বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ধর্মভাবনা

আবীর আহাদ
নোবেল লরিয়েট বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১–১৯৪১)। আমাদের জাতীয় সঙ্গীতের রচয়িতা, মানবতাবাদী দার্শনিক এবং আধুনিক বাংলার অন্যতম শ্রেষ্ঠ চিন্তক। বিশেষ করে তাঁর অজস্র গান, কবিতা, বেশভূষা ও দৃষ্টিনন্দন চেহারাশৌষ্ঠব সম্পর্কে মানুষের যেমন কৌতুহল রয়েছে, তেমনি তাঁর ধর্মচিন্তা নিয়েও বহু মানুষের অনেক কৌতুহল রয়েছে। তাই সাহিত্যিক কৃতিত্বের বাইরে তাঁর যে একটি অনন্য দিক আলোচনার দাবি রাখে, তা হলো তাঁর ধর্মভাবনা। আমি এখানে সেই বিষয়টি নিয়ে একটু আলোচনা করছি। এক কথায় বলা যায়, প্রচলিত বা সংগঠিত ধর্মের আচার-অনুষ্ঠান তিনি অস্বীকার করেছিলেন; কিন্তু ধর্মকে তিনি মানুষের অন্তরের সত্য, বিশ্বমানবের ঐক্য ও সৌন্দর্যের অভিজ্ঞতা হিসেবে দেখেছিলেন। তাঁর ধর্মচিন্তার উৎসকে বোঝার জন্য তিনটি প্রেক্ষাপট বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ: ব্রাহ্মধর্ম, বাউলচেতনা এবং উপনিষদীয় দর্শন।
ব্রাহ্ম ধর্মের প্রভাব
ঠাকুর পরিবারের ঐতিহ্যের সঙ্গে নিবিড়ভাবে যুক্ত ছিল ব্রাহ্মসমাজ। রবীন্দ্রনাথের পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ব্রাহ্মধর্ম প্রচার করে গোঁড়া আচারের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। ব্রাহ্মধর্মের মূল মন্ত্র ছিল: একেশ্বরবাদ, মানবপ্রেম, আচারবর্জিত সরল ঈশ্বরচেতনা। এই দর্শন রবীন্দ্রনাথকে গড়ে তোলে। তিনি পরে স্পষ্ট ভাষায় লিখেছেন: “ধর্ম কোনো সংস্কার নয়, ধর্ম মানুষের মনের সত্য।” (প্রবন্ধ: ধর্ম)
অতএব, ব্রাহ্মধর্মের সূত্রেই রবীন্দ্রনাথের চিন্তায় উদারতা, মানবিকতা ও আধ্যাত্মিক মুক্তির বীজ রোপিত হয়েছিল।
বাউল চেতনার অন্তর্দৃষ্টি
রবীন্দ্রনাথ বাউলগানের সঙ্গে প্রত্যক্ষ সংস্পর্শে এসেছিলেন এবং তাঁদের অন্তর্মুখী দর্শন তাঁকে গভীরভাবে আলোড়িত করেছিল। বাউলরা মনে করেন: ঈশ্বরকে বাইরে নয়, মানুষের অন্তরে খুঁজতে হয়। আনুষ্ঠানিকতাকে তারা প্রত্যাখ্যান করে অন্তর্জগতের সত্য অনুসন্ধান করে। এই ভাবনাকে রবীন্দ্রনাথ তাঁর প্রবন্ধ সাধনায় রূপ দিয়েছেন: “আমি মানুষে মানুষে ঈশ্বরকে পাই, মানুষ ছাড়া তাঁকে পাই নে।”
এভাবেই বাউলদর্শন রবীন্দ্রনাথকে মানুষের ভেতরে ঈশ্বরকে খুঁজে পাওয়ার শিক্ষা দেয়, যা তাঁর মানবধর্মের মূল ভিত্তি।
উপনিষদীয় একত্ববাদ ও সৌন্দর্যবোধ
রবীন্দ্রনাথ উপনিষদের প্রতি আজীবন অনুরাগী ছিলেন। উপনিষদ বলছে, “সর্বত্র ব্রহ্ম”, আর রবীন্দ্রনাথ এই ব্রহ্মানুভূতিকে সাহিত্য, সংগীত ও দর্শনের ভাষায় প্রকাশ করেছেন। তাঁর কাছে প্রকৃতি, সৌন্দর্য, আনন্দ এবং শিল্পকলা- সবই ঈশ্বরের প্রকাশ। তাই তিনি গেয়েছেন: “যেথায় সবে মিলে এক হয়েছে, সেইখানে তোর সঙ্গে মেলাবি প্রভু।”
এই সৌন্দর্যবোধ রবীন্দ্রনাথের ধর্মচেতনায় শিল্প ও আধ্যাত্মিকতার এক দুর্লভ সংমিশ্রণ ঘটিয়েছে।
মানবধর্ম ও সার্বজনীনতা
রবীন্দ্রনাথের ধর্মচিন্তার সর্বোচ্চ পর্যায় হলো মানবধর্ম। তিনি বিশ্বাস করতেন, মানুষের সেবার মধ্য দিয়েই ঈশ্বরকে পাওয়া যায়। এজন্য তিনি ঘোষণা করেন: “ধর্ম মানুষের মুক্তির জন্য, আবদ্ধ করার জন্য নয়।” (সভ্যতার সংকট)
তেমনি তিনি মানবধর্ম প্রচার করে সমগ্র বিশ্বমানবতার ঐক্য কামনা করেছেন। সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা তাঁর কাছে ছিল মানবতার পরিপন্থী।
শেষকথা
নোবেল লরিয়েট বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ধর্মভাবনা মূলত ব্রাহ্মধর্মের উদারতা, বাউলচেতনার অন্তর্মুখী আধ্যাত্মিকতা ও উপনিষদীয় একত্ববাদের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে। তিনি গোঁড়া আচার-অনুষ্ঠানের বিরোধিতা করে ধর্মকে দেখেছেন মানবপ্রেম, সত্যচর্চা ও সৌন্দর্যের অভিজ্ঞতা হিসেবে। তাঁর কাছে ধর্ম মানে: মানুষে মানুষে মিলন, মানবসেবার মাধ্যমে ঈশ্বরলাভ, আর বিশ্বমানবের সঙ্গে একাত্মতার অনুভূতি। তাই তাঁকে বোঝা মানে শুধু কবি হিসেবে নয়, বরং এক মানবধর্মের পথিকৃৎ হিসেবে উপলব্ধি করা।
লেখক : লেখক ও বিশ্লেষক।