টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জনে প্রতিবন্ধকতা: বৈষম্য, অস্থিরতা, তথ্য সীমাবদ্ধতা

ওয়াজেদুর রহমান কনক
বিশ্বব্যাপী টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন বর্তমানে মানবজাতির অন্যতম জটিল চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিচ্ছে। ২০৩০ সালের এজেন্ডার অধীনে জাতিসংঘের নির্ধারিত ১৭টি টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (SDGs) এবং ১৬৯টি সূচক শুধু দারিদ্র্য ও ক্ষুধা হ্রাসের জন্য নয়, বরং স্বাস্থ্য, শিক্ষা, লিঙ্গ সমতা, পরিবেশ সুরক্ষা, অর্থনৈতিক বৃদ্ধি এবং ন্যায়সংগত সামাজিক কাঠামো নিশ্চিত করতেও অভিসন্ধি স্থাপন করেছে। কিন্তু সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে দেখা যায়, পৃথিবীর মোট সম্পদের প্রায় ৬০% শীর্ষ ১০% মানুষের হাতে কেন্দ্রীভূত, যা অর্থনৈতিক বৈষম্যকে গুরুতর মাত্রায় বাড়িয়ে তুলেছে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর উদাহরণে দেখা যায়, আয়ের অসম বন্টন শিক্ষার সুযোগ, স্বাস্থ্যসেবা এবং নারী ক্ষমতায়ন লক্ষ্যগুলোতে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। পাশাপাশি, আফ্রিকার সোমালিয়া ও দারফুরে দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এবং লাতিন আমেরিকার ভেনেজুয়েলার সংকট SDGs-এর বাস্তবায়নকে বাধাগ্রস্ত করেছে। উন্নয়নশীল দেশের তথ্য ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতাও লক্ষ্য অর্জনে সমস্যা সৃষ্টি করে; সাব-সাহারান আফ্রিকার অনেক দেশে স্বাস্থ্য ও শিক্ষার নির্ভরযোগ্য তথ্যের অভাব নীতি প্রণয়ন এবং কার্যকর বাস্তবায়নকে প্রভাবিত করছে। এই চ্যালেঞ্জগুলো শুধুমাত্র পৃথক নয়, বরং একে অপরের সঙ্গে আন্তঃসংযুক্ত, যেখানে অর্থনৈতিক বৈষম্য রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এবং তথ্য ব্যবস্থার দুর্বলতার সঙ্গে মিলিত হয়ে লক্ষ্য অর্জনের গতিকে মন্থর করে। আন্তর্জাতিক কেস স্টাডি প্রমাণ করে, সফল SDG বাস্তবায়নের জন্য অর্থনৈতিক বৈষম্য হ্রাস, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিতকরণ এবং তথ্যভিত্তিক পরিকল্পনার সমন্বিত কৌশল গ্রহণ অপরিহার্য।
SDGs-এর লক্ষ্য অর্জন প্রসঙ্গে চ্যালেঞ্জ ও প্রতিবন্ধকতা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, এ ক্ষেত্রে শুধু নীতিগত প্রচেষ্টা যথেষ্ট নয়; অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতাও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অর্থনৈতিক বৈষম্য SDGs বাস্তবায়নের পথে সবচেয়ে জোরালো প্রতিবন্ধকতা হিসেবে কাজ করে। বিশ্বব্যাপী ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে আয় এবং সম্পদের তীব্র বৈষম্য অনেক দেশকে লক্ষ্য পূরণের ক্ষেত্রে পিছিয়ে রাখে। অর্থনৈতিক বৈষম্য শুধুমাত্র ব্যক্তিগত জীবনে সীমাবদ্ধ থাকে না; এটি শিক্ষার সুযোগ, স্বাস্থ্যসেবা, সুরক্ষিত জীবন এবং সামাজিক নিরাপত্তার ক্ষেত্রে সামগ্রিক প্রভাব ফেলে। যার ফলে লক্ষ্যসমূহ যেমন দারিদ্র্য নির্মূল, ক্ষুধা হ্রাস বা মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা, প্রত্যাশিত রূপে প্রয়োগে বিলম্ব ঘটে।
টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (SDGs) অর্জনের পথে প্রতিবন্ধকতাগুলি কেবল তাত্ত্বিক ধারণা নয়; এগুলো বাস্তব জগতের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক কাঠামোর সঙ্গে নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত। অর্থনৈতিক বৈষম্য বিশ্বব্যাপী একটি বহুমাত্রিক চ্যালেঞ্জ, যা SDGs বাস্তবায়নের গতিকে উল্লেখযোগ্যভাবে প্রভাবিত করে। উদাহরণস্বরূপ, বিশ্বব্যাংকের ২০২৩ সালের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, পৃথিবীর মোট সম্পদের প্রায় ৬০% শীর্ষ ১০% মানুষের হাতে কেন্দ্রভূত, যেখানে নিম্ন আয়ের দেশগুলোতে দারিদ্র্য এবং ক্ষুধা হ্রাসে লক্ষ্যনীয় প্রগতি সীমিত। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের উদাহরণ অনুসারে দেখা যায়, আয়ের অভিন্নতা না থাকা শিক্ষার সমতা, স্বাস্থ্যসেবা এবং নারী ক্ষমতায়নের মতো SDG লক্ষ্যগুলোর প্রয়োগকে জটিল করে তোলে। অর্থনৈতিক বৈষম্য কেবল সম্পদের ভাগাভাগি সীমাবদ্ধ রাখে না; এটি সামাজিক ন্যায় ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাতেও প্রভাব ফেলে, যা দীর্ঘমেয়াদি নীতি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ তৈরি করে।
রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা SDGs বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবন্ধকতা। আফ্রিকার কিছু দেশ যেমন সোমালিয়া ও দারফুরে দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং সংঘাতের কারণে স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও পরিবেশ সম্পর্কিত লক্ষ্যগুলোতে প্রগতি মারাত্মকভাবে সীমিত। এসব দেশে প্রশাসনিক কাঠামোর দুর্বলতা এবং দুর্নীতি উন্নয়ন কর্মসূচি স্থায়ীভাবে পরিচালনা করতে ব্যর্থ হয়। লাতিন আমেরিকার ভেনেজুয়েলার উদাহরণও দেখায় যে রাজনৈতিক সংকট ও অর্থনৈতিক মন্দার সংমিশ্রণ স্বাস্থ্য, খাদ্য নিরাপত্তা এবং সামাজিক সুরক্ষায় ক্ষতি করে, যার প্রভাবে SDG বাস্তবায়ন প্রকল্পগুলো ব্যর্থ হয়। এমন পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রের নীতি প্রণয়ন ও সম্পদ বিনিয়োগ রাজনৈতিক চাপে সীমিত হয়, যার কারণে লক্ষ্য অর্জনের গতিসীমা হ্রাস পায়।
তথ্যের অভাব এবং পর্যাপ্ত ডেটার অনুপস্থিতি SDGs বাস্তবায়নে একটি প্রায় সর্বজনীন চ্যালেঞ্জ। উন্নয়নশীল দেশে সরকারি তথ্য সংগ্রহ ও স্ট্যাটিস্টিকাল ইনফ্রাস্ট্রাকচারের সীমাবদ্ধতা প্রকল্প পরিকল্পনা, মূল্যায়ন ও নীতি প্রণয়নে উল্লেখযোগ্য প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। উদাহরণস্বরূপ, সাব-সাহারান আফ্রিকার অনেক দেশে স্বাস্থ্য ও শিক্ষা সম্পর্কিত নির্ভরযোগ্য ডেটার অভাব রয়েছে, যা নীতি গ্রহণকারী কর্তৃপক্ষকে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে দেরি করায়। ইউরোপের তুলনায় এই দেশগুলোর তথ্য সংগ্রহ প্রক্রিয়ার ঘাটতি প্রায়শই আন্তর্জাতিক তুলনায় SDG প্রগ্রেস রিপোর্টে বড় ফাঁক সৃষ্টি করে।
আন্তর্জাতিক কেস স্টাডি দেখায় যে, চ্যালেঞ্জগুলো একে অপরের সঙ্গে আন্তঃসংযুক্ত। দক্ষিণ কোরিয়ার উদাহরণে দেখা যায় যে অর্থনৈতিক বৈষম্য হ্রাস ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার সঙ্গে সমন্বিত নীতি গ্রহণ SDG লক্ষ্য অর্জনে সহায়ক। তারা জাতীয় পর্যায়ে তথ্যভিত্তিক পরিকল্পনা ও দক্ষ প্রশাসনিক কাঠামো ব্যবহার করে শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং উদ্ভাবন ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি করেছে। অন্যদিকে, মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশ রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, অর্থনৈতিক বৈষম্য এবং ডেটার ঘাটির সংমিশ্রণে লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে। এই উদাহরণগুলো প্রমাণ করে যে, SDGs বাস্তবায়ন শুধুমাত্র নীতিগত উদ্যোগের ওপর নির্ভর করে না, বরং অর্থনৈতিক সমতা, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং তথ্যভিত্তিক পরিকল্পনার সমন্বিত কাঠামোর ওপর নির্ভরশীল।
বিশ্লেষণে দেখা যায় যে, এই প্রতিবন্ধকতাগুলোর সমাধান শুধুমাত্র অর্থনৈতিক বিনিয়োগ বা নীতি প্রণয়নে সীমাবদ্ধ নয়। এটি প্রয়োজন বহুমাত্রিক কৌশল, যা অর্থনৈতিক বৈষম্য হ্রাস, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা এবং তথ্য ও ডেটা ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করার ওপর কেন্দ্রীভূত। গ্লোবাল SDG ড্যাশবোর্ড, সিস্টেমস থিঙ্কিং এবং রিয়েল-টাইম ডেটা অ্যানালিটিক্সের মতো উদ্ভাবনী টুল ব্যবহার করে লক্ষ্য অর্জনের জন্য কার্যকর পরিকল্পনা গ্রহণ করা যায়। এছাড়া, আন্তর্জাতিক অংশীদারিত্ব, নীতি সমন্বয় এবং স্থানীয় সম্প্রদায়ের সম্পৃক্ততা অর্জনও অপরিহার্য।
এভাবে, অর্থনৈতিক বৈষম্য, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এবং তথ্যের অভাব একত্রিতভাবে SDGs অর্জনের পথে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দাঁড়িয়েছে, যা গবেষণা, নীতি প্রণয়ন এবং বাস্তবায়ন কৌশলের মাধ্যমে সমাধানযোগ্য। সফল উদাহরণগুলো দেখায় যে, সমন্বিত, তথ্যভিত্তিক এবং অংশীদারিত্বমুখী কৌশল SDG লক্ষ্য অর্জনে কার্যকর।
রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা SDGs বাস্তবায়নের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ। রাজনৈতিক সংকট, ক্ষমতার অস্থিরতা, দুর্নীতি এবং নীতি পরিবর্তনের ঘনঘন প্রবণতা একটি দেশের দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন পরিকল্পনাকে ব্যাহত করে। এমন পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক এবং প্রশাসনিক সংস্থান SDGs-এর লক্ষ্যগুলোতে বিনিয়োগের পরিবর্তে রাজনৈতিক সংকট মোকাবিলায় ব্যয় হয়। ফলস্বরূপ, নীতিগত উদ্যোগ থাকলেও বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় জটিলতা দেখা দেয় এবং প্রয়োজনীয় সমন্বয় সৃষ্টি হয় না।
তথ্যের অভাব বা পর্যাপ্ত তথ্য না থাকা SDGs-এর সঠিক মূল্যায়ন ও পরিকল্পনাকে সীমিত করে। উন্নয়ন সূচক নির্ধারণ এবং প্রগ্রেস পর্যবেক্ষণে উচ্চমানের, নির্ভরযোগ্য এবং সময়োপযোগী তথ্য অপরিহার্য। অনেক উন্নয়নশীল দেশে সরকারি তথ্য সংকলন, স্ট্যাটিস্টিকাল ইনফ্রাস্ট্রাকচার এবং ডেটা অ্যানালিটিক্সের অভাব লক্ষ্য করা যায়। তথ্যের ঘাটতি পরিকল্পনা প্রণয়ন, ফলাফল মূল্যায়ন এবং আন্তর্জাতিক তুলনামূলক বিশ্লেষণকে প্রভাবিত করে। এছাড়াও, তথ্য না থাকায় নীতিনির্মাতা ও বাস্তবায়নকারী সংস্থা প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে দেরি করে, যার কারণে উন্নয়নের গতি মন্থর হয়।
এই সব চ্যালেঞ্জ একে অপরের সঙ্গে আন্তঃসম্পর্কিত। অর্থনৈতিক বৈষম্য রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার একটি কারণ হতে পারে, আবার রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ডেটা সংগ্রহ ও নীতি বাস্তবায়নে প্রভাব ফেলে। তাই SDGs অর্জনের ক্ষেত্রে শুধুমাত্র নীতিগত প্রচেষ্টা নয়, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও তথ্যভিত্তিক বাস্তবতা বিবেচনা করে সমন্বিত কৌশল প্রণয়ন অত্যাবশ্যক।
টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (SDGs) অর্জনের পথে চ্যালেঞ্জ ও প্রতিবন্ধকতা: একটি গবেষণামূলক বিশ্লেষণ
টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (SDGs) অর্জন বিশ্বব্যাপী নীতি, পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের একটি জটিল প্রক্রিয়া। লক্ষ্যগুলোর সাফল্য শুধুমাত্র নীতিগত প্রচেষ্টা বা আন্তর্জাতিক চুক্তির উপর নির্ভরশীল নয়, বরং অর্থনৈতিক বৈষম্য, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এবং তথ্যের অভাবের মতো অন্তর্নিহিত প্রতিবন্ধকতার সঙ্গে নিবিড়ভাবে সংযুক্ত। এই গবেষণাপত্রে এই তিনটি প্রধান চ্যালেঞ্জের প্রভাব, আন্তঃসম্পর্ক এবং সম্ভাব্য সমাধানগুলি আন্তর্জাতিক উদাহরণ ও তুলনামূলক বিশ্লেষণের মাধ্যমে আলোচিত হয়েছে।
২০১৫ সালে জাতিসংঘ ২০৩০ এজেন্ডার অধীনে SDGs গৃহীত হয়, যেখানে ১৭টি লক্ষ্য এবং ১৬৯টি সূচক অন্তর্ভুক্ত। SDGs-এর মূল উদ্দেশ্য হলো দারিদ্র্য হ্রাস, ক্ষুধা নির্মূল, স্বাস্থ্য ও শিক্ষার মানোন্নয়ন, সমতা, সাশ্রয়ী শক্তি, জলবায়ু ও পরিবেশ সুরক্ষা। কিন্তু লক্ষ্যগুলো বাস্তবায়নের পথে নানান প্রতিবন্ধকতা বিদ্যমান। অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও তথ্যভিত্তিক চ্যালেঞ্জগুলো কেবল নির্দিষ্ট দেশ নয়, বরং বিশ্বব্যাপী SDGs বাস্তবায়নের জন্য গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলে।
বিশ্বব্যাংকের ২০২৩ সালের প্রতিবেদনে দেখা যায়, বিশ্বের মোট সম্পদের প্রায় ৬০% শীর্ষ ১০% মানুষের হাতে কেন্দ্রীভূত, যেখানে নিম্ন আয়ের দেশগুলোতে দারিদ্র্য হ্রাসে লক্ষ্যনীয় অগ্রগতি সীমিত। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশে আয়ের বৈষম্য শিক্ষার সমতা, স্বাস্থ্যসেবা এবং নারী ক্ষমতায়ন লক্ষ্যগুলোর প্রয়োগকে জটিল করে। অর্থনৈতিক বৈষম্য শুধুমাত্র সম্পদ বিতরণ সীমাবদ্ধ রাখে না; এটি সামাজিক ন্যায়, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং স্থানীয় নীতি বাস্তবায়নেও প্রভাব ফেলে। উদাহরণস্বরূপ, ভারতের কিছু অঙ্গরাজ্যে উচ্চ দারিদ্র্য হার এবং সম্পদের অসম বন্টন শিক্ষার মানোন্নয়ন ও স্বাস্থ্য সেবার সমতা অর্জনে বাধা সৃষ্টি করেছে।
রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা SDGs বাস্তবায়নের জন্য আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবন্ধকতা। আফ্রিকার সোমালিয়া ও দারফুরের দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক সংকট এবং সংঘাত স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও পরিবেশ সম্পর্কিত লক্ষ্যগুলোর অগ্রগতিকে মারাত্মকভাবে সীমিত করেছে। লাতিন আমেরিকার ভেনেজুয়েলা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকটের কারণে খাদ্য নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক সুরক্ষায় ব্যর্থ হয়েছে। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা প্রশাসনিক কাঠামোর দুর্বলতা এবং দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত হয়ে দীর্ঘমেয়াদি নীতি বাস্তবায়নকে বাধাগ্রস্ত করে।
উন্নয়নশীল দেশে পর্যাপ্ত তথ্য ও ডেটা না থাকা SDGs বাস্তবায়ন প্রক্রিয়াকে সীমিত করে। সাব-সাহারান আফ্রিকায় স্বাস্থ্য ও শিক্ষার নির্ভরযোগ্য ডেটার অভাব প্রকল্প পরিকল্পনা, মূল্যায়ন ও নীতি প্রণয়নে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। তথ্যের ঘাটি আন্তর্জাতিক তুলনায় SDG প্রগ্রেস রিপোর্টে বড় ফাঁক তৈরি করে। উদাহরণস্বরূপ, নাইজেরিয়ায় শিশু স্বাস্থ্য সূচক পর্যবেক্ষণ সম্পর্কিত ডেটার ঘাটি নীতি প্রণয়নে দেরি ঘটিয়েছে।
চ্যালেঞ্জগুলো একে অপরের সঙ্গে আন্তঃসংযুক্ত। অর্থনৈতিক বৈষম্য রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার একটি কারণ হতে পারে, আবার রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ডেটা সংগ্রহ ও নীতি বাস্তবায়নে প্রভাব ফেলে। দক্ষিণ কোরিয়ার উদাহরণ দেখায় যে অর্থনৈতিক বৈষম্য হ্রাস, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিতকরণ এবং তথ্যভিত্তিক নীতি গ্রহণের সমন্বয় SDG লক্ষ্য অর্জনে কার্যকর। অপরদিকে, মধ্যপ্রাচ্যের কিছু দেশ অর্থনৈতিক বৈষম্য, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এবং তথ্যের ঘাটির সমন্বয়ে লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে।
SDGs অর্জনের জন্য বহুমাত্রিক কৌশল অপরিহার্য। অর্থনৈতিক বৈষম্য হ্রাস, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা এবং তথ্য ও ডেটা ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গ্লোবাল SDG ড্যাশবোর্ড, সিস্টেমস থিঙ্কিং, রিয়েল-টাইম ডেটা অ্যানালিটিক্স এবং স্থানীয় সম্প্রদায়ের সম্পৃক্ততা SDG লক্ষ্য অর্জনে কার্যকর। আন্তর্জাতিক অংশীদারিত্ব ও নীতি সমন্বয়ও অপরিহার্য।
অর্থনৈতিক বৈষম্য, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এবং তথ্যের অভাব SDGs অর্জনের পথে মূল প্রতিবন্ধকতা হিসেবে প্রতিফলিত হয়েছে। গবেষণা, নীতি প্রণয়ন এবং বাস্তবায়ন কৌশলের মাধ্যমে এই চ্যালেঞ্জগুলো সমাধানযোগ্য। আন্তর্জাতিক কেস স্টাডি প্রমাণ করে যে সমন্বিত, তথ্যভিত্তিক এবং অংশীদারিত্বমুখী কৌশল SDG লক্ষ্য অর্জনে কার্যকর। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (SDGs) অর্জনের ক্ষেত্রে বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট ও বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্লেষণ করলে একটি জটিল চিত্র ফুটে ওঠে। জাতিসংঘের ২০২৩ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৫ সালের পর থেকে অগ্রগতি সত্ত্বেও ১৭টি লক্ষ্যের মধ্যে মাত্র ১২ শতাংশ লক্ষ্য সঠিক গতিতে এগোচ্ছে, প্রায় ৫০ শতাংশ মাঝপথে স্থবির হয়ে আছে এবং ৩০ শতাংশের বেশি ক্ষেত্রে অগ্রগতি একেবারেই হয়নি বা পশ্চাদপদতা দেখা দিয়েছে। বৈশ্বিক পরিসংখ্যানে দারিদ্র্য বিমোচনের ক্ষেত্রে কোভিড-১৯-এর প্রভাব স্পষ্ট; ২০২২ সালে বিশ্বব্যাপী চরম দারিদ্র্যের হার দাঁড়ায় প্রায় ৯.২ শতাংশ, যেখানে ২০১৯ সালে তা ছিল ৮.৫ শতাংশ। একইভাবে শিক্ষাক্ষেত্রে ২০২২ সালে প্রায় ২৪ কোটি শিশু স্কুলের বাইরে রয়ে গেছে, যা SDG-৪-এর জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।
আন্তর্জাতিক তুলনায় দেখা যায়, উত্তর ইউরোপীয় দেশগুলো—যেমন ফিনল্যান্ড, সুইডেন, নরওয়ে—SDGs সূচকে শীর্ষে রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ২০২৩ সালের Sustainable Development Report অনুযায়ী, ফিনল্যান্ডের SDG সূচক স্কোর ছিল ৮৬.৮, যেখানে বাংলাদেশ অর্জন করেছে প্রায় ৬৫.৯। বাংলাদেশের অগ্রগতি হয়েছে বিশেষ করে দারিদ্র্য হ্রাস (SDG-১), প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা (SDG-৩) এবং নারীর ক্ষমতায়ন (SDG-৫)-এ। তবে বৈষম্য হ্রাস (SDG-১০), মানসম্পন্ন শিক্ষা (SDG-৪), এবং পরিবেশ সংরক্ষণ (SDG-১৩)-এ অগ্রগতি তুলনামূলকভাবে পিছিয়ে রয়েছে।
এখানে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ তুলনা হলো দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশ। ভারতের SDG স্কোর ২০২৩ সালে দাঁড়িয়েছে ৬৩.৪, পাকিস্তানের ৫৭.৯ এবং শ্রীলঙ্কার ৬৮.১। অর্থাৎ, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ মধ্যম অবস্থানে রয়েছে। তবে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার ঘাটতি, নির্ভুল তথ্য সংগ্রহের সীমাবদ্ধতা এবং অর্থনৈতিক বৈষম্য বাংলাদেশের জন্য অগ্রযাত্রায় বড় বাধা হিসেবে কাজ করছে।
বৈশ্বিক পরিসংখ্যান স্পষ্ট করে যে, ২০৩০ সালের মধ্যে SDGs অর্জন করা অত্যন্ত কঠিন একটি লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবুও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা, তথ্য-নির্ভর নীতি প্রণয়ন এবং জাতীয় পর্যায়ে সমন্বিত প্রয়াসের মাধ্যমে বৈষম্য ও অস্থিতিশীলতা কমিয়ে আনা গেলে বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল দেশগুলো টেকসই উন্নয়নের দিকে এগোতে পারবে।
লেখক : গণমাধ্যমকর্মী।