy” ও “sustainable development goals (SDGs)” ধারণার সাথে পরিবেশ স্বাস্থ্য বিষয়টিকে সম্পৃক্ত করা হয়েছে।
এছাড়া এ দিবসটি সামাজিক ন্যায়বিচারের প্রশ্নও উত্থাপন করে। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে দরিদ্র জনগোষ্ঠী সাধারণত পরিবেশ দূষণের সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী। তারা অনিরাপদ পানি পান করে, দূষিত বায়ুতে শ্বাস নেয় এবং স্বাস্থ্যসেবার অভাবে রোগাক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর ঝুঁকিতে থাকে। অন্যদিকে উন্নত দেশগুলোতে প্রযুক্তিগত অগ্রগতির মাধ্যমে অনেক সমস্যার সমাধান সম্ভব হলেও বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও পরিবেশ সংকটে তাদের ঐতিহাসিক অবদান অনস্বীকার্য। সুতরাং পরিবেশ স্বাস্থ্য কেবল বৈজ্ঞানিক গবেষণার ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ নয়, এটি এক অর্থে রাজনৈতিক, নৈতিক ও মানবাধিকারের প্রশ্নও।
অতএব, ২৬ সেপ্টেম্বরের বিশ্ব পরিবেশ স্বাস্থ্য দিবস কেবল প্রতীকী উদযাপন নয়, বরং এটি একটি একাডেমিক ও নীতি নির্ধারণমূলক ক্ষেত্রকে সমৃদ্ধ করার প্ল্যাটফর্ম। গবেষকরা এখানে পরিবেশ-স্বাস্থ্য সম্পর্কিত তথ্য, তত্ত্ব ও অভিজ্ঞতা বিনিময়ের সুযোগ পান। নীতিনির্ধারকরা নতুন কৌশল প্রণয়ন করতে পারেন, যা জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা পূরণে সহায়ক। সর্বোপরি, এটি সাধারণ মানুষকে সচেতন করে তোলে যে সুস্থ জীবনযাপন ও একটি স্বাস্থ্যকর পরিবেশ একই সূত্রে গাঁথা, এবং এই ভারসাম্য রক্ষায় প্রতিটি মানুষের ভূমিকা অপরিহার্য।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ২৬ সেপ্টেম্বর পালিত বিশ্ব পরিবেশ স্বাস্থ্য দিবস বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ, কারণ এটি আমাদের পরিবেশগত চ্যালেঞ্জ এবং জনস্বাস্থ্য ঝুঁকির মধ্যে গভীর সংযোগকে প্রতিফলিত করে। বিশ্ব ব্যাংকের ২০২৩ সালের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে, দেশে বায়ু দূষণ প্রতিবছর প্রায় ১,৫৯,০০০ অকাল মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায় এবং ২৫০ কোটি কর্মদিবসের সমান অসুস্থতার দিন তৈরি করে। এছাড়া, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO)-এর ২০২৩ সালের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বায়ু দূষণের কারণে বাংলাদেশের গড় আয়ুষ্কাল প্রায় ৬.৯ বছর হ্রাস পেয়েছে।
পরিসংখ্যানগতভাবে, ২০২৩ সালে দেশে ডেঙ্গু জ্বরের প্রাদুর্ভাব সর্বাধিক পর্যায়ে পৌঁছেছে, যেখানে ১,৭০৫ জনের মৃত্যু এবং ৩২১,০০০-এরও বেশি মানুষ আক্রান্ত হয়। এই মহামারী দীর্ঘমেয়াদী বর্ষাকাল, অপর্যাপ্ত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এবং জলাবদ্ধতার কারণে তীব্র আকার নিয়েছে।
পরিবেশগত স্বাস্থ্য সংকটের মধ্যে জল, স্যানিটেশন ও স্বাস্থ্যবিধি (WASH) সম্পর্কিত অবস্থা আরও উদ্বেগজনক। ইউনিসেফের ২০২৩ সালের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের ৩.৩ মিলিয়ন মানুষ এখনও নিরাপদ পানি থেকে বঞ্চিত, এবং ৭০ মিলিয়ন মানুষ অপর্যাপ্ত স্যানিটেশন ব্যবস্থার কারণে স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছে। এই অবস্থা ডায়রিয়া, কলেরা এবং অন্যান্য পানিবাহিত রোগের প্রাদুর্ভাব বাড়িয়ে তুলছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবও দেশের পরিবেশগত স্বাস্থ্য সংকটে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছে। ১৯৮০ সাল থেকে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ১.১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পেয়েছে, এবং "ফিলস লাইক" তাপমাত্রা ৪.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়েছে, যা ডায়রিয়া, শ্বাসযন্ত্রের রোগ, ক্লান্তি এবং মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার বৃদ্ধি ঘটিয়েছে। ২০২৪ সালে তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে প্রায় ১.৮ বিলিয়ন ডলারের অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছে এবং ২৫ মিলিয়ন কর্মদিবসের ক্ষতি ঘটেছে।
এই পরিসংখ্যানগুলো স্পষ্টভাবে প্রমাণ করে যে, বাংলাদেশে পরিবেশগত স্বাস্থ্য সংকট কতটা বিস্তৃত ও গভীর। ২৬ সেপ্টেম্বরের এই দিবস আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, পরিবেশগত ঝুঁকি ও জনস্বাস্থ্য সমস্যার মধ্যে অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক রয়েছে এবং এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সমন্বিত ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা অত্যাবশ্যক।
২৬ সেপ্টেম্বর পালিত বিশ্ব পরিবেশ স্বাস্থ্য দিবস (World Environmental Health Day) বিশ্বের জনগণকে স্মরণ করিয়ে দেয় যে পরিবেশগত ঝুঁকি মানুষের স্বাস্থ্যকে কতটা গভীরভাবে প্রভাবিত করে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO)-এর তথ্য অনুযায়ী, প্রতিবছর প্রায় ১৩ মিলিয়ন মানুষ পরিবেশ-সম্পর্কিত প্রতিরোধযোগ্য কারণে মৃত্যুবরণ করে, যার মধ্যে ৯০% মানুষ উন্নয়নশীল দেশে বসবাস করে। দূষিত বায়ু, অনিরাপদ পানি, অপর্যাপ্ত স্যানিটেশন এবং রাসায়নিক ও হোস্টাইল পরিবেশজনিত উপাদানগুলো শিশু, বৃদ্ধ ও স্বাস্থ্যহীন জনগোষ্ঠীর জন্য সবচেয়ে বড় ঝুঁকি তৈরি করে। এই দিবসটি মূলত আমাদেরকে সচেতন করে যে সুস্থ জীবনযাপন ও স্বাস্থ্যকর পরিবেশ একই সূত্রে গাঁথা, এবং বিশ্বের প্রতিটি দেশ ও সমাজকে এই সংযোগকে নীতি, পরিকল্পনা ও ব্যক্তিগত জীবনযাপনের কেন্দ্রবিন্দুতে রাখতে হবে।
২৬ সেপ্টেম্বর পালিত বিশ্ব পরিবেশ স্বাস্থ্য দিবস আমাদের জন্য একটি দিকনির্দেশনা হিসেবে কাজ করে যে, পরিবেশ এবং জনস্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য অবিলম্বে সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণ অপরিহার্য। দেশের সকল পর্যায়ে শক্তিশালী নীতি প্রণয়ন, দূষণ নিয়ন্ত্রণ এবং পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, নিরাপদ পানি সরবরাহ, স্যানিটেশন ও স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা উন্নত করতে হবে। জনসচেতনতা বৃদ্ধি, কমিউনিটি-ভিত্তিক উদ্যোগ এবং শিক্ষার মাধ্যমে মানুষকে পরিবেশ ও স্বাস্থ্য সংরক্ষণের কার্যকর ভূমিকা নিতে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। পাশাপাশি, জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবেলায় প্রাকৃতিক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা এবং টেকসই নগরায়ন নিশ্চিত করতে হবে। মূলত, সরকারের নীতি, স্থানীয় প্রশাসন, নাগরিক সমাজ এবং ব্যক্তিগত উদ্যোগ—এই চারটি স্তরের সমন্বয়েই বাংলাদেশের পরিবেশ স্বাস্থ্য সংকট দূরীকরণ সম্ভব। এই দৃষ্টিকোণ থেকে, বিশ্ব পরিবেশ স্বাস্থ্য দিবস শুধুমাত্র স্মরণীয় দিন নয়, বরং কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের এক আন্তর্জাতিক আহ্বান।
লেখক : গণমাধ্যমকর্মী।