আবীর আহাদ


বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় আওয়ামী লীগ শুধু একটি দল নয়, বরং মুক্তিযুদ্ধ, গণতন্ত্র, প্রগতি ও স্থিতিশীল রাষ্ট্রচেতনার প্রধান প্রতীক। দলীয় বিবেচনায়ও এ দলের ভোটার সংখ্যা সর্বাধিক। ফলে দেশের রাজনৈতিক ভারসাম্যেও এ-দলের গুরুত্ব অনেক বেশি। এমন একটি শক্তিকে রাজনীতি ও নির্বাচন থেকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হলে তা কেবল নির্বাচনের প্রতিদ্বন্দ্বিতার প্রশ্নেই সীমাবদ্ধ থাকবে না, বরং দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা, সামাজিক ভারসাম্য এবং আঞ্চলিক ভূরাজনীতিকেও গভীরভাবে প্রভাবিত করবে।

নিষিদ্ধ-আওয়ামী ভোটারদের অচলাবস্থা

আওয়ামী লীগের ভোটাররা ঐতিহাসিকভাবে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তি ও প্রগতিশীল রাজনীতির ধারক।বিএনপি তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়, কারণ এ দলকে তারা দেখেছেন আওয়ামী নেতৃত্ব ও কর্মীদের বিরুদ্ধে সংঘাত, হামলা, মামলা ও রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চালাতে।

আদর্শগতভাবে বিএনপিকে তারা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতকারী, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী ও সুযোগসন্ধানী শক্তির বাহন বলে মনে করে। জামায়াত কিংবা নব্য-ইসলামপন্থী প্ল্যাটফর্ম এনসিপিকেও তারা মুক্তিযুদ্ধবিরোধী বলেই চিহ্নিত করে। অতএব, আওয়ামী ভোটারদের সামনে তিনটি সম্ভাবনা তৈরি হবে:

১. আওয়ামী লীগের অংশ থেকে উদ্ভূত নতুন প্ল্যাটফর্মে ভরসা খোঁজা,

২. আঞ্চলিক বা স্বতন্ত্র প্রার্থীর দিকে ঝোঁকা,

৩. অথবা সরাসরি ভোট বর্জন।

এমন পরিস্থিতি সরাসরি নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে এবং গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতি জনগণের আস্থা নষ্ট করবে।

অভ্যন্তরীণ প্রভাব

বিএনপির সাময়িক সুবিধা: আওয়ামী লীগ না থাকলে বিএনপি আপাতত সুবিধাজনক অবস্থানে যাবে। তবে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তির সঙ্গে তাদের ঐতিহাসিক সখ্য দীর্ঘমেয়াদে চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে।

মুক্তিযুদ্ধের ধারার ক্ষয়: আওয়ামী লীগ ছাড়া সংসদ বা রাজনীতির কেন্দ্র থেকে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক আদর্শ দুর্বল হয়ে পড়বে। এতে রাষ্ট্রচিন্তায় ভারসাম্যহীনতা তৈরি হবে।

সামাজিক বিভাজন: আওয়ামী ভোটারদের হতাশা ও রাজনৈতিক বিমুখতা গণতান্ত্রিক অংশগ্রহণকে দুর্বল করে তুলবে।

আঞ্চলিক ভূরাজনীতি

আওয়ামী লীগের অনুপস্থিতিসৃষ্ট বাংলাদেশের রাজনীতির অচলাবস্থা কেবল অভ্যন্তরীণ সংকট নয়; বরং দক্ষিণ এশীয় ভূরাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গও বটে।

১. ভারতের অবস্থান: ভারত ঐতিহাসিকভাবেই আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ মিত্র। আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ হলে ভারত গভীর সংকটে পড়বে, কারণ দিল্লি তার সীমান্তনিরাপত্তা, সন্ত্রাস দমন ও আঞ্চলিক অর্থনৈতিক সহযোগিতার স্বার্থে আওয়ামী লীগের স্থিতিশীল শাসনকে নিরাপদ মনে করে এসেছে। বিএনপি-জামায়াতের সম্ভাব্য উত্থান ভারতকে কূটনৈতিক ও নিরাপত্তাজনিত চাপে ফেলতে পারে।

২. চীনের সুযোগ: রাজনৈতিক অচলাবস্থার সুযোগ নিয়ে চীন বাংলাদেশে তার প্রভাব বাড়াতে চাইবে। বিশেষ করে অবকাঠামো, বন্দর ও অর্থনৈতিক করিডর নির্মাণে বেইজিং এগিয়ে আসতে পারে। এতে বাংলাদেশের ওপর চীনের অর্থনৈতিক নির্ভরতা বাড়বে এবং আঞ্চলিক ভারসাম্য নষ্ট হবে।

৩. মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা: যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার ইস্যুতে চাপ সৃষ্টি করছে। আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ হলে ওয়াশিংটন এটিকে “গণতান্ত্রিক শূন্যতা পূরণের সুযোগ” হিসেবে দেখাতে পারে। তবে বাস্তবে, মার্কিন স্বার্থ মূলত ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে কৌশলগত ঘাঁটি ও প্রভাব বিস্তারকে ঘিরে। আওয়ামী লীগের অনুপস্থিতি তাদের নতুন রাজনৈতিক জোটের কাছে টেনে নিতে পারে।

৪. আঞ্চলিক ভারসাম্যহীনতা: বাংলাদেশে রাজনৈতিক ভারসাম্য নষ্ট হলে দক্ষিণ এশিয়ায় নতুন অস্থিতিশীলতা তৈরি হবে। যুক্তরাষ্ট্র-ভারত-চীন, এমনকি রাশিয়ার প্রতিদ্বন্দ্বিতা আরও তীব্র হবে। পাশাপাশি পাকিস্তান, মুক্তিযুদ্ধের পরাজয়ের প্রতিশোধস্পৃহায় জামায়াত ও মৌলবাদী শক্তিকে উৎসাহিত করতে পারে, যা বাংলাদেশকে সন্ত্রাসবাদ ও ধর্মীয় উগ্রবাদের নতুন ঝুঁকিতে ফেলবে।

৫. পাকিস্তানের সম্ভাব্য প্ররোচনা ও প্রতিশোধস্পৃহা: বাংলাদেশের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের অনুপস্থিতি পাকিস্তানের কাছে হবে এক কৌশলগত সুযোগ। মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী অপমানের প্রতিশোধস্পৃহা থেকে ইসলামি দল ও মৌলবাদী শক্তিকে উসকে দিয়ে তারা বাংলাদেশকে ভেতর থেকে দুর্বল করার চেষ্টা করতে পারে। পাকিস্তান আন্তর্জাতিক মঞ্চেও বাংলাদেশকে ভারতবিরোধী অবস্থানে ঠেলে দিতে চাইবে, যেন বাংলাদেশ মনে করে, “ভারতই আসল শত্রু, পাকিস্তান মহামিত্র।” এ ধরনের প্রচেষ্টা বাংলাদেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক ভারসাম্যকে নষ্ট করবে এবং সরাসরি ভারতের নিরাপত্তাকেও চ্যালেঞ্জ জানাবে। পরিণতিতে বাংলাদেশের স্থিতিশীলতা, উন্নয়ন ও নিরাপত্তাও হুমকিতে পড়তে পারে।

শেষ কথা

আওয়ামী লীগ ছাড়া নির্বাচন কেবল প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন হবে না; বরং বাংলাদেশের গণতন্ত্র, মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা- সবই প্রশ্নের মুখে পড়বে। অভ্যন্তরীণ ভোটার সংকট থেকে শুরু করে ভারত, চীন, যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তানের কৌশলগত টানাপোড়েন পর্যন্ত সবকিছুই ইঙ্গিত দিচ্ছে: আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা হলে তা বাংলাদেশের জন্য শুধু একটি রাজনৈতিক পরিবর্তন নয়; বরং এক গভীর ভূরাজনৈতিক সঙ্কটের দ্বার উন্মোচন করবে।

লেখক :মুক্তিযোদ্ধা লেখক ও বিশ্লেষক।