আবীর আহাদ


একটি শীতের রাত। আকাশে মৃদু চাঁদ, রেডিও থেকে ভেসে আসছে সুর: “এই পথ যদি না শেষ হয়”। রাস্তায় হাঁটতে থাকা পথিকের মনে হঠাৎ এক নেশা জাগে, যেন গানটি তারই জীবনের গল্প। আবার হয়তো কোনো সিনেমা হলে দর্শক ডুবে যাচ্ছে “চিঙ্গারি কোনো ভি ভড়ে”এর আগুনে সুরে, কিংবা “ধনধান্যে পুষ্পে ভরা” গেয়ে নতুন প্রজন্ম খুঁজে পাচ্ছে মাটির টান।

এ সুরগুলোর স্রষ্টা সবাই বাঙালি: হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সচীন দেব বর্মন, সলিল চৌধুরী ও রাহুল দেব বর্মন। তাঁরা প্রত্যেকে আলাদা ধারার, অথচ মিলিতভাবে তাঁরা উপমহাদেশীয় সংগীতকে নতুন রূপ ও বৈশ্বিক উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছেন।

হেমন্ত মুখোপাধ্যায়: ঈশ্বর-কণ্ঠের রূপকার

হেমন্ত মানেই এক মিষ্টিমধুর জলদগম্ভির কণ্ঠের মায়া ও বিষণ্নতায় মোড়া রোমান্টিকতা। হিন্দি গানে "হ্যায় আপনা দিল তো আওয়ারা", বাংলা গানে "আমার গানের স্বরলিপি লেখা রবে": দুটোই তাঁর অমর সৃষ্টি। সুরকার হিসেবেও তিনি অবিস্মরণীয়, নাগিন ছবির “মন ডোলে মেরা তান ডোলে” তার প্রমাণ।
রবীন্দ্রসংগীতে তাঁর কণ্ঠ যেন একেবারে অন্য মাত্রা।

সলিল চৌধুরী একবার হেমন্ত সম্পর্কে বলেছিলেন: “ঈশ্বর যদি গান গাইতেন, তবে তিনি হেমন্তের কণ্ঠে গাইতেন।” অপরদিকে সঙ্গীত সম্রাজ্ঞী লতা মুঙ্গেশ্করের উক্তি: "আমি কেবল দাদার পায়ে নমস্কার করি!"

সচীন দেব বর্মন: লোকসুরের সাধক

ত্রিপুরার রাজপুত্র হয়েও সচীন দেব বর্মন মন বাঁধলেন বাংলার মাঠ-ঘাটের সুরে। বৈষ্ণব পদাবলী, ভাটিয়ালি, কীর্তন—সবই তাঁর সৃষ্টির মূলে। হিন্দি চলচ্চিত্র প্যায়াসা, গাইড, আরাধনা—সবখানে তাঁর সুরের সহজ অথচ গভীর আবেদন। বাংলা গান শোন গো দখিনা হাওয়া আজও লোকসুরের আধুনিক রূপের শ্রেষ্ঠ উদাহরণ।

সলিল চৌধুরী: সংগ্রামের সুরকার

সলিল চৌধুরী ছিলেন বহুমাত্রিক—গল্পকার, কবি, বিপ্লবী, সুরকার। তাঁর গানে ছিল সমাজচেতনা, শ্রমিক-শোষিতের কণ্ঠস্বর। ধনধান্যে পুষ্পে ভরা, শোনো একটি মুজরিমানা গান—বাংলায়, আর হিন্দিতে আনুরাধা–র সুর আজও কালজয়ী। তিনি পশ্চিমা ধ্রুপদী সুর আর লোকসঙ্গীতকে মিশিয়ে নতুন ধারার সূচনা করেন।

রাহুল দেব বর্মন: আধুনিকতার জাদুকর

‘পঞ্চম’ নামে পরিচিত রাহুল দেব বর্মন ছিলেন নতুন ধ্বনির পরীক্ষক। পশ্চিমা জ্যাজ, লাতিন, রককে ভারতীয় সুরে মিশিয়েছেন। শোলে–এর “মেহবুবা মেহবুবা”, আমার প্রেম–এর “চিঙ্গারি কোনো ভি ভড়ে”, হরে রামা হরে কৃষ্ণা–র “দম মারো দম”-----তাঁকে দিয়েছে কালজয়ী খ্যাতি। তিনি প্রমাণ করেছেন ভারতীয় সংগীতও আন্তর্জাতিক আধুনিকতার সঙ্গে তাল মেলাতে পারে।

মিল ও বৈপরীত্য

সচীন দেব বর্মন: লোকসুরের সরলতা।

হেমন্ত মুখোপাধ্যায়: কণ্ঠের জাদু ও রোমান্টিক সুর।

সলিল চৌধুরী: সামাজিক চেতনা ও ভিন্নধর্মী সঙ্গীত।

রাহুল দেব বর্মন: আধুনিক পরীক্ষামূলক সাহস।

চারজনই আলাদা ধারার হলেও তাঁরা একসঙ্গে প্রমাণ করেছেন: সঙ্গীত কোনো সীমানা মানে না, মানে শুধু হৃদয়ের ভাষা।

শেষকথা

আজও যখন পুরোনো রেডিও বা আধুনিক প্লেলিস্টে তাঁদের গান বাজে, শ্রোতারা হারিয়ে যান সময়ের গণ্ডি পেরিয়ে অন্য এক জগতে। সচীন দেব বর্মন, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সলিল চৌধুরী ও রাহুল দেব বর্মন—তাঁরা কেবল গানের স্রষ্টা নন, তাঁরা ইতিহাসের অমর চরিত্র। তাঁদের গান প্রমাণ করে দিয়েছে: সংগীতই হলো মানুষের সত্যিকার বিশ্বভাষা, আর এ ভাষায় বাঙালির অবদান চিরঅম্লান।

লেখক :লেখক ও বিশ্লেষক।