সমৃদ্ধিময় জীবনের প্রত্যাশায় সৌভাগ্যের দেবী লক্ষ্মী পূজা

মানিক লাল ঘোষ
সনাতন ধর্মাবলম্বীদের অন্যতম ধর্মীয় উৎসব লক্ষ্মী পূজা। শাস্ত্রমতে ধন সম্পদ, সৌভাগ্য ও সৌন্দর্যের দেবী লক্ষ্মী। তিনি বিষ্ণুর পত্নী এবং তাঁর শক্তির ও উৎস। শারদীয় দুর্গোৎসব শেষে প্রথম পূর্ণিমা তিথিতে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা উন্নত ও সমৃদ্ধশালী জীবনের প্রত্যাশায় লক্ষ্মী দেবীর কৃপা পেতে ঘরে ঘরে এই পূজার আয়োজন করে। তবে কালের বিবর্তনে বিভিন্ন পূজা মন্ডপেও এই পূজার আয়োজনের প্রচলন শুরু হয়েছে।
এ পূজা কোজাগরী লক্ষ্মী পূজা নামেও পরিচিত। কোজাগরী শব্দটি এসেছে ‘কো জাগর্তী’ থেকে। হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বিশ্বাস, কোজাগরী পূর্ণিমা রাতে দেবী লক্ষ্মী ধন-ধান্যে ভরিয়ে দিতে হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িতে পূজা গ্রহণ করতে আসেন। আর ধন-ধান্যের আশায় আয়োজন করা হয় এই পূজার।
লক্ষ্মীপূজায় রাত্রি জাগরণ করা হয়। কোজাগরী অর্থাৎ কে জাগরী বা কে জেগে আছো। শাস্ত্রমতে এই রাতে লক্ষ্মী সবার বাড়িতে যান। যে গৃহের দরজা বন্ধ থাকে ও গৃহস্থরা ঘুমিয়ে থাকেন, সেখান থেকে লক্ষ্মী ফিরে আসেন। এ কারণে এই লক্ষ্মীপূজাকে কোজাগরী বলা হয় এবং রাত্রি জাগরণের নিয়ম পালন করা হয়। বাঙালি হিন্দুর ঘরে ঘরেই দেবী লক্ষ্মীর পূজা হয়ে থাকে। গৃহস্থরা প্রতি বৃহস্পতিবার লক্ষ্মীর পূজা করেন।
শাস্ত্রমতে, দেবী লক্ষ্মী ধন-সম্পদ তথা ঐশ্বর্যের প্রতীক। তবে হিন্দুধর্মালম্বীরা মনে প্রাণে বিশ্বাস করেন দেবী লক্ষ্মী এ ছাড়া ও উন্নতি আলো, জ্ঞান, সৌভাগ্য, উর্বরতা, দানশীলতা, সাহস ও সৌন্দর্যের ও প্রতীক। প্রাচীনকাল থেকেই তাই এই বিশ্বাস লালন করে রাজা-মহারাজা, ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে সাধারণ গৃহস্থ পর্যন্ত সবাই দেবীর লক্ষ্মীর পূজা করে আসছেন।
হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বিশ্বাস, লক্ষ্মী দেবী সন্তুষ্ট থাকলে সংসারে অর্থকষ্ট থাকবে না। সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ও আনন্দে ভাসবে পুরো পরিবার। বাড়বে আয় ও সমৃদ্ধি। তাই ঘরে ঘরে মা লক্ষ্মী ধন-সম্পদের দেবী হিসেবে পূজিত হন। ভক্তের ডাকে সাড়া দিয়ে প্রতিবছর দুর্গা পূজার পর প্রথম পূর্ণিমা তিথিতে এদিন লক্ষ্মী মর্ত্যে নেমে আসেন।
বাঙালির বিশ্বাসে লক্ষ্মীদেবী দ্বিভূজা ও তার বাহন প্যাঁচা। এবং হাতে থাকে শস্যের ভাণ্ডার। তবে বাংলার বাইরে লক্ষ্মীর চতুর্ভূজা কমলে-কামিনী মূর্তিই বেশি দেখা যায়। প্রায় প্রতিটি বাঙালি হিন্দুর ঘরে লক্ষ্মীপূজা করা হয।
পূজা-অর্চনার পাশাপাশি ঘর-বাড়ির আঙিনায় আঁকা হচ্ছে লক্ষ্মীর পায়ের ছাপের আল্পনা। সন্ধ্যায় ঘরে ঘরে প্রদীপ প্রজ্জালন করা হবে। বিভিন্ন মন্দিরসহ ঘরোয়া পরিবেশে লক্ষ্মীপূজার বিভিন্ন ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান সম্পন্ন করা হবে।
লক্ষ্মীপূজার গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হলো– সিঁদুর, ঘট, ধান, মাটি, আম্রপল্লব, ফুল, দূর্বা, তুলসীপাতা, হরীতকী, চন্দন, ধূপ, দীপ, নৈবেদ্য, আতপ চাল ও জল। লক্ষ্মীপূজায় মঙ্গলঘট, ধানের ছড়ার সঙ্গে গৃহস্থের আঙিনায় শোভা পায় চালের গুঁড়োর আলপনায় লক্ষ্মীর ছাপ। এ উপলক্ষ্যে রমণীরা উপবাস ব্রত পালন করেন।
আজ সারা দেশের বিভিন্ন মন্দির ও পূজা মন্ডপের পাশাপাশি হিন্দুদের ঘরে ঘরে পূজার সকল আনুষ্ঠানিকতা শেষে অতিথি আপ্যায়নের সময় সকল ধর্মের মিলনমেলায় পরিনত হবে প্রিয় বাংলাদেশ। সম্প্রীতির সেতুবন্ধনে নারকেল, তিল, মুগডালসহ বিভিন্ন রকমের নাড়ু, মুড়ি ও খইয়ের মোয়া খেতে খেতে বাঙালি ফিরে যাবে নষ্টাল জিয়ায়। কারো কারো কানে ভেসে আসবে সেই সুমধুর সুর, আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম আমরা, আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট।