ওয়াজেদুর রহমান কনক


বাংলাদেশ এমন একটি দেশ, যা জলবায়ু পরিবর্তনের সরাসরি প্রভাবের মুখোমুখি হয়ে টেকসই উন্নয়ন অর্জনের পথে এগিয়ে চলছে। ভৌগোলিক অবস্থান, নিম্নভূমি, ঘনবসতি ও প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণতা বাংলাদেশের জন্য জলবায়ু পরিবর্তনকে এক জটিল বাস্তবতা হিসেবে হাজির করেছে। গ্লোবাল ক্লাইমেট রিস্ক ইনডেক্স (Germanwatch, 2024) অনুযায়ী, জলবায়ু বিপর্যয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর তালিকায় বাংলাদেশ শীর্ষ ১০ দেশের একটি। উপকূলীয় অঞ্চলের প্রায় ৩ কোটি মানুষ নিয়মিত ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, বন্যা ও লবণাক্ততার হুমকিতে বসবাস করছে, যা তাদের জীবনযাপন, কৃষি, ও অর্থনৈতিক স্থিতি ক্রমশ অনিশ্চিত করে তুলছে।

কৃষিখাত বাংলাদেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড, কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে প্রতি বছর গড়ে ১.৫–২ শতাংশ হারে কৃষি উৎপাদন কমছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (BBS) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে ঘূর্ণিঝড় ও বন্যার কারণে প্রায় ২৫ লাখ কৃষক সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। একই সঙ্গে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে দক্ষিণাঞ্চলের বহু এলাকা বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়ছে। এর ফলে প্রতিবছর প্রায় ৭ লাখ মানুষ গ্রাম থেকে শহরে অভিবাসিত হচ্ছে, যা শহরায়ণ ও টেকসই নগর উন্নয়ন (SDG 11) বাস্তবায়নে নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে।

এই বাস্তবতায় বাংলাদেশ সরকার ২০০৯ সালে *Bangladesh Climate Change Strategy and Action Plan (BCCSAP)* এবং ২০২১ সালে *Mujib Climate Prosperity Plan (MCPP)* গ্রহণ করেছে, যার লক্ষ্য হলো জলবায়ু সহনশীল অর্থনীতি ও টেকসই ভবিষ্যৎ গড়ে তোলা। কিন্তু অর্থায়ন, তথ্যের ঘাটতি ও নীতিগত সমন্বয়ের অভাবে এসব পরিকল্পনা এখনও পূর্ণরূপে কার্যকর হয়নি। তাই জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলা না করা গেলে দারিদ্র্য বিমোচন (SDG 1), খাদ্যনিরাপত্তা (SDG 2), স্বাস্থ্য (SDG 3), ও পরিবেশ সংরক্ষণ (SDG 13) লক্ষ্য অর্জন আরও কঠিন হয়ে পড়বে।

অতএব, টেকসই উন্নয়নের পথে বাংলাদেশের সাফল্য নির্ভর করছে কতটা দক্ষভাবে দেশটি জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলা করতে পারে এবং কতটা বাস্তবসম্মত নীতি, তথ্যনির্ভর পরিকল্পনা ও আন্তর্জাতিক সহায়তা কাজে লাগাতে পারে তার ওপর।

জলবায়ু পরিবর্তন ও টেকসই উন্নয়ন বাংলাদেশের উন্নয়নযাত্রার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্য বিষয়। ভৌগোলিক অবস্থান ও প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যের কারণে দেশটি বিশ্বে জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর একটি হিসেবে বিবেচিত। গ্লোবাল ক্লাইমেট রিস্ক ইনডেক্স (Germanwatch, 2024) অনুযায়ী, গত দুই দশকে বাংলাদেশ অন্তত ১৮২টি বড় জলবায়ুজনিত দুর্যোগের মুখোমুখি হয়েছে, যা দেশের অর্থনীতি, কৃষি, খাদ্যনিরাপত্তা, জনস্বাস্থ্য ও মানববসতিতে গভীর প্রভাব ফেলেছে। বিশেষত উপকূলীয় অঞ্চলের প্রায় ৩ কোটি মানুষ সরাসরি জলবায়ু ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে, যেখানে ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস ও লবণাক্ততা বৃদ্ধি জীবিকাকে অনিশ্চিত করে তুলছে।

বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ২০ শতাংশ মানুষ জীবিকার জন্য কৃষির ওপর নির্ভরশীল। অথচ জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে কৃষিজ উৎপাদন ব্যাপকভাবে হ্রাস পাচ্ছে। আন্তর্জাতিক খাদ্যনীতি গবেষণা ইনস্টিটিউট (IFPRI)-এর তথ্য অনুযায়ী, ২০৫০ সালের মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশের ধান উৎপাদন প্রায় ১৫–১৭ শতাংশ এবং গম উৎপাদন প্রায় ৩০ শতাংশ কমে যেতে পারে। এ অবস্থায় খাদ্যনিরাপত্তা অর্জনের লক্ষ্য (SDG 2) বাস্তবায়ন আরও কঠিন হয়ে পড়ছে। অন্যদিকে, IPCC (Intergovernmental Panel on Climate Change)-এর সর্বশেষ প্রতিবেদন জানায়, বাংলাদেশের গড় তাপমাত্রা প্রতি দশকে প্রায় ০.২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির হার বছরে গড়ে ৩.৮ মিলিমিটার, যা উপকূলীয় বাস্তুতন্ত্রের জন্য সরাসরি হুমকি।

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব কেবল কৃষিতেই সীমাবদ্ধ নয়; তা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতেও উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, জলবায়ুজনিত দুর্যোগের কারণে প্রতিবছর জিডিপির প্রায় ১.৫ থেকে ২ শতাংশ পর্যন্ত অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়। ২০২০ সালে ঘূর্ণিঝড় ‘আম্পান’ এককভাবে প্রায় ১১ বিলিয়ন ডলারের ক্ষতি সাধন করে। তাছাড়া, লবণাক্ততার কারণে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে প্রতি বছর প্রায় ২০ হাজার হেক্টর জমি কৃষিযোগ্যতা হারাচ্ছে, যার ফলে স্থানীয় জনগোষ্ঠী বাধ্য হচ্ছে শহরমুখী অভিবাসনে। পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে প্রতিবছর প্রায় ৬ থেকে ৭ লাখ মানুষ গ্রাম থেকে শহরে অভিবাসিত হচ্ছে, যা শহর পরিকল্পনা ও টেকসই নগর উন্নয়ন (SDG 11) বাস্তবায়নে নতুন সংকট তৈরি করছে।

স্বাস্থ্যক্ষেত্রেও জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব স্পষ্ট। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO)-এর তথ্য অনুসারে, বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে পানিবাহিত রোগ, ডায়রিয়া, এবং ম্যালেরিয়া বৃদ্ধির অন্যতম কারণ হচ্ছে জলবায়ুগত পরিবর্তন। তাপমাত্রা ও আর্দ্রতার ওঠানামা জনস্বাস্থ্যের জন্য বড় হুমকি তৈরি করছে। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত স্বাস্থ্যঝুঁকির কারণে ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যয় বছরে প্রায় ৫ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছাবে বলে অনুমান করা হচ্ছে।

এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ সরকার ২০০৯ সালে "Bangladesh Climate Change Strategy and Action Plan (BCCSAP)" এবং ২০২১ সালে "Mujib Climate Prosperity Plan (MCPP)" প্রণয়ন করেছে, যার লক্ষ্য হলো জলবায়ু সহনশীল অর্থনীতি ও সমাজ গঠন। তবে পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের মধ্যে এখনো ব্যবধান বিদ্যমান। সরকারি হিসাব অনুযায়ী, SDG অর্জনের জন্য বছরে প্রায় ৯.২ বিলিয়ন ডলার প্রয়োজন, কিন্তু বর্তমানে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক তহবিল মিলিয়ে অর্জিত অর্থ তার মাত্র ৬০ শতাংশেরও কম। Green Climate Fund (GCF) ও Adaptation Fund থেকে বরাদ্দ পাওয়া গেলেও প্রশাসনিক জটিলতা ও প্রকল্প ব্যবস্থাপনার ঘাটতির কারণে পূর্ণ সম্ভাবনা কাজে লাগানো সম্ভব হচ্ছে না।

বাংলাদেশের জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় অভিযোজন কৌশলগুলো যেমন—ভাসমান কৃষি, লবণ সহনশীল ফসল, এবং সাইক্লোন শেল্টার—বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত হলেও, এসব উদ্যোগের প্রসার এখনো অঞ্চলভেদে অসম। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়নে এই ধরনের অভিযোজন প্রযুক্তির জাতীয়করণ এবং স্থানীয় পর্যায়ে জনসম্পৃক্ততা অত্যন্ত জরুরি।

অতএব, জলবায়ু পরিবর্তন বাংলাদেশের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে এক বহুমাত্রিক চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। দারিদ্র্য বিমোচন (SDG 1), খাদ্যনিরাপত্তা (SDG 2), স্বাস্থ্য (SDG 3), পরিষ্কার পানি (SDG 6), টেকসই নগর (SDG 11) ও জলবায়ু কার্যক্রম (SDG 13)—প্রতিটি লক্ষ্যই জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত। উন্নয়ন পরিকল্পনায় তথ্যনির্ভর সিদ্ধান্ত, আন্তর্জাতিক জলবায়ু অর্থায়নের কার্যকর ব্যবহার, এবং স্থানীয় পর্যায়ে অভিযোজন সক্ষমতা বৃদ্ধি ছাড়া ২০৩০ সালের মধ্যে লক্ষ্য অর্জন সম্ভব নয়। বাংলাদেশের সাফল্য নির্ভর করছে তার জলবায়ু নীতি কতটা বাস্তবমুখী ও অন্তর্ভুক্তিমূলক হয়, এবং কতটা সমন্বিতভাবে জাতীয় উন্নয়ন কাঠামোর সঙ্গে একীভূত করা যায় তার ওপর।

বাংলাদেশ এমন একটি দেশ, যা জলবায়ু পরিবর্তনের সরাসরি প্রভাবের মুখোমুখি হয়ে টেকসই উন্নয়ন অর্জনের পথে এগিয়ে চলছে। ভৌগোলিক অবস্থান, নিম্নভূমি, ঘনবসতি ও প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণতা বাংলাদেশের জন্য জলবায়ু পরিবর্তনকে এক জটিল বাস্তবতা হিসেবে হাজির করেছে। গ্লোবাল ক্লাইমেট রিস্ক ইনডেক্স (Germanwatch, 2024) অনুযায়ী, জলবায়ু বিপর্যয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর তালিকায় বাংলাদেশ শীর্ষ ১০ দেশের একটি। উপকূলীয় অঞ্চলের প্রায় ৩ কোটি মানুষ নিয়মিত ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, বন্যা ও লবণাক্ততার হুমকিতে বসবাস করছে, যা তাদের জীবনযাপন, কৃষি, ও অর্থনৈতিক স্থিতি ক্রমশ অনিশ্চিত করে তুলছে।

কৃষিখাত বাংলাদেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড, কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে প্রতি বছর গড়ে ১.৫–২ শতাংশ হারে কৃষি উৎপাদন কমছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (BBS) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে ঘূর্ণিঝড় ও বন্যার কারণে প্রায় ২৫ লাখ কৃষক সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। একই সঙ্গে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে দক্ষিণাঞ্চলের বহু এলাকা বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়ছে। এর ফলে প্রতিবছর প্রায় ৭ লাখ মানুষ গ্রাম থেকে শহরে অভিবাসিত হচ্ছে, যা শহরায়ণ ও টেকসই নগর উন্নয়ন (SDG 11) বাস্তবায়নে নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে।

এই বাস্তবতায় বাংলাদেশ সরকার ২০০৯ সালে *Bangladesh Climate Change Strategy and Action Plan (BCCSAP)* এবং ২০২১ সালে *Mujib Climate Prosperity Plan (MCPP)* গ্রহণ করেছে, যার লক্ষ্য হলো জলবায়ু সহনশীল অর্থনীতি ও টেকসই ভবিষ্যৎ গড়ে তোলা। কিন্তু অর্থায়ন, তথ্যের ঘাটতি ও নীতিগত সমন্বয়ের অভাবে এসব পরিকল্পনা এখনও পূর্ণরূপে কার্যকর হয়নি। তাই জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলা না করা গেলে দারিদ্র্য বিমোচন (SDG 1), খাদ্যনিরাপত্তা (SDG 2), স্বাস্থ্য (SDG 3), ও পরিবেশ সংরক্ষণ (SDG 13) লক্ষ্য অর্জন আরও কঠিন হয়ে পড়বে।

অতএব, টেকসই উন্নয়নের পথে বাংলাদেশের সাফল্য নির্ভর করছে কতটা দক্ষভাবে দেশটি জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলা করতে পারে এবং কতটা বাস্তবসম্মত নীতি, তথ্যনির্ভর পরিকল্পনা ও আন্তর্জাতিক সহায়তা কাজে লাগাতে পারে তার ওপর।

জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়ে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (SDG) হলো *SDG 13 – Climate Action*, যা মূলত জলবায়ু পরিবর্তন ও তার প্রভাব মোকাবিলা করার ওপর কেন্দ্রিত। লক্ষ্যটি প্রত্যেক দেশকে প্রেরণা দেয় যে তারা দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করবে, ঝুঁকিপূর্ণ জনসংখ্যা ও প্রাকৃতিক বাস্তুতন্ত্র রক্ষা করবে এবং জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট সামাজিক, অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত সমস্যাগুলো হ্রাস করবে। SDG 13 শুধুমাত্র জলবায়ু সংক্রান্ত নীতি গ্রহণে সীমাবদ্ধ নয়; এটি বিভিন্ন খাতের মধ্যে সমন্বয় ও অভিযোজন কৌশল প্রণয়নের ওপরও গুরুত্ব আরোপ করে।

এই লক্ষ্য অন্তর্ভুক্ত করে বৈশ্বিক জলবায়ু নীতি অনুযায়ী সক্ষমতা বৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তা, যেমন—দূষণ হ্রাস, গ্রীনহাউস গ্যাস নির্গমন নিয়ন্ত্রণ, পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তির প্রসার এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রতিক্রিয়াশীল ব্যবস্থা তৈরি। দেশগুলোকে তাদের জাতীয় উন্নয়ন পরিকল্পনার সঙ্গে SDG 13 একীভূত করতে বলা হয়, যাতে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি নির্ধারণ, প্রয়োজনীয় অর্থায়ন ব্যবস্থা, তথ্য ও গবেষণার মাধ্যমে নীতি প্রণয়ন এবং স্থানীয় স্তরে অভিযোজন কার্যক্রম কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করা যায়।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে SDG 13 বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ, কারণ দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, ঘূর্ণিঝড়, বন্যা ও লবণাক্ততার কারণে সরাসরি প্রভাব পড়ছে কোটি মানুষের জীবনযাত্রায়। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় জাতীয় নীতি যেমন *Bangladesh Climate Change Strategy and Action Plan (BCCSAP)* এবং *Mujib Climate Prosperity Plan (MCPP)* প্রণয়ন করা হয়েছে। এই পরিকল্পনার লক্ষ্য হলো শুধু প্রতিরোধ নয়, বরং জলবায়ু সহনশীল অর্থনীতি ও সমাজ গঠন, যা টেকসই উন্নয়নের অন্যান্য লক্ষ্য যেমন—দারিদ্র্য বিমোচন (SDG 1), খাদ্য নিরাপত্তা (SDG 2), স্বাস্থ্য ও কল্যাণ (SDG 3), এবং টেকসই নগর উন্নয়ন (SDG 11)-এর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত।

SDG 13-এর সফল বাস্তবায়ন নির্ভর করছে কতটা কার্যকরভাবে দেশ ঝুঁকি নিরূপণ, অভিযোজন সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে সহায়তার মাধ্যমে জলবায়ু প্রতিরোধমূলক কার্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করতে পারে তার ওপর। এটি শুধুমাত্র পরিবেশ রক্ষার বিষয় নয়, বরং দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা, খাদ্য নিরাপত্তা এবং সামাজিক ন্যায়বিচারের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত।

SDG 13 বা জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলার লক্ষ্য অর্জনের প্রক্রিয়াটি একটি বহুমুখী ও সমন্বিত কাঠামোর মাধ্যমে সম্পন্ন হচ্ছে। প্রথমেই সরকারের নীতি নির্ধারণ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। বাংলাদেশে *Bangladesh Climate Change Strategy and Action Plan (BCCSAP)* এবং *Mujib Climate Prosperity Plan (MCPP)* প্রণয়ন করে জাতীয় স্তরে জলবায়ু অভিযোজন ও ক্ষতিপূরণমূলক কার্যক্রমের রূপরেখা তৈরি করা হয়েছে। এই নীতিগুলোতে ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলের শনাক্তকরণ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলার প্রক্রিয়া, লবণসহিষ্ণু ও ঘূর্ণিঝড় প্রতিরোধী অবকাঠামো উন্নয়ন এবং পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তির প্রসার অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

এরপর কার্যক্রম বাস্তবায়নে পরিকল্পনা কমিশন, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (BBS) এবং বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা একযোগে কাজ করছে। পরিকল্পনা কমিশন জাতীয় নীতির সঙ্গে বাজেট ও অর্থায়নের সমন্বয় নিশ্চিত করে, যাতে বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নযোগ্য ও ফল-ভিত্তিক হয়। স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান সরাসরি প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সঙ্গে যোগাযোগ করে প্রকল্প বাস্তবায়ন, জ্ঞান সম্প্রসারণ ও স্থানীয় অভিযোজন কার্যক্রম পরিচালনা করে।

তথ্য ও মনিটরিংও প্রক্রিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। BBS-এর মাধ্যমে ডেটা সংগ্রহ, সময়োপযোগী পরিসংখ্যান তৈরি এবং ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা চিহ্নিত করা হচ্ছে। এই তথ্যের ভিত্তিতে নীতি সংশোধন, প্রকল্প পুনঃনির্ধারণ এবং লক্ষ্যভিত্তিক হস্তক্ষেপ সম্ভব হচ্ছে। আন্তর্জাতিক সহযোগিতা এবং অর্থায়নও প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। Green Climate Fund (GCF), Adaptation Fund এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থা প্রকল্পে অর্থায়ন, প্রযুক্তি ও জ্ঞান সরবরাহ করে।

অন্তত, স্থানীয় সম্প্রদায়ের অংশগ্রহণ ও সচেতনতা বৃদ্ধি প্রক্রিয়ার একটি অপরিহার্য উপাদান। কমিউনিটি-ভিত্তিক অভিযোজন প্রকল্প, জলবায়ু শিক্ষামূলক কর্মসূচি এবং স্থানীয় সক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে জনগণকে ঝুঁকি হ্রাসে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করানো হচ্ছে। এই সমন্বিত কাঠামো, অর্থায়ন, তথ্য ও স্থানীয় সক্ষমতার একীভূত প্রয়াসের মাধ্যমে বাংলাদেশের SDG 13 অর্জনের প্রক্রিয়া ধাপে ধাপে সম্পন্ন হচ্ছে এবং টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যের অন্যান্য ক্ষেত্রের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করছে।
বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জনের পথে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি থাকা সত্ত্বেও চ্যালেঞ্জ এখনো অনেক। জাতিসংঘের *SDG ইনডেক্স ২০২৩* অনুযায়ী, বাংলাদেশ ১০১তম অবস্থানে রয়েছে, মোট স্কোর ১০০-এর মধ্যে ৬৫.৯। বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ২০২৪ সালে দেশে প্রায় ১.৭৮ বিলিয়ন ডলারের অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছে, যা জিডিপির প্রায় ০.৪ শতাংশ। পরিসংখ্যান ব্যুরো (BBS)-এর তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে ঘূর্ণিঝড় ও বন্যার কারণে প্রায় ২৫ লাখ কৃষক সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। উপকূলীয় অঞ্চলের প্রায় ৩ কোটি মানুষ নিয়মিত ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস ও লবণাক্ততার হুমকির মধ্যে বসবাস করছে। প্রতিবছর প্রায় ৭ লাখ মানুষ গ্রাম থেকে শহরে অভিবাসিত হচ্ছে, যা শহরায়ণ ও টেকসই নগর উন্নয়নকে জটিল করে তোলে।

এসব তথ্য প্রমাণ করে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব দেশের অর্থনীতি, খাদ্য নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য এবং সামাজিক স্থিতিশীলতার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত। সরকারি পরিকল্পনা যেমন *Bangladesh Climate Change Strategy and Action Plan (BCCSAP)* এবং *Mujib Climate Prosperity Plan (MCPP)* এবং *National Adaptation Plan (NAP) 2023–2050* বাস্তবায়ন হলেও অর্থায়ন ও স্থানীয় অভিযোজন সক্ষমতার ঘাটতি লক্ষ্য অর্জনে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে। তথ্যনির্ভর নীতি, আন্তর্জাতিক সহায়তা, এবং স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সক্রিয় অংশগ্রহণ ছাড়া ২০৩০ সালের মধ্যে SDG 13 অর্জন সম্ভব নয়।

অতএব, বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলার জন্য সমন্বিত পদক্ষেপ, শক্তিশালী নীতি এবং কার্যকর অভিযোজন কৌশল গ্রহণ অপরিহার্য। এগুলো কার্যকরভাবে প্রয়োগ করলে দারিদ্র্য বিমোচন, খাদ্য নিরাপত্তা, স্বাস্থ্যসেবা, এবং টেকসই নগর উন্নয়নের মতো অন্যান্য SDG-ও সহায়কভাবে বাস্তবায়িত হবে।

লেখক : গণমাধ্যমকর্মী।