শারদীয় দুর্গোৎসবে সম্প্রীতির বাংলাদেশ ভাবনা

মানিক লাল ঘোষ
বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ের সর্ববৃহৎ ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজা। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মতে অশুভ শক্তির বিরূদ্ধে শুভ শক্তির বিজয়ে মা দুর্গার মর্ত্যে আবির্ভাব। ইতিহাসের সাক্ষ্য অনুযায়ী বছরে দুবার দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। শরতে শারদীয় দুর্গাপূজা আর বসন্তে হয় বাসন্তী পূজা। মেধামুনির আশ্রমে রাজা সুরথ ও সমাধি বৈশ্য কর্তৃক প্রথম প্রতীমার পূজাই বাসন্তী পূজা নামে অবিহিত। আর শ্রী রামচন্দ্র রাবন বধ করে সীতা উদ্ধারের জন্য দক্ষিণায়নে শরৎকালে ১শত ৮টি নীল পদ্মে পূজিত হন দেবী। রামচন্দ্র দেবতাদের শয়নকালে দেবীকে নিদ্রা থেকে জাগ্রত করে পূজা করেছিলেন বলে এটি অকালবোধন নামে পরিচিত। শরৎকালে রামচন্দ্রের এই পূজাই আমাদের শারদ উৎসবের স্বীকৃতি পায়।
দুর্গা প্রতিমার কল্পনা কতদিনের তা সঠিকভাবে জানা না গেলেও প্রাচীনকাল থেকে বিভিন্নভাবে মায়ের প্রতিমা কল্পনা করে শক্তি পূজার প্রচলন ছিল এদেশে। সিন্ধু উপত্যকায় আবিষ্কৃত প্রাগঐতিহাসিক যুগের অসংখ্য পোড়ামাটির স্ত্রী মূর্তিগুলো মাতৃমূর্তির অতীতকালের নিদর্শন।
বাঙালি হিন্দুদের মাঝে কবে এই পূজার প্রচলন তার তথ্যানুসন্ধানে জানা যায় যে মোঘল সম্রাট আকবরের সুবেদার রাজা কংস নারায়ণ রায় বাংলার দেওয়ান ছিলেন। তিনি পন্ডিত রমেশ শাস্ত্রীর পরামর্শে মহাযজ্ঞ না করে দুর্গাপূজা করেছিলেন। ব্যক্তিগত পূজায় যখন সাধারণ মানুষের প্রবেশাধিকার সীমিত হয়ে পড়ে তখনই প্রয়োজন হয়ে পড়ে সার্বজনীন পূজা আয়োজনের। ১৭৯০ সালে হুগলী জেলায় ১২ জন বন্ধুর প্রচেষ্টায় প্রথম বারোয়ারি পূজার আয়োজন । তারপর থেকেই এই পূজা পরিণত হয় সার্বজনীন উৎসবে।
কালের পরিক্রমায় আবহমান বাংলায় সকল ধর্মের মানুষ সমঅধিকার নিয়ে এই বাংলায় বাস করায় শারদীয় দুর্গোৎসব শুধু হিন্দুদের একার উৎসবে নয়, পরিণত হয় সার্বজনীন উৎসবে। সকল ধর্মের এমন নিরাপদ আবাস ভূমি পৃথিবীর আর কোথায় অছে? প্রতিটি পূজা মন্ডপে দর্শনার্থীদের যে ভীড়, কে যে কোন্ ধর্মের আর কেইবা কোন বর্ণের তা বোঝাই কষ্টকর। জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সবাই যেনো মিলেমিশে একাকার এই শারদীয় উৎসবে।
বৈশ্বিক মহামারী করোনার প্রভাব পড়ে গত ২০২০ ও ২১ সালে দুই বছর আমাদের সকল উ’ৎসবে । বাঙালির জীবনে এই দুবছর ছিলোনা বাংলা নববর্ষ ১ লা বৈশাখের বনার্ড্য আয়োজন। ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহায় ছিলোনা না কোনো প্রাণের ছোঁয়া। শারদীয় দুর্গাপূজায় এই দুই বছর ছিল শুধুই পূজার আনুষ্ঠানিকতা। উৎসবের ঘাটতি ছিল মনে ও প্রাণে।
নিজের জীবন, পরিবারের সদস্যদের জীবন, সর্বোপরি দেশের সাধারণ মানুষের নিরাপত্তার কথা ভেবে করোনার প্রথমবার স্বাস্থ্য বিধি মেনে সাত্ত্বিক পূজায় সীমাবদ্ধ রেখে শেষ হয় শারদীয় দুর্গাপূজার আনুষ্ঠানিকতা। এর পরের বছর করোনা সংক্রমন কম থাকায় উৎসব তার স্বাভাবিকতা ফিরে না পেলেও দীর্ঘ ১ বছর বন্দী জীবন থেকে বেরিয়ে এসে পুজার আনন্দ ভালোই কেটেছে শিশু কিশোরদের। আসলে যে যাই বলুক না কেন কোন উৎসবেই আগের মত বড়দের মনটানে না। নানাবিধ টেনশন ও ভাবনা ঘিরে রাখে তাদের।
মহান স্রষ্টাি কর্তার অশেষ কৃপায় করোনা সংক্রমণ একেবারে না কমলেও ২১ সালে ভয়কে জয় করেছে বাঙালি। অনেটা আগের অবস্থায় ফিরেছিল উৎসবের আমেজ। বর্ণিল অলোকসজ্জার ঝলকানি পুজা মন্ডপের চারদিকে। করোনা সংক্রমণের কারণে ২০২০ সালে কমে ছিল পূজা মন্ডপের সাংখ্য।
বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের তথ্য অনুযায়ী ২০১৯ সালে সারাদেশে মন্ডপের সংখ্যা ছিলো ৩১ হাজার ৩৯৮টি । ২০২০ সালে করেনায় তা কমে দাঁড়িয়েছিল ৩০ হাজার ২২৩টিতে। ২০২১ সালে তা বেড়ে দাড়ায় ৩২ হাজার ১১৮ টি। ২০২২ সালে পূজা মন্ডপের সংখ্যা বেড়েছে আরে ৫৯ টি। সারা দেশে ৩২ হাজার ১৬৮ টি মন্ডপে পূজা অনুষ্ঠিত হয়। গত বছর ২০২৩ সালে পূজা মন্ডপের সংখ্যা আরো বেড়ে দাঁড়ায় ৩২ হাজার ৪০৮ টি। কিন্তু ২০২৪ সালে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর হঠাৎ করে একটি অশুভচক্র মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের তথ্য মতে গত বছর পুজার আগেই বাংলাদেশে ১৮টি মন্দিরে প্রতিমা ভাংচুরের ঘটনা ঘটেছে।
সরকার পরিবর্তন পরবর্তী সংখ্যালঘু নির্যাতনের এই চিত্র বাংলাদেশে নতুন কিছু নয়। এক অজানা আশংকা ও বন্যার কারনে ২০২৩ সালের চেয়ে ২০২৪ সালে পূজা মন্ডপের সংখ্যা কমেছে ৯৪৭টি। সারা বাংলাদেশে গত বছর ৩১ হাজার ৪৬১টি পূজান্ডপে দুর্গা পূজা অনুষ্ঠিত হয়। এবছর পূজা মণ্ডপের সংখ্যা বেড়েছে গত বারের চেয়ে। সার বাংলাদেশে এবার ৩৩ হাজার ৩৫৫ টি মন্ডপে দেবী দুর্গার পূজা অনুষ্ঠিত হবে।আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে বাংলাদেশকে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির রোল মডেল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে কোন সরকারেরই আন্তরিকতার ঘাটতি থাকে না। এদেশের সনাতনীদের মন ভালো নেই। পূজা মন্ডপের চারদিকে এত নিরাপত্তা, এত আলো, তবু মনের গভীরে অন্ধকার কোন এক অজানা আশংকায়! ঠিক যেনো ২০২০ ও ২১ সালে করোনা সংক্রমণে পুজার সময়ে মনের অবস্থা যেমন ছিল। তখন ছিল প্রাকৃতিক দির্যোগ, আর এখন চলছে রাজনৈতিক দুর্যোগ।
গত ২৬ সেপ্টেম্বর ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দিরে বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ ও মহানগর সার্বজনীন পূজা কমিটির সংবাদ সম্মেলনের দাবী অনুযায়ী , দুর্গাপূজার প্রস্তুতির মধ্যেই ১৩ টি জেলয় দুর্গাপ্রতিমা ও মন্দিরে হামলার ঘটনা ঘটেছে। জেলাগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে কুষ্টিয়া, চট্টগ্রাম, কুড়িগ্রাম, সাতক্ষীরা, ঝিনাইদহের শৈলকূপা, শৈলকূপা, গাইবান্ধা, পঞ্চগড়, জামালপুর, নাটোর, গাজীপুর, মানিকগঞ্জ ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ।
লিখিত বক্তব্যে এই সংবাদ সম্মেলনে মহানগর সার্বজনীন পূজা কমিটির সভাপতি জয়ন্ত কুমার দেব বলেন, পূজার মধ্যে আমরা এসব হামলা দেখতে চাই না। শুধু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পদক্ষেপ নয়, রাষ্ট্রের আলোকিত চেতনা ও সামাজিক প্রতিরোধের মাধ্যমে এই সহিংসতার অবসান ঘটাতে হবে। একই সঙ্গে বলতে চাই, পূজার পাঁচ দিনের নিরাপত্তা নিয়ে ভাবলে হবে না, বৈষম্যবিরোধী বাংলাদেশ গড়তে চাইলে ৩৬৫ দিনের নিরাপত্তা নিয়ে ভাবতে হবে। অসাম্প্রদায়িক চেতনার বিকাশ ঘটাতে হবে। দুর্বৃত্তদের বিচারের সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, আমরা দেখতে চাই না।
এবারের দুর্গাপূজায় প্রতিটি মণ্ডপে দুই দফা দাবি তুলে ধরা হবে বলে জানান জয়ন্ত কুমার দেব। এ দাবিগুলো হলো—সারা দেশে ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু নেতৃত্ব ও নিরপরাধ মানুষের বিরুদ্ধে অসত্য ও ঢালাও ভিত্তিহীন হয়রানিমূলক মামলাপ্রত্যাহার সরকারি-আধা সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জোরপূর্বক পদচ্যুতি বন্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা। এই বক্তব্য ও দাবি শুধু মহানগর সার্বজনীন পূজা কমিটি কিংবা বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের নয়। এই দাবি এদেশের সনাতনী ধর্মাবলম্বীদের প্রাণের দাবি।
দল মত জাতিভেদের উর্ধে থেকে সকল ধর্মের মানুষের অংশগ্রহণ, সহযোগিতা, সহানুভূতি, সৌহার্দ্য ও সৌজন্যবোধ প্রকাশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এই বন্ধন অটুট থাক অনন্তকাল । অশুভ শক্তির বিরূদ্ধে শুভ শক্তির সকল বিবেকবান মানুষ ঐক্যবদ্ধ থাক যুগ থেকে যুগান্তরে-- শারদীয় দুর্গোৎসবে এমন প্রত্যাশা দেশবাসীর।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট।