ওয়াজেদুর রহমান কনক


বিশ্ব প্রাণী দিবসের ধারণা কেবল একটি আন্তর্জাতিক উদযাপন নয়; এটি মানুষের এবং প্রাণীর মধ্যে গঠনমূলক সম্পর্ক, নৈতিক দায়িত্ববোধ, এবং পরিবেশগত সচেতনতার জটিল নেটওয়ার্ককে প্রদর্শনের একটি প্রেক্ষাপট। ইতিহাস, সমাজবিজ্ঞান, পরিবেশনীতি ও জনস্বাস্থ্য গবেষণার আলোকে দেখা যায়, প্রাণী ও মানুষের সংযোগ কেবল খাদ্য বা অর্থনৈতিক সম্পদের সীমাবদ্ধতায় সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি সামাজিক স্থিতিশীলতা, স্বাস্থ্যসেবা, নৈতিকতা ও পরিবেশ সংরক্ষণের সঙ্গে গভীরভাবে সংশ্লিষ্ট।

বিশ্ব প্রাণী দিবস, যা প্রতি বছর ৪ অক্টোবর পালিত হয়, সেন্ট ফ্রান্সিস অব আসিসির প্রতি শ্রদ্ধা হিসেবে নির্ধারিত হয়েছে, যিনি প্রাণীপ্রেম ও প্রকৃতি রক্ষার ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ প্রতীক। আধুনিক সময়ে দিবসটি কেবল প্রতীকী অনুষ্ঠান নয়; এটি আন্তর্জাতিক সংস্থা, সরকার, নাগরিক ও শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে একটি কার্যকর প্ল্যাটফর্ম হিসেবে কাজ করছে, যার মাধ্যমে প্রাণী অধিকার, জনস্বাস্থ্য ঝুঁকি, বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ এবং পরিবেশগত টেকসইতার মতো জটিল ইস্যুগুলো নিয়ে সচেতনতা তৈরি করা হচ্ছে।

গবেষণাভিত্তিক বিশ্লেষণ দেখায়, বিশ্বব্যাপী কোটি কোটি প্রাণী দৈনন্দিন মানব ক্রিয়াকলাপের সরাসরি বা পরোক্ষ প্রভাবের মুখোমুখি, যেখানে পোষা প্রাণী, কৃষিপ্রাণী, এবং বন্যপ্রাণী—তিনটি ক্ষেত্রেই মানুষের নীতি ও আচরণ তাদের জীবনমান নির্ধারণ করে। একই সঙ্গে, প্রাণী–মানব সম্পর্কের মধ্যে অন্তর্নিহিত নৈতিক এবং সামাজিক মানদণ্ড, মনোবৈজ্ঞানিক স্বাস্থ্য ও পরিবেশগত সমন্বয় এই দিবসকে কেবল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান নয়, বরং একটি গবেষণাগত ও নীতি নির্ধারণমূলক প্রেক্ষাপট হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।

৪ অক্টোবর পালিত বিশ্ব প্রাণী দিবস (World Animal Day) সম্পর্কে আদ্যোপান্ত—এর ইতিহাস, অর্থ, বিশ্বস্তাত্ত্বিক প্রেক্ষাপট, মানব–প্রাণী সম্পর্কের পরিসংখ্যানিক বাস্তবতা ও নীতিগত গুরুত্ব সম্পর্কে নিম্নে বিস্তৃতভাবে উপস্থাপন করা হলো।

অনেক আন্তর্জাতিক প্রাণী তত্ত্বাবধায়ক ও কল্যাণসংস্থা এই দিনটিকে উদযাপন ও প্রচারণার কেন্দ্রবিন্দু বানায়—শিক্ষা, ভ্যাকসিনেশন ক্যাম্প, আশ্রয়-প্রচেষ্টা ও জনসম্পৃক্ত কর্মসূচির মাধ্যমে প্রাণীর প্রতি করুণা ও দায়িত্ববোধ জাগ্রত করার জন্য এটি ব্যবহৃত হয়। দিনটির নির্দিষ্ট তারিখ—৪ অক্টোবর—নির্বাচিত হয়েছে সেন্ট ফ্রান্সিস অব আসিসি (Saint Francis of Assisi)-এর সম্মানে; তিনি ঐতিহাসিকভাবে প্রাণীপ্রেম ও প্রকৃতির রক্ষার প্রতীক হিসাবে বিবেচিত।

এই দিবসের ঐতিহাসিক সূত্রপাত ও বিকাশে জার্মান লেখক ও ক্যানিওলজিস্ট (কুকুর ও প্রাণী বিষয় লেখক) হেইনরিখ জিমারমান (Heinrich Zimmermann)-এর ভূমিকা নির্ণায়ক। তিনি প্রথমবার ১৯২৫ সালে বার্লিনে একটি বৃহৎ প্রাণী-সম্মেলন আয়োজন করে ‘বিশ্ব প্রাণী দিবস’ নামে কাজ শুরু করেন; পরে ১৯২৯ সালে অনুষ্ঠানটি ৪ অক্টোবর অনুষ্ঠিত হতে শুরু করে এবং ১৯৩১ সালে ফ্লোরেন্সে আয়োজিত আন্তর্জাতিক প্রাণী-সুরক্ষা কংগ্রেসে ৪ অক্টোবরকে সর্বজনীনভাবে প্রস্তাব ও গৃহীত করা হয়। ঐতিহাসিকভাবে এই আত্মপ্রচেষ্টাই পরবর্তীতে আন্তর্জাতিক প্রচারণার ভিত্তি গড়ে তোলে।

আধুনিক পর্যায়ে বিশ্ব প্রাণী দিবস কেবল অনুষ্ঠানের নাম নয়; এটি বহু সংস্থা ও জালকোন উদ্যোগের মাধ্যমে বাস্তব সমস্যাগুলো—বন্যপ্রাণীর ধ্বংস, পোষা প্রাণীর স্বাস্থ্যসেবা, কর্মজীবী/কাঠমজুরি প্রাণীর কল্যাণ, পশুপালন ও খাদ্যশৃঙ্খলের নৈতিকতা—এসব নিয়ে জনমত গঠন ও রাজনীতি প্রভাবিত করার একটি কার্যকর যন্ত্র হিসেবে কাজ করে। বিশ্বব্যাপী ন্যাচারওয়াচ, ওয়ার্ল্ড অ্যানিমাল প্রটেকশন, স্পানাঃ (SPANA) ইত্যাদি সংস্থা বার্ষিক নির্দিষ্ট থিম ঘোষণা করে কর্মসূচি পরিচালনা করে যা স্থানীয় বাংলার ও আন্তর্জাতিক স্তরের একীভূত প্রচেষ্টাকে ত্বরান্বিত করে।

মানুষ এবং প্রাণীর আপেক্ষিক পরিসংখ্যানিক সম্পর্ক বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায় যে, বিশ্ববাসীর প্রতিদিনকার খাদ্য, বস্ত্র, কাজের সঙ্গী ও পোষা জীবনের কারণে প্রাণীর ওপর মানব-চাহিদার চাপ বিশাল মাত্রায়। সাম্প্রতিক হিসাব অনুসারে ২০২৩ সালে সারা বিশ্বে স্থলভিত্তিক প্রাণীর মোট বয়সবর্তি কাটা (slaughter) প্রায় ৮৫.৪৪ বিলিয়নটি পৌঁছেছে—এটি ২০২২ সালের তুলনায় বৃদ্ধিপ্রবণ। খাদ্যশিল্পে পশুপালনের মাত্রা ও দ্রুত বর্ধন বিশ্বব্যাপী মাংস ও দুগ্ধ উত্পাদনকে বাড়িয়েছে; ২০১০–২০২3 পর্যায়ে প্রধান পশুপালিত প্রাণীর উৎপাদন বৃদ্ধির ধারা লক্ষণীয়। এ ধরনের বৃহৎ পরিসংখ্যান প্রাণীর জীবনের ওপর মানবিক ও পরিবেশগত প্রভাবের পরিসীমাকে স্পষ্ট করে তোলে।

একই সময়ে প্রকৃতি-সংরক্ষণ এবং বায়ো-বৈচিত্র্য সংকট বিপজ্জনক মাত্রায় গতি অর্জন করেছে। আন্তর্জাতিক সংস্থার তথ্যে দেখা যায়, আইইউসিএন (IUCN) রেড লিস্টে টানা মূল্যায়নের মাধ্যমে সবমিলিয়ে লক্ষাধিক প্রজাতি মূল্যায়ন করা হয়েছে—প্রতি আপডেটে হাজার হাজার প্রজাতির অবস্থা পুনর্মূল্যায়িত হচ্ছে—এবং সাম্প্রতিক গ্লোবাল আপডেটে বহু হাজার প্রজাতি 'সংকটাপন্ন' বা 'নিম্নগামী' হিসেবে তালিকাভুক্ত রয়েছে; বিভিন্ন প্রতিবেদনে প্রায় ৪০–৪৬ হাজার প্রজাতিকে বিভিন্ন স্তরের ঝুঁকিপূর্ণ (threatened) হিসেবে রেকর্ড করা হয়েছে। এই সংখ্যাগুলোই প্রমাণ করে যে, বাস্তুসংস্থান ধ্বংস, জলবায়ু পরিবর্তন, অনবিবেচক শিকার ও বন্যপ্রাণী পাচার ইত্যাদি জটিল কারণগুলোর সমন্বয়ে জীববৈচিত্র্য ক্রিয়া-রেখা থেকে দ্রুত সরে যাচ্ছে।

পোষা প্রাণীর ক্ষেত্রেও সাম্প্রতিক প্রবণতা দ্রুত পরিবর্তিত: বিশ্বের মোট পোষা প্রাণীর সংখ্যা এক বিলিয়নের ওপরে পৌঁছতে পারে—বিশেষত কুকুর ও বিড়াল মিলিয়ে আড়াই থেকে কাছাকাছি বিলিয়নকে ছুঁতে পারে বলে বিভিন্ন সংস্থা অনুমান করে। শুধুমাত্র কুকুর-সংখ্যার কাঁচামূল্য হিসেবে প্রায় ৯০০ মিলিয়নের আশপাশে বিশ্বের কুকুর (পোষা ও পথচারী মিলিয়ে) থাকতে পারে; যুক্তরাষ্ট্রে ২০২4 সালের জরিপে পোষা কুকুরের সংখ্যা প্রায় ৮৯.৭ মিলিয়ন হিসেবে রিপোর্ট করা হয়েছে। পোষ প্রাণীর বৃদ্ধির সঙ্গে পোষকতায় ব্যয়ও বাড়ছে—শহরায়ণ, মধ্যবিত্ত সম্প্রসারণ ও জীবনধারার পরিবর্তন এটি অনুঘটক। এই ধারা পোষা প্রাণীর কল্যাণ, নিবন্ধন-প্রক্রিয়া ও ভ্যাকসিনেশনের গুরুত্বও বাড়িয়ে দিয়েছে।

প্রাণী–মানব সম্পর্ক কেবল কল্যাণ নয় — জনস্বাস্থ্যও এতে জড়িত। কুকুর-জনিত রেবিস (rabies) এখনও একটি গুরুতর বিশ্বজনীন স্বাস্থ্যের সমস্যা; বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) অনুমান অনুযায়ী প্রতি বছর আনুমানিক ৫৯,০০০ জন রেবিসজনিত মৃত্যুবরণ করে, যার প্রায় ৯৫% ঘটনাই অ্যাফ্রিকা ও এশিয়ার ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক এলাকায় ঘটে—এটি শিশুদের ওপর বিশেষভাবে প্রভাব ফেলে। একই সঙ্গে বন্যজীবী পাচার ও অবৈধ বাণিজ্য বিশ্বব্যাপী জনস্বাস্থ্য ও প্রজাতি-সংরক্ষণ উভয়ের জন্য ঝুঁকি তোলে; সাম্প্রতিক আন্তর্জাতিক রিপোর্ট আনুমানিক হাজার লাখের ওপর উদ্ভিদ ও প্রাণীদ্রব্যের বাণিজ্য ও শতকোটি ডলারের পরিসরে অবৈধ লেনদেনকে আলোকপাত করেছে। এসব বাস্তবতা বোঝায় যে, প্রাণীকল্যাণ ইস্যু এখন একেবারে স্থানীয় “কেয়ার” পর্যায় অতিক্রম করে গ্লোবাল ওয়েলবিয়িং, জনস্বাস্থ্য ও নিরাপত্তার কৌশলগত অংশ।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটেও প্রাণীসম্পর্কিত বাস্তবতা জোড়ালো ও বহুমাত্রিক। আইনগতভাবে ২০১৯ সালে ‘Animal Welfare Act, 2019’ প্রণীত হয়ে শতবর্ষী পুরনো Cruelty to Animals Act, 1920-কে প্রতিস্থাপিত করেছে—এটি প্রাণীর প্রতি নিষ্ঠুর আচরণ নিরোধ ও কল্যাণ বিধানের ওপর আইনি শক্তি জুগিয়েছে। কৃষি ও পশুপালন ক্ষেত্রে বাংলাদেশে গরু, মহিষ, খাসি, ছাগল ও মুরগি প্রভৃতি প্রাণীর সংখ্যা লক্ষাধিক ঘাটিতে; সরকারের হিসাব অনুসারে (DLS সূত্র) ২০২২ সালের আশেপাশে গরুর সংখ্যা প্রায় ২৪.৭ মিলিয়ন (২৪৭ লক্ষ), ব্যাফেলো ১৫.০৮ লক্ষ, ভেড়া ৩৭.৫২ লক্ষ ও ছাগল ২৬৭.৭৪ লক্ষের মতো পরিসংখ্যান দেখানো হয়—যাহা দেশের খাদ্য ও আয়ের একটি বড় অংশকে সমর্থন করে। পোল্ট্রি সেক্টর দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে; সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বছরে প্রায় ২৩.৩৭ বিলিয়ন ডিম ও ১.৪৬ মিলিয়ন টন পোল্ট্রি মাংস উৎপাদনের মতো পরিসংখ্যান প্রকাশিত হয়েছে। শহরায়ণ stray dog বা পথচারী কুকুর সংক্রান্ত গবেষণাগুলো বাংলাদেশে কুকুরসংখ্যার জাতীয় স্তরের অনুমান প্রায় ১.৬–১.৭ মিলিয়ন পর্যন্ত দেখায়; এই সংখ্যা রেবিস নিয়ন্ত্রণ, জনস্বাস্থ্য পরিকল্পনা ও মানব-প্রাণী সহাবস্থানের জন্য নীতি-নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ। ২০২৫ সালে দেশের কিছু এলাকায় পাখি-ফ্লু (HPAI) শনাক্তের ঘটনা খাদ্য ও প্রাণীস্বাস্থ্য ব্যবস্থার ঝুঁকিকে পুনরায় স্মরণ করিয়েছে। এই সমস্ত প্রেক্ষাপট দেশীয় নীতিগত উদ্যোগ, ভ্যাকসিনেশন ক্যাম্প ও পশু-স্বাস্থ্য ক্ষমতা তৈরির দরকারকে সুস্পষ্ট করে তোলে।

বিশ্ব প্রাণী দিবসের কার্যকরী প্রভাবের প্রতিফলন আমরা বিভিন্ন স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক উদাহরণে দেখতে পাই—অভিযানভিত্তিক ভ্যাকসিন ক্যাম্প, জীবনব্যবস্থা উন্নয়ন প্রকল্প, আইনগত সংস্কার ও শিক্ষামূলক কর্মসূচি—যেগুলো সঠিকভাবে পরিকল্পিত হলে প্রাণীহিত, জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশগত টেকসইতাকে একসঙ্গে এগিয়ে নিতে পারে। তথাপি অনেক চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে: শিল্পকোশের জোরালো পশুপালন ও খাদ্যশৃঙ্খলের নৈতিকতার প্রশ্ন, বন্যপ্রাণী-আশ্রয়স্থলের ধ্বংস, অবৈধ বাণিজ্য ও অপর্যাপ্ত স্থানীয় পশু-স্বাস্থ্য অবকাঠামো—এসব মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক সমন্বয়, আর্থিক সহায়তা ও স্থানীয় সক্ষমতা বৃদ্ধিই সমাধানের মূল চাবিকাঠি।

সংক্ষেপে, ৪ অক্টোবরের “বিশ্ব প্রাণী দিবস” শুধু একটি প্রতীকী আত্মপ্রকাশ নয়—এটি পর্যবেক্ষণ ও চিন্তার আহ্বান, যেখানে সংখ্যাবলির ভাষা (কত প্রাণী কাটা হচ্ছে, কত প্রজাতি ঝুঁকির মধ্যে, কতজন মানুষ রেবিসে প্রাণ হারাচ্ছে, কতজন পোষা প্রাণী রয়েছে ইত্যাদি) আমাদের নীতিগত সিদ্ধান্ত ও সক্রিয়তার মাত্রা নির্ধারণে নির্দেশ করে। এই দিনটি সরকার, গবেষণা প্রতিষ্ঠান, গ্রাসরুটস সংগঠন ও নাগরিকদের জন্য সুযোগ—সংরক্ষণ, কল্যাণ ও জনস্বাস্থ্য একত্রে এগিয়ে নেওয়ার জন্য বাস্তব কর্মসূচি গ্রহণ করার; উদাহরণস্বরূপ গণভ্যাকসিনেশন, জনশিক্ষা, লিগ্যাল রিফর্ম ও টেকসই পশুপালন অনুশীলনগুলি প্রয়োগ করা যেতে পারে—যাহা মানবতার সঙ্গে প্রকৃতির দীর্ঘমেয়াদি সহাবস্থান নিশ্চিত করবে।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ৪ অক্টোবর পালিত বিশ্ব প্রাণী দিবসের তাৎপর্য অত্যন্ত গভীর এবং বহুমাত্রিক। এটি শুধু একটি আন্তর্জাতিক সচেতনতার দিন নয়, বরং দেশের পরিবেশ, সামাজিক জীবন, জনস্বাস্থ্য এবং নৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে গুরুত্বপূর্ণ বার্তা বহন করে। দেশের ঘনবসতিপূর্ণ পরিবেশ, সীমিত নগরায়ণ, এবং কৃষিভিত্তিক জীবনধারার কারণে মানুষের সঙ্গে প্রাণীর সংযোগ খুবই ঘনিষ্ঠ। কৃষিজীবী পরিবারে গরু, মহিষ, ছাগল, হাঁস-মুরগি প্রভৃতি প্রাণী শুধু খাদ্য উৎপাদনের একটি উৎস নয়, এটি পরিবারিক অর্থনীতি ও স্থায়ী জীবিকার অংশ। এই প্রেক্ষাপটে প্রাণী অধিকার ও কল্যাণের বিষয়টি নৈতিক ও সামাজিক দায়িত্বের সঙ্গে জড়িত।

বিশেষভাবে, বাংলাদেশের শহরায়ণ ও উপশহর এলাকায় পথচারী প্রাণীর সংখ্যা ক্রমবর্ধমান। পথচারী কুকুর, বিড়াল এবং অন্যান্য প্রাণীর সঙ্গে মানুষের দৈনন্দিন সংযোগে অজান্তেই সংঘর্ষের সম্ভাবনা থাকে, যার মধ্যে রেবিসের মতো জনস্বাস্থ্যঝুঁকি অন্তর্ভুক্ত। বাংলাদেশে প্রতি বছর কয়েকশো মানুষ রেবিসের সংক্রমণে আক্রান্ত হয়, এবং শিশু ও দরিদ্র সম্প্রদায় সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকে। বিশ্ব প্রাণী দিবসের মাধ্যমে এই সমস্যা নিয়ে সচেতনতা সৃষ্টি করা, ভ্যাকসিনেশন, নিয়মিত নিবন্ধন ও পথচারী প্রাণীর স্বাস্থ্যকর পরিবেশ নিশ্চিত করার প্রচেষ্টা ত্বরান্বিত করা সম্ভব।

এছাড়াও, বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ এবং বনাঞ্চল রক্ষার প্রেক্ষাপটেও দিবসটির গুরুত্ব কম নয়। দেশের বন্যপ্রাণী বাগান, জলাশয় এবং বনাঞ্চলগুলোতে বন্যপ্রাণী আশ্রয় পায়। নদী, হাওর ও চারণভূমি জীববৈচিত্র্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু তাতে অনিয়ন্ত্রিত শিকার, বন ধ্বংস এবং মানুষের ঘনবসতি বন্যপ্রাণীর বাস্তুসংস্থান বিপন্ন করছে। বিশ্ব প্রাণী দিবস এই বাস্তবতা তুলে ধরে, জনসচেতনতা বাড়ানোর পাশাপাশি নীতি নির্ধারণ ও আইন প্রয়োগকে শক্তিশালী করার সুযোগ তৈরি করে।

শিক্ষা ও সামাজিক উদ্যোগের ক্ষেত্রে এই দিবস দেশের জন্য অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাণী কল্যাণ বিষয়ক কর্মশালা, তথ্যচিত্র প্রদর্শন এবং সামাজিক প্রচারণা আয়োজনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রাণীর প্রতি সহানুভূতি, দায়িত্ববোধ এবং পরিবেশ সচেতনতা বৃদ্ধি পায়। এটি শুধু ব্যক্তিগত নৈতিকতার বিষয় নয়, বরং সামাজিক ও সামগ্রিক পরিবেশগত সচেতনতার জন্যও প্রয়োজনীয়।

অতএব, বাংলাদেশে বিশ্ব প্রাণী দিবস কেবল আন্তর্জাতিক অনুষ্ঠান নয়; এটি দেশের মানুষের নৈতিক দায়িত্ব, জনস্বাস্থ্য, কৃষি ও পরিবেশ সংরক্ষণের সঙ্গে সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ বার্তা বহন করে। এটি মানুষের সঙ্গে প্রাণীর সহাবস্থানের ন্যায্যতা এবং দীর্ঘমেয়াদি টেকসই জীবনের জন্য সামাজিক ও নীতিগত ভাবনা উজ্জীবিত করার এক শক্তিশালী মাধ্যম হিসেবে কাজ করে।

প্রাণীদের প্রতি মানুষের দায়িত্ব শুধুমাত্র নৈতিক তাত্ত্বিকতার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; এটি সমাজ, স্বাস্থ্য, পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে সম্পর্কিত। আমাদের করণীয় হলো প্রাণীকে তাদের স্বাভাবিক অধিকার ও জীবনযাপন নিশ্চিত করার জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা। পথচারী, পোষা এবং কৃষিপ্রাণী—প্রতিটি ক্ষেত্রে সঠিক পরিচর্যা, স্বাস্থ্যসেবা ও নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করা প্রয়োজন। শহরায়ণ এলাকায় পথচারী কুকুর ও বিড়ালের নিবন্ধন, টিকা প্রয়োগ এবং খাবার ও আশ্রয়ের ব্যাবস্থা করা হলে জনস্বাস্থ্য ঝুঁকি হ্রাস পাবে এবং প্রাণী–মানব সহাবস্থান সুদৃঢ় হবে।

অপরদিকে, কৃষিপ্রাণী ও পোল্ট্রি শিল্পে এমন নীতিমালা গ্রহণ করা জরুরি যা প্রাণীর কল্যাণকে প্রাধান্য দেয় এবং উৎপাদনশীলতার সঙ্গে নৈতিকতা সমন্বয় করে। বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে বনাঞ্চল, জলাশয় ও অভয়ারণ্য রক্ষার পাশাপাশি অনিয়ন্ত্রিত শিকার ও পাচার রোধে কঠোর আইন প্রয়োগ অপরিহার্য। শিক্ষা ও জনসচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে মানুষকে প্রাণীর প্রতি সহানুভূতি ও দায়িত্ববোধে উদ্বুদ্ধ করতে হবে।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো প্রাণী–মানব সম্পর্ককে কেবল ভোগ বা সুবিধার মাধ্যমে নয়, বরং একটি নৈতিক, সামাজিক ও পরিবেশগত দায়বদ্ধতার অংশ হিসেবে গ্রহণ করা। বিশ্ব প্রাণী দিবস আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, প্রাণীর কল্যাণ নিশ্চিত করা মানেই মানব সভ্যতার স্থিতিশীলতা, নৈতিকতা ও পরিবেশের টেকসই উন্নয়নের নিশ্চয়তা। এটি আমাদের নির্দেশ করে যে, প্রতিটি পদক্ষেপে, প্রত্যেকটি নীতি ও সামাজিক উদ্যোগে প্রাণীর স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, যাতে আমরা প্রকৃতি এবং মানবতার সঙ্গে সমন্বিত ও ভারসাম্যপূর্ণ জীবনধারা স্থাপন করতে সক্ষম হই।

লেখক : গণমাধ্যমকর্মী।