কৃষকস্বার্থে বিদ্যমান সার বিতরণ নীতিমালা বহাল রাখার জোর দাবি

ওয়াজেদুর রহমান কনক, নীলফামারী : বিদ্যমান সার বিতরণ নীতিমালা বহাল রাখার প্রয়োজনীয়তা বিশ্লেষণ করতে গেলে আমাদের কৃষি উৎপাদনের সার্বিক প্রেক্ষাপট, কৃষকস্বার্থ, বাজার ব্যবস্থা, প্রশাসনিক কাঠামো এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা—এই পাঁচটি দিক থেকে বিষয়টি দেখতে হয়। সার কৃষি উৎপাদনের অন্যতম মৌলিক উপাদান। সঠিক সময়, সঠিক পরিমাণ ও সঠিক মূল্যে সার না পেলে কৃষি উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যার সরাসরি প্রভাব পড়ে খাদ্যনিরাপত্তা, কৃষকের আয় ও জাতীয় অর্থনীতিতে।
প্রথমত, বিদ্যমান নীতিমালার বাস্তব প্রয়োগ ও কার্যকারিতা বহু বছরের অভিজ্ঞতার মাধ্যমে প্রমাণিত। বর্তমান কাঠামোর অধীনে সার ডিলাররা কৃষি বিভাগ, জেলা প্রশাসন এবং ব্যাংকিং ব্যবস্থার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সমন্বয়ের মাধ্যমে সঠিক সময়ে সার সংগ্রহ ও বিতরণ করে থাকেন। এর ফলে মাঠপর্যায়ে সারের ঘাটতি দেখা যায়নি, বরং কৃষকরা প্রয়োজন অনুযায়ী সার পেয়ে থাকেন। যদি এই কার্যকর নীতিমালা পরিবর্তন করা হয়, তবে প্রশাসনিক জটিলতা ও অনুমোদন প্রক্রিয়া বাড়বে, যা সময়মতো সরবরাহে বাধা সৃষ্টি করবে।
দ্বিতীয়ত, কৃষকস্বার্থের দিক থেকে বিদ্যমান নীতিমালা সবচেয়ে বেশি উপযোগী। কৃষকরা বীজ বপন ও ফসল পরিচর্যার নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সার পেতে চান। একদিন দেরিতেও সার না পেলে ফলন ব্যাপকভাবে কমে যেতে পারে। বর্তমান ব্যবস্থায় ডিলাররা স্থানীয়ভাবে কৃষকদের চাহিদা বোঝেন এবং সেই অনুযায়ী বিতরণ করেন। নতুন নীতিমালা অনুযায়ী কেন্দ্রীয় অনুমোদনের ওপর নির্ভর করতে হলে মাঠপর্যায়ে দেরি হবে, কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।
তৃতীয়ত, বাজার ও আর্থিক ব্যবস্থার স্থিতিশীলতা রক্ষায় বিদ্যমান নীতিমালা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। সার ডিলাররা ব্যাংক ঋণের মাধ্যমে সার সংগ্রহ করে থাকেন। দীর্ঘ অনুমোদন প্রক্রিয়া বা প্রশাসনিক বাধা তৈরি হলে তাদের ঋণ পরিশোধে সমস্যা দেখা দেবে। এতে তাদের আর্থিক সক্ষমতা কমবে এবং সার বাজারে তারল্য সংকট তৈরি হবে। একই সঙ্গে কালোবাজারি বা অনিয়মের ঝুঁকিও বাড়বে।
চতুর্থত, প্রশাসনিক সমন্বয় ও জবাবদিহিতার ক্ষেত্রেও এই নীতিমালা একটি সফল মডেল। জেলা প্রশাসন, কৃষি অফিস, সার ডিলার ও কৃষক—সব পক্ষের মধ্যে সমন্বয়মূলক সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। নতুন নীতিমালা প্রণয়ন করলে এই কাঠামো ভেঙে পড়বে, ফলে দায়িত্ব নির্ধারণ ও জবাবদিহিতার জায়গা দুর্বল হবে।
পঞ্চমত, অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রভাব বিবেচনা করলে দেখা যায়, কৃষি বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রাণ। মোট কর্মসংস্থানের প্রায় ৪০ শতাংশ কৃষি খাতে, এবং জাতীয় জিডিপির একটি বড় অংশ আসে কৃষি থেকে। যদি সার সরবরাহে বিঘ্ন ঘটে, তবে উৎপাদন কমবে, খাদ্যনিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়বে, এবং কৃষিপণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পাবে। এতে নিম্নআয়ের মানুষ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
সবশেষে, বিদ্যমান নীতিমালার অধীনে সার বিতরণে অনিয়ম, ঘাটতি বা দুর্নীতির উল্লেখযোগ্য কোনো প্রমাণ নেই। বরং এটি একটি পরীক্ষিত ও সাফল্যজনক কাঠামো, যা স্থানীয় বাস্তবতার সঙ্গে খাপ খায়। নীতিমালা পরিবর্তন করলে মাঠপর্যায়ে বিশৃঙ্খলা, প্রশাসনিক জটিলতা, দুর্নীতি এবং কৃষি উৎপাদনে সংকট দেখা দিতে পারে।
তাই, সরকারের উচিত বিদ্যমান সার বিতরণ নীতিমালা বহাল রেখে তার আরও কার্যকারিতা বৃদ্ধি করা—যেমন তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার, ডিজিটাল মনিটরিং এবং মাঠপর্যায়ের প্রতিনিধিদের নিয়মিত মতামত গ্রহণ। এতে কৃষক, ব্যবসায়ী ও সরকারের মধ্যে আস্থা বজায় থাকবে এবং খাদ্যনিরাপত্তা ও কৃষি উন্নয়ন নিশ্চিত হবে।
নিয়মিত সার বিতরণে বিদ্যমান নীতিমালা বহাল রাখার দাবিতে নীলফামারীতে বাংলাদেশ ফার্টিলাইজার অ্যাসোসিয়েশন (বিএফএ)-এর নীলফামারী জেলা ইউনিট আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বক্তারা সরকার ঘোষিত সার বিতরণ নীতিমালা ২০২৫ নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তারা অভিযোগ করেন, সম্প্রতি কৃষি উপসচিব মহোদয়ের সংবাদ সম্মেলনে যে বক্তব্য প্রদান করা হয়েছে, তা মাঠপর্যায়ের বাস্তবতা ও কৃষকস্বার্থের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এই প্রস্তাবিত নীতিমালা বাস্তবায়িত হলে কৃষকরা সময়মতো সারের সরবরাহ থেকে বঞ্চিত হবেন, কৃষি উৎপাদনে ব্যাঘাত ঘটবে, এবং গ্রামীণ অর্থনীতিতে অস্থিরতা তৈরি হবে। নীলফামারী প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, গত কয়েক বছর ধরে বিদ্যমান সার বিতরণ ব্যবস্থায় কৃষকরা যথাসময়ে সার পেয়েছেন এবং কোনো ঘাটতি তৈরি হয়নি। জেলা প্রশাসন, কৃষি অফিস, বিএফএ ও সার ডিলারদের সমন্বয়ে যে কাঠামো গড়ে উঠেছে, তা কার্যকরভাবে সারের সরবরাহ নিশ্চিত করছে। অথচ নতুন প্রস্তাবিত নীতিমালা অনুযায়ী একাধিক স্তরে অনুমোদন ও অতিরিক্ত প্রশাসনিক জটিলতা সৃষ্টি হবে, যার ফলে মাঠপর্যায়ে সময়মতো সার বিতরণ সম্ভব হবে না।
বক্তারা আরও জানান, বর্তমানে সার ডিলাররা বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ঋণ নিয়ে সার সংগ্রহ করেন। যদি নতুন নীতিমালায় অতিরিক্ত অনুমোদন প্রক্রিয়া যুক্ত হয়, তবে ঋণের সময়সীমা ও পরিশোধ প্রক্রিয়ায় জটিলতা দেখা দেবে। এতে কৃষি উৎপাদন বিলম্বিত হবে এবং কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। এ ছাড়া, প্রস্তাবিত নীতিমালা অনুসারে সার ডিলারদের ব্যবসায়িক স্বাধীনতায়ও হস্তক্ষেপের সম্ভাবনা রয়েছে, যা বাজার ব্যবস্থার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
বিএফএর নেতারা বলেন, বিদ্যমান নীতিমালায় কোনো ধরনের অনিয়ম বা সংকটের নজির নেই। বরং এটি দীর্ঘদিন ধরে পরীক্ষিত ও সফল একটি কাঠামো, যার ফলে সার ঘাটতি বা কালোবাজারির মতো সমস্যা রোধ করা সম্ভব হয়েছে। তারা দাবি করেন, সারের গুণগতমান, সময়মতো সরবরাহ এবং কৃষকের কাছে সঠিক মূল্যে সার পৌঁছানোর ক্ষেত্রে বর্তমান ব্যবস্থাই সর্বোত্তম। নতুন নীতিমালা প্রয়োগ হলে সার বিতরণে সমন্বয়হীনতা, সময়ক্ষেপণ ও অদক্ষতা বাড়বে।
বক্তারা সরকারের প্রতি আহ্বান জানান, নতুন নীতিমালা প্রণয়নের আগে মাঠপর্যায়ের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনা করা হোক এবং বাস্তবতার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেওয়া হোক। তারা বলেন, সরকার যদি বিদ্যমান নীতিমালা বহাল রাখে, তবে কৃষি উৎপাদন ও খাদ্য নিরাপত্তা বজায় থাকবে, যা জাতীয় অর্থনীতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
সংবাদ সম্মেলনে বক্তৃতা দেন বিএফএর নীলফামারী জেলা ইউনিটের সভাপতি মো. আব্দুল ওয়াহেদ ও সাধারণ সম্পাদক তাপস কুমার সাহা। তারা বলেন, কৃষি উপকরণ বিতরণে স্বচ্ছতা ও দক্ষতা বজায় রাখতে হলে মাঠপর্যায়ে বাস্তব অভিজ্ঞতা সম্পন্ন ডিলারদের মতামতকে প্রাধান্য দিতে হবে। তারা আশা প্রকাশ করেন, সরকার সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে বিদ্যমান নীতিমালা অপরিবর্তিত রেখে কৃষকের স্বার্থে কার্যকর পদক্ষেপ নেবে।
শেষে নেতৃবৃন্দ বলেন, সার বিতরণ নীতিমালা ২০২৫ পর্যালোচনার সময় মাঠপর্যায়ের অংশীদারদের সঙ্গে বৈঠক আয়োজন করা জরুরি। যদি এই দাবি অগ্রাহ্য করা হয়, তাহলে সার সংকট, কৃষি উৎপাদন হ্রাস ও কৃষকের ক্ষতির দায় সরকারকেই বহন করতে হবে। তারা বিশ্বাস প্রকাশ করেন, সরকার কৃষক ও ব্যবসায়ীদের স্বার্থ বিবেচনা করে বিদ্যমান নীতিমালা বহাল রাখবে, যাতে কৃষির ধারাবাহিক অগ্রগতি অব্যাহত থাকে।
(ওআরকে/এএস/সেপ্টেম্বর ২৯, ২০২৫)