অর্থনীতি ও সংস্কৃতিকে সচল রাখার শক্তি: বাংলাদেশের পর্যটন খাত

ওয়াজেদুর রহমান কনক
পর্যটন খাত আধুনিক বিশ্বে শুধু বিনোদন বা ভ্রমণের অভিজ্ঞতাই নয়, বরং অর্থনীতি, সংস্কৃতি, পরিবেশ ও সমাজের বহুমাত্রিক বিকাশের অন্যতম চালিকা শক্তি। এই খাত বিশ্ব অর্থনীতিতে ট্রিলিয়ন ডলারের অবদান রাখে, লক্ষ-কোটি মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে এবং প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে শুরু করে শহরের কেন্দ্র পর্যন্ত স্থানীয় অর্থনীতিকে সচল রাখে। পাশাপাশি পর্যটন জাতিগুলোর মধ্যে সাংস্কৃতিক বিনিময় ঘটায়, ঐতিহ্য ও প্রকৃতির সংরক্ষণে প্রণোদনা জোগায় এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে আরও ঘনিষ্ঠ করে তোলে। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (SDGs) অর্জনেও পর্যটন বিশেষ ভূমিকা রাখছে—দারিদ্র্য হ্রাস, নারী ও তরুণদের কর্মসংস্থান বৃদ্ধি, জলবায়ু সচেতনতা এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধির মতো লক্ষ্য পূরণে এ খাত কার্যকর অবদান রাখে। তাই পর্যটন খাতের গুরুত্ব কেবল ভ্রমণকারীর আনন্দের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; এটি জাতির উন্নয়ন, বৈশ্বিক সংযোগ এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি স্থিতিশীল ও সমৃদ্ধ পৃথিবী গড়ে তোলার সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত।
বিশ্ব পর্যটন দিবস প্রতিটি বছর ২৭ সেপ্টেম্বর পালিত হয়; এই তারিখটি নির্বাচিত হয়েছে কারণ ১৯৭০ সালের এই দিনে জাতিসংঘের পর্যটন সংস্থার (বর্তমানে UN Tourism/UNWTO) প্রতিষ্ঠাগত সংবিধি গৃহীত হয়েছিল এবং ১৯৮০ সাল থেকে এই দিনটি আন্তর্জাতিকভাবে পর্যটনের গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে উৎসর্গ করা হয়েছে। বিশ্বব্যাপী এই দিবসের প্রতিটি বছর একটি নির্দিষ্ট থিম থাকে যা সেই বছরের মূল বার্তা নির্ধারণ করে; ২০২৫ সালের থিম নির্ধারিত ছিল “Tourism and Sustainable Transformation” — অর্থাৎ পর্যটনকে স্থায়িত্বের পথে রূপান্তরিত করার ইস্যুকে কেন্দ্রে রেখে বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করা।
পর্যটন শিল্পের পরিসংখ্যানগত গুরুত্ব অতুলনীয়। কোভিড-১৯ মহামারীর পরে দ্রুত পুনরুদ্ধারের ধারায় ২০২৪ সালে আন্তর্জাতিক পর্যটক সংখ্যা আনুমানিক ১.৪০০.০০০.০০০ (এক দশমিক চার বিলিয়ন) পৌঁছায়, যা ২০২৩ সালের তুলনায় প্রায় ১১% বৃদ্ধি এবং ২০১৯ সালের প্রাক-মহামারি পর্যায়ের প্রায় ৯৯% মাপের সমতুল্য ছিল; অনেক গন্তব্য ২০১৯ সালের সংখ্যাকে ছাড়িয়েছে। ২০২৫ সালের প্রথম প্রান্তিকে (Q1) আন্তর্জাতিক আগমন ২০২৪ সালের একই পর্যায়ের তুলনায় প্রায় ৫% বৃদ্ধি পেয়েছে এবং ওইক্ষেত্রে বিশ্বব্যাপী বড় উৎসব/সামুদ্রিক মরসুম সহ অন্যান্যে অব্যাহত চাহিদা লক্ষণীয় ছিল। এই পুনরুদ্ধার বিশ্বজুড়ে অর্থনীতিতে সজীবতা ফিরিয়ে এনেছে, স্থানীয় আয়ের ধারাকে সমর্থন করেছে এবং গ্লোবাল ভ্যালু চেইনে (hospitality, transport, recreations, supply chains) কার্যক্রম বাড়িয়েছে।
অর্থনৈতিক প্রভাব পরিসংখ্যান বলছে, পর্যটন শুধু ‘পর্যটক’ নয় বরং কর্মসংস্থান ও জিডিপি-র জন্যও বড় উৎস: ২০২৪ সালে ট্রাভেল অ্যান্ড ট্যুরিজম খাত সামগ্রিকভাবে প্রায় ১০.৯ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার পর্যন্ত গ্লোবাল জিডিপিতে অবদান রেখেছে এবং সেক্টরটি মোটামুটিভাবে ৩৫৭ মিলিয়ন লোককে কাজের সুযোগ দিয়েছে — অর্থাৎ বিশ্বের মোট কর্মসংস্থানের প্রায় ১-এ ১০ অংশের কাছাকাছি। একই রিপোর্টে বলা হয় যে অভ্যন্তরীণ ভ্রমণকারীদের স্থানীয় খরচ ২০২৪ সালে প্রায় ৫.৩ ট্রিলিয়ন ডলার অতিক্রম করেছে; এগুলো দেশের রাজস্ব, কর আর ছোট ও মাঝারি ব্যবসা (SME)–এর কাছে সরাসরি অর্থ প্রবাহ নিশ্চিত করেছে এবং অনেক উন্নয়নশীল অঞ্চলে গরীবত্ব হ্রাসে ভূমিকা রেখেছে। এই মাপের অর্থনৈতিক ও কর্মসংস্থানের প্রভাব দেখায় কেন সরকার, বেসরকারি খাত ও সমুদায় সমাজ পর্যটন নীতি ও স্থায়িত্বমূলক মডেল নিয়ে এত গুরুত্ব দিয়ে কাজ করে।
পর্যটনের পুনরুদ্ধার ও প্রবণতা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় কিছু উল্লেখযোগ্য মোড়: আন্তর্জাতিক আগমন দ্রুত বাড়লেও প্রবণতার ভিন্নতা অঞ্চলভিত্তিক; ইউরোপ ও মেরুদণ্ডে পর্যটন ত্বরান্বিত হলেও এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের পূর্ণ পুনরুদ্ধার ধাপে ধাপে ঘটছে; উচ্চমাত্রার ভ্রমণ খরচ (inflation), জ্বালানি ও পরিবহন খরচ, ভিসা-নীতি পরিবর্তন, এবং ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনা ইত্যাদি কিছু অঞ্চলে গন্তব্যপছন্দ ও ভ্রমণের ক্ষুদ্রতর পরিবর্তন ঘটিয়েছে। একই সঙ্গে বর্তমান পর্যটকরা অতীতে যেখানে শুধু “দর্শন” করতেন, এখন অধিকাংশ ক্ষেত্রে টেকসই অভিজ্ঞতা, স্থানীয় সংস্কৃতি ও পরিবেশ রক্ষায় অংশগ্রহণ এবং ছোট উদ্যোক্তা-ভিত্তিক সেবা খোঁজার দিকে ঝুঁকছেন — ফলে ডিজিটাল বুকিং, অভিজ্ঞতা-ভিত্তিক ট্যুর, কম কার্বন পছন্দ এবং কম ভরসম্পন্ন (low-density) গন্তব্যগুলোর চাহিদা বেড়েছে। এই আচরণগত শিফট এবং অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার একসাথে পর্যটনকে কেবল ঘুরে এসে দেখার শিল্প থেকে সামাজিক-অর্থনৈতিক রূপান্তরকারী শক্তিতে পরিণত করছে। ([Pre Web UNWTO][2])
বিশ্ব পর্যটন দিবসের বার্তা ও নীতি নির্ধারণে UNWTO এবং অংশীদাররা নিয়মিত নীতিগত নির্দেশিকা, গবর্ন্যান্স কাঠামো ও প্রযুক্তি-নির্ভর সমাধান উপস্থাপন করে। গ্লোবাল ফোরাম ও রিপোর্ট থেকে মনে হয় যে আগামী এক দশকে (উদাহরণস্বরূপ ২০২৫–২০৩৪ পর্যায়ে) পর্যটন খাতের আর্থিক পরিধি আরও বাড়বে; কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম, ক্লায়মেট-রেজিলিয়েন্ট অবকাঠামো এবং টেকসই বিনিয়োগ এই বৃদ্ধির প্রধান চালক হবে। বিশ্ব অর্থনীতি ও কর্মসংস্থানে পর্যটনের অংশ আরও প্রসারিত হলে স্থানীয়ভাবে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের জন্য নতুন বাজার খুলবে, পর্যটক-নির্ভর এলাকার অবকাঠামো উন্নয়ন পাবে এবং সংস্কৃতি ও প্রাকৃতিক সম্পদের সংরক্ষণে উদ্দীপনা আসবে — তবে এটি সফল হবে কেবল যদি নীতি-নির্দেশনা, স্থানীয় অংশগ্রহণ, পরিবেশগত ঝুঁকি-প্রশমন ও সঠিক পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা একযোগে কাজ করে।
বাংলাদেশসহ বিকাশশীল দেশগুলোর জন্য বিশ্ব পর্যটন দিবস সেই উপলক্ষ্য হয়ে ওঠে যখন সরকার, স্থানীয় প্রশাসন ও কমিউনিটি একসাথে টেকসই পর্যটন পরিকল্পনা গ্রহণ করে: পর্যটনকে স্থানীয় অর্থনৈতিক উন্নয়নের টুল হিসেবে ব্যবহার করে কিভাবে মৌসুমি কর্মসংস্থান মারলে স্থায়ী কাজ সৃষ্টি করা যায়, বায়ু ও জলবায়ু ঝুঁকি মোকাবিলায় গন্তব্যকে কিভাবে প্রস্তুত করা যায়, এবং স্থানীয় সংস্কৃতি ও বাস্তুতন্ত্র রক্ষায় কী ধরনের বিনিয়োগ জরুরি—এই সব প্রশ্নে রাজনৈতিক অগ্রাধিকার নির্ধারণ করার জন্য ঐ দিনটি সেরা সময়। আন্তর্জাতিক ও জাতীয় পরিসংখ্যান যদি সঠিকভাবে বিশ্লেষণ ও প্রয়োগ করা যায়, তাহলে পর্যটন শুধু “ট্র্যাভেল ইন্ডাস্ট্রি” হিসেবে নয়, একটি বহুমুখী, স্থায়িত্বমুখী সার্বজনীন উন্নয়নের বাহক হিসেবে কাজ করতে পারে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বিশ্ব পর্যটন দিবসের তাৎপর্য বহুমাত্রিক। ভৌগোলিক বৈচিত্র্য, ঐতিহাসিক নিদর্শন, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং সংস্কৃতির সমৃদ্ধ মেলবন্ধনে বাংলাদেশ এমন একটি দেশ, যেখানে পর্যটন কেবল অর্থনৈতিক খাত নয়, বরং সামাজিক ও সাংস্কৃতিক রূপান্তরের অন্যতম হাতিয়ার হতে পারে। বিশ্বের বৃহত্তম সমুদ্র সৈকত কক্সবাজার, বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন, পাহাড়ি অঞ্চলের সবুজ বৈচিত্র্য, সিলেটের চা-বাগান, প্রাচীন শহর মহাস্থানগড় কিংবা পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার—এসব শুধু পর্যটকের আকর্ষণ নয়, বরং দেশের আন্তর্জাতিক পরিচয়কে সমৃদ্ধ করার সম্পদ। ফলে ২৭ সেপ্টেম্বর পালিত বিশ্ব পর্যটন দিবস বাংলাদেশের জন্য পর্যটন সম্ভাবনা মূল্যায়ন, পরিকল্পনা ও নীতি প্রণয়নের একটি কৌশলগত সময়চিহ্ন হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়।
অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে পর্যটন বাংলাদেশের জিডিপিতে সরাসরি ও পরোক্ষ অবদান রাখে। বাংলাদেশ ব্যাংক ও পর্যটন বোর্ডের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, আন্তর্জাতিক পর্যটক আগমনের সংখ্যা এখনও প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় কম হলেও গত কয়েক বছরে প্রবৃদ্ধির ইঙ্গিত পাওয়া গেছে। দেশীয় পর্যটন—অর্থাৎ বাংলাদেশের নাগরিকদের অভ্যন্তরীণ ভ্রমণ—স্থানীয় অর্থনীতির ওপর উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলে। কক্সবাজার, সিলেট, সেন্টমার্টিন, বান্দরবান কিংবা সোনাদিয়া দ্বীপের মতো গন্তব্যগুলোতে মৌসুমভিত্তিক পর্যটন স্থানীয় হোটেল-রেস্টুরেন্ট, পরিবহন, ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা ও হস্তশিল্প খাতকে উজ্জীবিত করে। বিশ্ব পর্যটন দিবস এ প্রসঙ্গে মনে করিয়ে দেয় যে এই প্রবাহকে কেবল মৌসুমী নয়, বরং টেকসই আকারে রূপান্তর করতে হলে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা অপরিহার্য।
পরিবেশগত প্রেক্ষাপটে পর্যটন বাংলাদেশের জন্য একদিকে সম্ভাবনা, অন্যদিকে চ্যালেঞ্জ। সুন্দরবনের ইকো-ট্যুরিজম কিংবা পাহাড়ি এলাকার অ্যাডভেঞ্চার ট্যুরিজম জনপ্রিয় হলেও, অবকাঠামোগত চাপ, প্লাস্টিক বর্জ্য, বন উজাড় এবং অনিয়ন্ত্রিত পর্যটন পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর হয়ে দাঁড়াতে পারে। বিশ্ব পর্যটন দিবস এই প্রেক্ষাপটে টেকসই পর্যটনের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে জনসচেতনতা তৈরি করে। জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য ভঙ্গুর উপকূলীয় অঞ্চলগুলো পর্যটনকে অর্থনৈতিক বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করতে পারে, তবে তার সঙ্গে পরিবেশ সংরক্ষণের নিশ্চয়তা থাকতে হবে।
সাংস্কৃতিক দিক থেকেও বাংলাদেশের পর্যটন খাতের প্রসার দেশের ঐতিহ্য ও পরিচয়কে নতুনভাবে উপস্থাপন করার সুযোগ তৈরি করে। নকশিকাঁথা, জামদানি, লোকসংগীত বা মঙ্গল শোভাযাত্রার মতো ইউনেস্কো স্বীকৃত ঐতিহ্য বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক পর্যটনের ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করেছে। বিশ্ব পর্যটন দিবস এ ধরনের সম্পদের সঠিক ব্যবহারের বার্তা দেয়, যাতে এগুলো শুধুমাত্র স্থানীয় পর্যায়ে সীমাবদ্ধ না থেকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দেশের পরিচিতি ও মর্যাদা বাড়াতে ভূমিকা রাখে।
সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে পর্যটন নতুন প্রজন্মকে তাদের নিজস্ব ইতিহাস, সংস্কৃতি ও পরিবেশ সম্পর্কে জানতে সাহায্য করে এবং একই সঙ্গে বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গি অর্জনের সুযোগ দেয়। গ্রামীণ পর্যটন বা কমিউনিটি-বেইজড ট্যুরিজম গ্রামাঞ্চলের মানুষের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে পারে, বিশেষ করে নারী উদ্যোক্তাদের অংশগ্রহণ বাড়াতে সহায়ক হতে পারে। এই দিক থেকে বিশ্ব পর্যটন দিবস শুধু অর্থনৈতিক নয়, সামাজিক অন্তর্ভুক্তি ও সমতাপূর্ণ উন্নয়নের ধারণাকেও শক্তিশালী করে।
সব মিলিয়ে বলা যায়, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বিশ্ব পর্যটন দিবস কেবল একটি আন্তর্জাতিক পালনের দিন নয়, বরং একটি নীতিগত নির্দেশনা—কিভাবে পর্যটন খাতকে অর্থনীতি, পরিবেশ, সংস্কৃতি ও সমাজের সঙ্গে সমন্বয় করে উন্নয়নের টেকসই পথে পরিচালিত করা যায়। এটি সেই উপলক্ষ্য যেখানে সরকার, বেসরকারি খাত ও নাগরিক সমাজ একসাথে ভাবতে পারে, পর্যটনকে কীভাবে দেশের উন্নয়নের প্রধান স্তম্ভগুলোর একটি হিসেবে রূপান্তরিত করা যায়। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সাম্প্রতিক আয়, কর্মসংস্থান ও আন্তর্জাতিক তুলনা নিয়ে বিশ্লেষণটি নিচে ধারাবাহিকভাবে উপস্থাপন করলাম — পয়েন্ট-হারের পরিবর্তে সম্পৃক্ত অনুচ্ছেদে।
বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক পর্যটক আগমন ও পর্যটন-রাজস্বের সাম্প্রতিক চিত্রকে একটি ‘উত্থান কিন্তু অনতিদূর থেকেই’ হিসেবে বর্ণনা করা যায়; ২০২৪ সালে দেশের কাছে রিপোর্টকৃত বিদেশি পর্যটক আগমন আনুমানিক ছয়-লক্ষ পেরোনোর কথা সংবাদমাধ্যমে উল্লেখ করা হয়েছে, যা মহামারীর পর পুনরুদ্ধারের একটি দৃশ্যমান লক্ষণ হলেও ২০১৯ সালের প্রাক-মহামারি স্তরের তুলনায় এখনো অনেকে পিছিয়ে আছে। এই সীমিত আন্তর্জাতিক আগমনই দেশের পর্যটন-রাজস্বকে সীমাবদ্ধ রাখছে; কিছু প্রতিবেদন ২০২৪ সালে বিদেশি পর্যটন আয়ের সামান্য পতনের ইঙ্গিত দেয়, যা নীতিগত দুর্বলতা, ভিসা-সহজতা, নিরাপত্তা ও মৌসুমী ঝড়বৃষ্টিসহ প্রাকৃতিক কারণে প্রভাবিত হয়েছে। ([Dhaka Tribune][1])
অর্থনৈতিকভাবে বিশ্বব্যাপী পর্যটন খাত দ্রুত পুনরুদ্ধার করলেও বাংলাদেশের অংশ তুলনামূলকভাবে ছোট—বিশ্বব্যাপী ট্রাভেল অ্যান্ড ট্যুরিজম ২০২৪ সালে প্রায় ১০.৯ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার অবদান করেছে এবং এই শিল্পটি প্রায় ৩৫৭ মিলিয়ন মানুষের জন্য কাজ সরবরাহ করে; সেটির পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের মোট পর্যটন আয়ের পরিমাণ ও আন্তর্জাতিক অংশ-গ্রহণ অনেকটাই সীমিত ও নিম্নতর। ফলে বিশ্ব পর্যটন বাজারের পুনরুদ্ধার থেকে বাংলাদেশ যে পরিমাণ সুবিধা পেতে পারছে, তা প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় কম। এই ব্যবধান সম্ভবত অবকাঠামো, আন্তর্জাতিক প্রচারণার অভাব, ভিসা ও কনেক্টিভিটি সীমাবদ্ধতা ও ভূ-রাজনৈতিক/আভ্যন্তরীণ অবস্থা সম্পর্কিত ঝুঁকির ফলে সৃষ্টি। পূর্ণ কিন্তু আংশিক সুযোগ: অভ্যন্তরীণ পর্যটন স্থানীয় কর্মসংস্থান ও ছোট উদ্যোক্তা-উঠানকে জীবন্ত রাখে—হোটেল, পরিবহন, খাদ্যসেবা, হস্তশিল্প ও গাইডিং ইত্যাদি। তথাপি আন্তর্জাতিক পর্যটন থেকে সৃষ্ট সরাসরি বৈদেশিক মুদ্রা প্রবাহ সীমিত হওয়ায় সেই কর্মসংস্থানের আকার ও বৈশ্বিক মানদণ্ডে দক্ষতার প্রসার এখনও সংকীর্ণ। আন্তর্জাতিক সংস্থা ও গবেষণায় বয়সভিত্তিক, মৌসুমভিত্তিক এবং নারী-ভিত্তিক কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়ানোর উপর গুরুত্বারোপ করা হচ্ছে; অর্থাৎ নীতি-উদ্দীপক ব্যবস্থা, প্রশিক্ষণ ও নারী-উদ্যোগী সমর্থনের মাধ্যমে দেশীয় পর্যটন কর্মবাজারকে বড় করা যেতে পারে।
আন্তর্জাতিক তুলনায় অন্তর্দৃষ্টি দিলে স্পষ্ট হয় যে বাংলাদেশের চ্যালেঞ্জ ও সুযোগ উভয়ই স্পষ্ট। উদাহরণ স্বরূপ, স্পেন, মালয়েশিয়া বা থাইল্যান্ডের মতো গন্তব্যগুলো আন্তর্জাতিক পর্যটক আর্কষণে ব্যাপক সাফল্য বা দ্রুত পুনরুদ্ধার দেখিয়েছে — লক্ষ লক্ষ আঙ্গমন ও গুণগত পর্যটন আয় সেখানে উদাহরণীয়। অন্যদিকে বাংলাদেশে পর্যটন-সংক্রান্ত আয় ও আগমন তুলনামূলকভাবে সামান্য; তবে দেশের ভৌগোলিক ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য—কক্সবাজার, সুন্দরবন, পাহাড়ি অঞ্চল, চা-বাগান, ঐতিহাসিক নিদর্শন—একশ্রেণির ‘আকর্ষণ-বহুল’ সামগ্রীর প্রতিনিধিত্ব করে, যা যদি যোগাযোগ, ভিসা-সহজতা, দিকনির্দেশিত আন্তর্জাতিক প্রচারণা ও টেকসই ব্যবস্থাপনার সঙ্গে জোড়া দেওয়া হয়, তাহলে দ্রুত বৃদ্ধি সম্ভব। সাম্প্রতিক সময়ে নির্দিষ্ট অঞ্চলে বন্যা, রাজনৈতিক অস্থিরতা ও নিরাপত্তা ইস্যু পর্যটক সিদ্ধান্তে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে—এই ঝুঁকিগুলো নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে আন্তর্জাতিক তুলনায় বাংলাদেশের অংশদারিত্ব বাড়ানো কঠিন।
নীতিনির্ধারণ ও বিনিয়োগের অর্থনৈতিক প্রভাবের দিক থেকে দুটি বাস্তব ও অবিলম্বে কর্মযোজনীয়তা স্পষ্ট: (১) অভ্যন্তরীণ পর্যটনকে “বর্ধিত, বরাবর চলমান আয়”–এ রূপান্তর করতে মৌলিক অবকাঠামো, স্যানিটেশন, ডিজিটাল বুকিং-সুবিধা ও প্রশিক্ষণে বিনিয়োগ এবং (২) আন্তর্জাতিক পর্যটক আকর্ষণে ভিসা-সহজতা, নিরাপত্তা-বান্ধব নীতি, লক্ষ্যভিত্তিক মার্কেটিং ও অ্যাভিয়েশন সংযোগ বাড়ানো। এই উদ্যোগগুলো টেকসইভাবে নেওয়া হলে পর্যটন-আয় ও কর্মসংস্থান ধাপে ধাপে বাড়বে এবং বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পে বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় স্থান তৈরি হবে। এই পরিকল্পনাগুলো বাস্তবে রূপ পেলে ২০২০ এর পরের বিশ্বব্যাপী পর্যটন পুনরুদ্ধারের সুযোগকে অনুকরণ করে দেশের জন্য দ্রুত উন্নয়ন সম্ভব।
বাংলাদেশে পর্যটন খাতের সাম্প্রতিক আয় ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধি লক্ষণীয় হলেও আন্তর্জাতিক তুলনায় এটা সীমিত; স্থায়িত্ব ও আয় বাড়াতে অবকাঠামো উন্নয়ন, নিরাপত্তা ও ভিসা-নীতির উদারীকরণ, লক্ষ্যবস্তু আন্তর্জাতিক প্রচারণা এবং স্থানীয় কমিউনিটি-ভিত্তিক টেকসই উদ্যোগ একযোগে দরকার। তাহলে এই খাত দেশের জন্য শুধু মৌসিক আয় নয়—দীর্ঘমেয়াদী কর্মসংস্থান ও স্থানীয় উন্নয়নের শক্তি—উভয়ই হতে পারে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে পর্যটন খাতের গুরুত্ব অত্যন্ত ব্যাপক ও বহুমাত্রিক। দেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, ঐতিহাসিক নিদর্শন, সমৃদ্ধ সংস্কৃতি ও বৈচিত্র্যময় জীবনধারা পর্যটকদের আকর্ষণ করে। কক্সবাজারের দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত, সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য, সিলেটের চা-বাগান, পাহাড়ি অঞ্চলগুলোর নৈসর্গিক দৃশ্য, এবং প্রাচীন বৌদ্ধবিহারগুলো দেশের পর্যটন সম্ভাবনাকে বিশ্বমঞ্চে তুলে ধরছে।
অর্থনৈতিক দিক থেকে, পর্যটন খাত দেশের জিডিপিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখছে। ২০২৩ সালে বিদেশি পর্যটক আগমন প্রায় ৬.৫ লাখে পৌঁছায়, যা মহামারী পূর্ববর্তী স্তরের তুলনায় বৃদ্ধি পেয়েছে।তবে, ২০২৪ সালে বিদেশি পর্যটন আয় ৪৪০ মিলিয়ন ডলারে নেমে আসে, যা পূর্ববর্তী বছরের ৪৫৩ মিলিয়ন ডলারের তুলনায় কিছুটা কমেছে।
কর্মসংস্থানের দিক থেকেও পর্যটন খাত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। ২০২৩ সালে এই খাতে প্রায় ১৭ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে, যা দেশের মোট কর্মশক্তির প্রায় ৪.২%। তবে, এই খাতে আরও দক্ষতা ও প্রশিক্ষণের প্রয়োজন রয়েছে, যাতে কর্মসংস্থানের গুণগত মান উন্নত হয়।
আন্তর্জাতিক তুলনায়, বাংলাদেশ পর্যটন খাতে এখনও উন্নয়নশীল অবস্থায় রয়েছে। প্রতিবেশী দেশ থাইল্যান্ড ২০২৫ সালের প্রথম নয় মাসে প্রায় ২৩.৪৫ মিলিয়ন বিদেশি পর্যটক আকর্ষণ করেছে, যা বাংলাদেশের তুলনায় অনেক বেশি।
তবে, বাংলাদেশের পর্যটন খাতের উন্নতির জন্য অবকাঠামোগত উন্নয়ন, নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার, আন্তর্জাতিক প্রচারণা বৃদ্ধি এবং টেকসই পর্যটন নীতি গ্রহণ অত্যন্ত জরুরি। সর্বোপরি, পর্যটন খাত বাংলাদেশের অর্থনীতি, সংস্কৃতি ও সমাজের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। এই খাতের সঠিক ব্যবস্থাপনা ও উন্নয়ন দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে অবদান রাখতে সক্ষম।
লেখক : গণমাধ্যমকর্মী।