ধর্ম কখনো রাজনীতির ভিত্তি হতে পারে না

আবীর আহাদ
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এক ঐতিহাসিক সত্য ঘোষণা করেছিলেন: “ধর্মের দোহাই দিয়ে রাজনীতি চলে না।” এই একটি বাক্যের মধ্যেই নিহিত আছে বাংলাদেশের রাষ্ট্রচিন্তা, নৈতিকতা ও মানবিক রাজনীতির মূল দর্শন। বঙ্গবন্ধুর কাছে ধর্ম ছিল আত্মার পবিত্রতার পথ, আর রাজনীতি ছিল মানুষের মুক্তি ও সমাজকল্যাণের সংগ্রাম। তিনি বারবার সতর্ক করেছিলেন, ধর্ম যখন রাজনীতির মুখোশে পরিণত হয়, তখন রাষ্ট্রে ন্যায় ও মানবতা বিপন্ন হয়।
পাকিস্তান আমলের শিক্ষা: ধর্মের মুখোশে শোষণ
পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠিত হয়েছিল ধর্মের ভিত্তিতে: “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, পাকিস্তান জিন্দাবাদ”- এই স্লোগানে। কিন্তু বাস্তবে ইসলামকে ব্যবহার করা হয়েছিল পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর রাজনৈতিক আধিপত্যের হাতিয়ার হিসেবে। ধর্মের নামে তখন চালানো হচ্ছিল সাংস্কৃতিক নিপীড়ন ও অর্থনৈতিক বৈষম্য।
বঙ্গবন্ধু সেই সময়েই উপলব্ধি করেন- “ধর্মের নামে যারা রাজনীতি করে, তারা ধর্মকে নয়, নিজেদের ক্ষমতাকে ভালোবাসে।” (বঙ্গবন্ধু ভাষণসমগ্র, খণ্ড ২, বাংলা একাডেমি, পৃ. ৩১২) এই অভিজ্ঞতাই তাঁকে শেখায়, :রাষ্ট্র টিকে থাকে ন্যায়, গণতন্ত্র ও সমতার ভিত্তিতে; ধর্মের নামে নয়।
স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান ও ধর্মনিরপেক্ষতা
স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের রাষ্ট্রনীতির চারটি মৌলিক ভিত্তি স্থির করেন: জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৮(১)-এ বলা হয়েছে: “রাষ্ট্রের মৌলিক নীতি হবে জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা।”
আর অনুচ্ছেদ ১২-এ স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে: “ধর্মনিরপেক্ষতা ও ধর্মীয় স্বাধীনতা নিশ্চিত করার জন্য—
(ক) কোনো রাজনৈতিক দল ধর্মের ভিত্তিতে গঠিত বা পরিচালিত হইবে না;
(খ) কোনো নাগরিককে কোনো ধর্ম গ্রহণে বাধ্য করা যাইবে না;
(গ) রাষ্ট্র কোনো ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করিতে পারিবে না।”
(বাংলাদেশের সংবিধান, ১৯৭২)
এই ধারাগুলোর মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্র থেকে ধর্মের অপব্যবহার রোধ করেন এবং ধর্মকে তার নৈতিক ও ব্যক্তিগত মর্যাদায় ফিরিয়ে দেন।
বঙ্গবন্ধুর দৃষ্টিতে ধর্ম ও রাজনীতি
বঙ্গবন্ধু স্পষ্ট করে বলেছিলেন, “আমরা মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান—সবাই প্রথমে বাঙালি, এই বাংলার সন্তান।” (বঙ্গবন্ধু ভাষণসমগ্র, খণ্ড ২, বাংলা একাডেমি, পৃ. ২১৮; ভাষণ—৩ মার্চ ১৯৭১, রেসকোর্স ময়দান)।
এই ঘোষণা শুধু ধর্মনিরপেক্ষতার রাজনৈতিক ভাষ্য নয়; এটি ছিল এক মানবতাবাদী দর্শন। বঙ্গবন্ধুর মতে, ধর্ম ও রাজনীতির সম্পর্ক কখনো আধিপত্যের নয়— মানবতার।
তিনি সংসদে বলেছিলেন- “ধর্মকে ব্যবহার করে কেউ যেন রাজনীতি করতে না পারে। ধর্ম মানুষের কল্যাণের জন্য, রাজনীতি মানুষের সেবার জন্য।” (সংবিধান প্রণয়ন সংক্রান্ত সংসদীয় কার্যবিবরণী, ৪ নভেম্বর ১৯৭২)
এই কথাগুলোর মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু ধর্ম ও রাজনীতির সীমারেখা নির্ধারণ করে দেন: ধর্ম হবে ব্যক্তিগত নৈতিকতার ক্ষেত্র, রাজনীতি হবে সামাজিক ন্যায়বিচারের ক্ষেত্র।
দার্শনিক বিশ্লেষণ
বঙ্গবন্ধুর চিন্তায় ধর্ম ও রাজনীতি একে অপরকে বিরোধিতা করে না, বরং একটি নৈতিক ভারসাম্য রক্ষা করে। তিনি বিশ্বাস করতেন: ধর্মের মূল হলো মানবপ্রেম ও সত্যের সাধনা, রাজনীতির মূল হলো ন্যায়, গণতন্ত্র ও কল্যাণের সাধনা।
ধর্মকে যদি রাজনীতির মুখোশে ঢেকে দেওয়া হয়, তবে তা মানুষের ঐক্য নয়, বিভেদ সৃষ্টি করে। তাই তিনি বলেছিলেন- “ধর্ম মানুষকে মানুষ হতে শেখায়; আর রাজনীতি মানুষকে মানুষের অধিকার দিতে শেখায়।” (বঙ্গবন্ধুর নির্বাচিত বক্তৃতা, জাতীয় জাদুঘর, ১৯৭৩ সালের ১৭ মার্চের ভাষণ, পৃ. ৭৪)। এই নীতিই বাংলাদেশের সংবিধানের মূল মানবতাবাদী দর্শনের ভিত্তি।
বঙ্গবন্ধুর নীতি বাস্তবে
১৯৭২-৭৫ সময়কাল ছিল বাংলাদেশের রাষ্ট্রে অসাম্প্রদায়িক চেতনার দৃঢ় প্রতিষ্ঠার যুগ। তিনি-
ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের অধিকার নিশ্চিত করেন, ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করেন, এবং সব ধর্মের উৎসবকে জাতীয় সংস্কৃতির অংশ হিসেবে দেখার আহ্বান জানান।
তিনি বলেছিলেন— “বাংলাদেশ হবে এমন দেশ, যেখানে মসজিদ, মন্দির, গির্জা ও প্যাগোডা—সবখানে মানুষ শান্তিতে প্রার্থনা করতে পারবে।” (বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান: নির্বাচিত ভাষণ ও সাক্ষাৎকার, সম্পাদক—মুহম্মদ হাবিবুর রহমান, পৃ. ১৩৬; ভাষণ: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ২০ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২)।
এই নীতির ফলে বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ হয়ে উঠেছিল দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে উদার, সহনশীল ও প্রগতিশীল রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রতীক।
সমকালীন প্রাসঙ্গিকতা
আজও বঙ্গবন্ধুর এই শিক্ষা অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। উপমহাদেশের নানা দেশে ধর্মকে ব্যবহার করা হচ্ছে ক্ষমতা ও বিভেদের রাজনীতির অস্ত্র হিসেবে। কখনো “ধর্ম রক্ষার” নামে সহিংসতা, কখনো সংখ্যালঘু নিপীড়ন, আবার কখনো রাজনৈতিক বিভাজন—এসবই সেই পুরোনো পাকিস্তানি কৌশলের পুনরাবৃত্তি।
বঙ্গবন্ধুর বার্তা ছিল স্পষ্ট
“ধর্মের দোহাই দিয়ে রাজনীতি চলে না; ধর্মকে রাজনীতির হাতিয়ার বানালে জাতি বিভক্ত হয়।”
(বঙ্গবন্ধু ভাষণসমগ্র, খণ্ড ৩, বাংলা একাডেমি, পৃ. ২৫৭)। তিনি চেয়েছিলেন এমন বাংলাদেশ, যেখানে ধর্ম থাকবে মানুষের বিবেকের স্থানে, রাজনীতির মঞ্চে নয়।
ধর্ম মানুষকে আত্মিকভাবে পরিশুদ্ধ করে, আর রাজনীতি সমাজকে ন্যায়ের পথে পরিচালিত করে। কিন্তু যখন ধর্ম রাজনীতির মুখোশ পরে, তখন ন্যায় হারিয়ে যায়, সমাজে জন্ম নেয় বিভাজন। অতএব, বঙ্গবন্ধুর দর্শন আমাদের শেখায়: “ধর্ম থাকবে শ্রদ্ধার স্থানে, রাজনীতি থাকবে ন্যায়ের আসনে।” বাংলাদেশের সংবিধান ও রাষ্ট্রচিন্তা আজও সেই মানবতাবাদী নীতির উত্তরাধিকার বহন করছে। তাঁর দর্শন তাই চিরন্তন: ধর্ম কখনো রাজনীতির ভিত্তি হতে পারে না, কারণ রাজনীতি যদি ধর্মের নামে চলে, তবে রাষ্ট্র হারায় ন্যায়ের দিকনির্দেশ; আর জনগণ হারায় ঐক্যের চেতনা।
লেখক : মুক্তিযোদ্ধা লেখক ও বিশ্লেষক।