আবীর আহাদ


মানুষের জীবন সীমিত, কিন্তু ইতিহাসে তার ছাপ সীমাহীন হতে পারে। কেউ মানবতার কল্যাণে কাজ করে অমরত্ব পান, কেউ আবার বিশ্বাসঘাতকতা বা ধ্বংসযজ্ঞের মাধ্যমে ঘৃণিত হয়েও অমর হয়ে থাকেন। বাংলাদেশের ইতিহাস বিশেষভাবে সাক্ষ্য দেয় এ দ্বৈত উত্তরাধিকারের।

সুকর্মে অমরত্বপ্রাপ্ত ঐতিহাসিক চরিত্র

হযরত মোহাম্মদ (সা:) ইসলামের মহান প্রবর্তক হিসেবে তিনি শুধু আরব জাতির নয়, সমগ্র মানবজাতির মুক্তি, ন্যায়, সাম্য ও মানবিকতার শিক্ষা দিয়েছেন। তাঁর জীবনদর্শন শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে কোটি কোটি মানুষের পথপ্রদর্শক। সত্য ও সুকর্মের মাধ্যমে তিনি বিশ্ব ইতিহাসে অনন্য অমরত্ব লাভ করেছেন।

নবাব সিরাজউদ্দৌলাহ:বাংলার স্বাধীনতার শেষ প্রতীক। ১৭৫৭ সালের পলাশি যুদ্ধে বিশ্বাসঘাতকতার কারণে পরাজিত হলেও, তিনি দেশপ্রেম, সংগ্রাম ও আত্মত্যাগের প্রতীক হয়ে আছেন। বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব হিসেবে সিরাজ আজও শ্রদ্ধাভরে স্মরণীয়।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান:বাঙালি জাতির মুক্তির মহানায়ক, যিনি ২৩ বছরের রাজনৈতিক সংগ্রাম শেষে জাতিকে স্বাধীনতার পথে নেতৃত্ব দেন। পাকিস্তানি শাসকদের বিরুদ্ধে আন্দোলন, ছয় দফা দাবি, ১৯৭১ সালের স্বাধীনতার ঘোষণা ও মুক্তিযুদ্ধের অনুপ্রেরণা—সবকিছুতেই তাঁর অমর অবদান। তাঁর নেতৃত্বে জন্ম নেয় স্বাধীন বাংলাদেশ। তাই তিনি শুধু রাষ্ট্রনেতা নন, জাতির জনক এবং ইতিহাসে অমরত্বের প্রতীক।

কুকর্মে অমরত্বপ্রাপ্ত ঐতিহাসিক চরিত্র

আবু লাহাব:ধর্মীয় ইতিহাসে অভিশপ্ত চরিত্র। তিনি সত্যকে অস্বীকার করে, ইসলামের বিরোধিতা করে ও নবী করীম (সা:)-এর শত্রুতা করে ঘৃণিত অমরত্ব লাভ করেছেন। কুরআনের সূরা আল-মাসাদ-এ তাঁর নাম চিরতরে লিপিবদ্ধ।

মিরজাফর আলী খান: ১৭৫৭ সালে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়ার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে নবাব সিরাজকে পরাজিত করেন। এর পর থেকেই শুরু হয় প্রায় দুই শতাব্দীর ঔপনিবেশিক শাসন। বাংলার ইতিহাসে তাঁর নাম চিরন্তন ঘৃণার প্রতীক। আজও “মিরজাফর” বিশ্বাসঘাতকতার প্রতিশব্দ।

খোন্দকার মুশতাক আহমদ: ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর তিনি রাষ্ট্রপতি পদ দখল করেন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধ্বংস, বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের হত্যাকারীদের রক্ষা, বিদেশি শক্তির তুষ্টি—সবই ছিল তাঁর কর্মসূচি। জাতির কাছে তিনি চরম বিশ্বাসঘাতকতার প্রতীক।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে অমরত্বের দ্বন্দ্ব

মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তি: ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সেনাদের সহযোগিতা করা রাজাকার, আলবদর, আলশামস সরাসরি স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছে। এরা বাঙালি জাতির ইতিহাসে কুখ্যাত ও ঘৃণিত।

ইতিহাস বিকৃতি ও বঙ্গবন্ধুবিরোধী মিথ্যাচার: মুক্তিযুদ্ধের পর বারবার ইতিহাস বিকৃত হয়েছে। পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে বঙ্গবন্ধুর অবদান আড়াল করা হয়েছে, মুক্তিযোদ্ধাদের মর্যাদা খর্ব করা হয়েছে, এমনকি ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা বানিয়ে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের অসম্মান করা হয়েছে। এ ধরনের অপকর্মীরা ইতিহাসে অমর হলেও ঘৃণার আসনে চিরকাল অধিষ্ঠিত থাকবে।

সাম্রাজ্যবাদ ও ডলারের লোভে দেশবিরোধী ষড়যন্ত্র: স্বাধীনতার পর কিছু রাজনীতিক ও বিদেশি এজেন্ট সাম্রাজ্যবাদী শক্তির কাছে মাথা নত করেছে। ডলার ও ক্ষমতার লোভে দেশের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত করেছে, উন্নয়নের ধারাকে বাধাগ্রস্ত করেছে, জাতীয় নিরাপত্তাকে বিপন্ন করেছে। এমনকি বাংলাদেশের চট্টগ্রাম অঞ্চলে মার্কিন সামরিক ঘাঁটি নির্মাণের চেষ্টা করে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে অশান্ত করতে উদ্যত হয়েছে। ইতিহাসে তারা টিকে থাকবে, তবে অভিশপ্ত নামেই।

শেষকথা

অমরত্ব দুই ধরনের, যেমন শ্রদ্ধার অমরত্ব ও ঘৃণার অমরত্ব। ইতিহাস যেমন বঙ্গবন্ধু, সিরাজউদ্দৌলাহ ও মুক্তিযোদ্ধাদের অনন্ত শ্রদ্ধায় স্মরণ করে, তেমনি মিরজাফর, গোলাম আজম, মুশতাক ও সাম্রাজ্যবাদপুষ্ট ষড়যন্ত্রকারীদের অভিশাপে অমর করে রেখেছে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের শিক্ষা একটাই: সুকর্মই প্রকৃত অমরত্বের পথ। মানুষ মরে যায়, কিন্তু সুকর্মের আলো চিরদিন বেঁচে থাকে। অপরদিকে দেখা যায়, কিছু কিছু বিকৃত রুচির মানুষ অমরত্বের আশায় নির্দ্বিধায় নানান কুকর্মের মধ্যেও আত্মসুখ খুঁজে পায়।

লেখক : মুক্তিযোদ্ধা লেখক ও বিশ্লেষক।