বিশ্ব ডাক দিবস: বৈশ্বিক সংহতির ইতিহাস ও বাংলাদেশের অবদান

ওয়াজেদুর রহমান কনক
৯ অক্টোবর — এই দিনটি বিশ্বের প্রতিটি দেশেই ডাক বিভাগের অবদানকে স্মরণ করার দিন। ১৮৭৪ সালের এই দিনে সুইজারল্যান্ডের বার্ন শহরে স্বাক্ষরিত হয় ঐতিহাসিক “বার্ন চুক্তি”, যার মাধ্যমে গঠিত হয় Universal Postal Union (UPU)। এটি পরবর্তীতে জাতিসংঘের একটি বিশেষায়িত সংস্থা হিসেবে স্বীকৃতি পায়। ১৯৬৯ সালে টোকিওতে অনুষ্ঠিত UPU সম্মেলনে ৯ অক্টোবরকে “বিশ্ব ডাক দিবস” হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এই দিনটি পালনের উদ্দেশ্য হলো মানুষের মাঝে ডাক ব্যবস্থার ঐতিহাসিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক গুরুত্ব তুলে ধরা।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ কেবল সামরিক বা রাজনৈতিক লড়াই নয়; এটি ছিল এক গভীর যোগাযোগ-সংগ্রামও। যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে ডাক ব্যবস্থা যে রাজনৈতিক বার্তা দিয়ে সূচিত হয়েছিল, তা পাকিস্তানের ভেতরকার কলোনিয়াল রাষ্ট্র কাঠামোর মৃত্যুঘণ্টা ঘোষণা করেছিল। কারণ, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশের ডাক বিভাগ বিশ্ববাসীর সামনে প্রকাশ করে দেয়— এটি কোনো অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ নয়, বরং স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লড়াই।
রৌমারীতে স্থাপিত ফিল্ড পোস্ট অফিস উদ্বোধন করেন মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি এম. এ. জি. ওসমানী। এখান থেকেই মুক্তিযুদ্ধকালীন ডাক ব্যবস্থার সূচনা হয়। এই ডাক ব্যবস্থার মাধ্যমে যুদ্ধরত মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে কেন্দ্রীয় সরকারের যোগাযোগ রক্ষা, আন্তর্জাতিক সংবাদ প্রচার এবং জনমত সংগঠনের কার্যক্রম পরিচালিত হয়। ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহযোগিতায় গড়ে ওঠা এই যোগাযোগ কাঠামো ছিল স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রযন্ত্র গঠনের এক অনন্য নিদর্শন।
১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল ৮, থিয়েটার রোড, কলকাতা – ৭০০০৭১ ঠিকানায় বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তখন পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি ছিলেন, তাই তাঁর অনুপস্থিতিতে তাজউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে গঠিত মুজিবনগর সরকারই যুদ্ধকালীন রাষ্ট্র পরিচালনা ও ডাক বিভাগ পরিচালনার দায়িত্ব নেয়।
এই অস্থায়ী সরকারের তত্ত্বাবধানে ভারতের ডাক বিভাগ (Indian Post)–এর সহায়তায় যুদ্ধকালীন ডাক সেবা চালু হয়। ভারত সরকারের সহযোগিতায় বাংলাদেশের ডাক বিভাগের কার্যক্রম শুরু হয় কলকাতায়, যা ছিল স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম ডাক অফিস (Head Office)। এখান থেকেই মুক্তিযোদ্ধাদের চিঠি প্রেরণ, নীতিনির্ধারণ, যোগাযোগ এবং প্রচার কার্যক্রম সম্পন্ন হতো।
মুক্তিযুদ্ধকালীন ডাক বিভাগের ভূমিকা ছিল একদিকে যোগাযোগ ব্যবস্থার রক্তধারা, অন্যদিকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে রাজনৈতিক বার্তা প্রেরণের মাধ্যম। মুক্তাঞ্চল থেকে প্রেরিত প্রতিটি চিঠি ছিল স্বাধীনতার অঙ্গীকার ও বীরত্বের সাক্ষ্য। ডাক বিভাগের মাধ্যমে বাংলাদেশ সরকার ও মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ নীতি ও তথ্য বিনিময় সম্ভব হয়েছিল।
ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা ও মেঘালয়ে অবস্থিত মুক্তাঞ্চলগুলোতে ডাকঘর স্থাপন করা হয়, যেখানে মুক্তিযোদ্ধারা নিজেদের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করতেন। এই ডাকসেবার প্রতিটি খাম, সিলমোহর ও টিকিট হয়ে ওঠে মুক্তিযুদ্ধের নিদর্শন— এক ধরনের নীরব কূটনৈতিক দলিল, যা প্রমাণ করে রাষ্ট্রের অবকাঠামো তখনই গড়ে উঠেছিল।
ড. এস এম সারওয়ার মোর্শেদ রচিত “মুক্তিযুদ্ধে ডাকবিভাগ” গ্রন্থে উঠে এসেছে মুক্তিযুদ্ধকালীন ডাক ব্যবস্থার এই অনন্য ইতিহাস। তিনি মুক্তিযুদ্ধকালীন ডাক বিভাগের সাংগঠনিক বিকাশ, রাজনৈতিক তাৎপর্য, আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া এবং যুদ্ধপরবর্তী ডাক ব্যবস্থার পুনর্গঠনের বিশদ বিশ্লেষণ করেছেন।
মুক্তিযুদ্ধের সময় কলকাতার থিয়েটার রোডে গড়ে ওঠা সদর অফিসের মাধ্যমেই স্বাধীন বাংলাদেশের ডাক বিভাগের গোড়াপত্তন হয়। এখান থেকে ডাক সেবার প্রশাসনিক কার্যক্রম, ডাক কর্মীদের নিয়োগ, চিঠিপত্র প্রেরণ, মুক্তিযোদ্ধাদের যোগাযোগ এবং সরকারের সিদ্ধান্তসমূহ প্রচারিত হতো।
এই প্রতিষ্ঠান পরবর্তীতে বাংলাদেশের স্বাধীন প্রশাসনিক কাঠামোর একটি অপরিহার্য অঙ্গ হয়ে ওঠে।
এই দিবসটির সূচনা হয় ১৮৭৪ সালের ৯ অক্টোবর, যখন সুইজারল্যান্ডের রাজধানী বার্নে ২২টি দেশের প্রতিনিধিরা স্বাক্ষর করেন একটি ঐতিহাসিক চুক্তি— “বার্ন কনভেনশন”। এই চুক্তির মাধ্যমেই জন্ম নেয় General Postal Union, যা পরবর্তীকালে রূপ নেয় Universal Postal Union (UPU) নামে। ১৯৪৮ সালে জাতিসংঘের বিশেষ সংস্থা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়ে UPU হয়ে ওঠে আন্তর্জাতিক ডাক কার্যক্রমের কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রক সংস্থা। পরবর্তীতে ১৯৬৯ সালে টোকিওতে অনুষ্ঠিত UPU কংগ্রেসে আনুষ্ঠানিকভাবে ৯ অক্টোবরকে “বিশ্ব ডাক দিবস” ঘোষণা করা হয়।
বিশ্ব ডাক দিবসের মূল উদ্দেশ্য হলো— বিশ্বব্যাপী ডাক বিভাগের গুরুত্ব তুলে ধরা, ডাক কর্মীদের সম্মান জানানো, ডাক ও যোগাযোগব্যবস্থাকে আধুনিক প্রযুক্তির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করে তোলা, এবং রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক উন্নয়নে ডাক বিভাগের ভূমিকা প্রচার করা। এদিন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ডাকসেবা প্রদানে উৎকর্ষ অর্জনকারী কর্মীদের পুরস্কার প্রদান করা হয়, নতুন ডাকটিকিট ও স্মারক প্রকাশ করা হয়, এবং ডাক বিভাগের আধুনিকীকরণ নিয়ে আলোচনা-সেমিনার আয়োজন করা হয়।
ডাকব্যবস্থা মানব সভ্যতার যোগাযোগ ইতিহাসে এক অনন্য অধ্যায়। প্রাচীনকালে দূরবর্তী বার্তা প্রেরণের জন্য দূত ব্যবহারের যে প্রথা চালু ছিল, সেটি ক্রমে রূপ নেয় সংগঠিত ডাকসেবায়। আধুনিক ডাকব্যবস্থা শুধু চিঠিপত্র বিনিময়েই সীমাবদ্ধ নয়— এটি এখন অর্থ প্রেরণ, পার্সেল ডেলিভারি, ই-কমার্স, ব্যাংকিং ও বীমাসেবা পর্যন্ত বিস্তৃত। ডিজিটাল যুগেও ডাক বিভাগ তার ঐতিহ্য রক্ষা করে নতুন প্রযুক্তিকে আপন করে নিয়েছে। অনেক দেশে ডাক বিভাগ এখন জাতীয় ডিজিটাল নেটওয়ার্ক ও আর্থিক অন্তর্ভুক্তির গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম।
বর্তমানে পৃথিবীতে প্রায় ২০০টিরও বেশি দেশ Universal Postal Union–এর সদস্য, এবং বিশ্বের ডাক নেটওয়ার্কের মাধ্যমে প্রতিদিন কোটি কোটি চিঠি, পার্সেল ও আর্থিক সেবা আদানপ্রদান হয়। UPU–এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বিশ্বব্যাপী প্রায় ৫ মিলিয়নের বেশি ডাক কর্মী প্রতিদিন মানুষের হাতে চিঠি, বার্তা ও পণ্য পৌঁছে দেন। ডাকঘরের সংখ্যা প্রায় ৬ লক্ষাধিক, যার মধ্যে অর্ধেকের বেশি অবস্থিত গ্রামীণ বা প্রত্যন্ত এলাকায়— যেখানে ডাকঘর কেবল যোগাযোগের মাধ্যম নয়, বরং শিক্ষা, আর্থিক সেবা ও প্রশাসনিক যোগাযোগের কেন্দ্র হিসেবেও কাজ করে।
বিশ্ব ডাক দিবস উপলক্ষে প্রতি বছর UPU একটি নির্দিষ্ট বার্তা প্রকাশ করে, যেখানে ডাক বিভাগের নতুন চ্যালেঞ্জ ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা নিয়ে আলোকপাত করা হয়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এই বার্তাগুলোতে গুরুত্ব পেয়েছে “ডিজিটাল ট্রান্সফরমেশন”, “ই-কমার্স কানেক্টিভিটি”, “সবুজ ডাকব্যবস্থা” এবং “আন্তর্জাতিক পার্টনারশিপ” বিষয়গুলো। ডাক বিভাগ এখন কেবল চিঠির বাহক নয়, এটি হয়ে উঠেছে এক বহুমাত্রিক জনসেবা খাত।
বাংলাদেশে ডাক বিভাগের ইতিহাসও সমৃদ্ধ ও সংগ্রামমুখর। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে রৌমারীতে প্রতিষ্ঠিত ফিল্ড পোস্ট অফিসের মাধ্যমে বাংলাদেশ ডাক বিভাগের সূচনা ঘটে। মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বে থাকা অস্থায়ী সরকার ভারতের ডাক বিভাগ Indian Post–এর সহায়তায় কলকাতার ৮, থিয়েটার রোড ঠিকানায় বাংলাদেশের প্রথম ডাক সদর দপ্তর স্থাপন করে। যুদ্ধকালীন সময়ে এই ডাকব্যবস্থা মুক্তাঞ্চল ও আন্তর্জাতিক মহলে বাংলাদেশের রাজনৈতিক বার্তা পৌঁছে দিতে এক ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করে। এইভাবে ডাক বিভাগ হয়ে ওঠে স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্মযন্ত্রনার অংশ এবং যোগাযোগ ব্যবস্থায় এক নতুন রাষ্ট্রীয় পরিচয়ের ঘোষণা।
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ ডাক বিভাগ দেশজুড়ে যোগাযোগের বিস্তার, আর্থিক সেবা ও তথ্যপ্রবাহে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে। চিঠিপত্র বিতরণ থেকে শুরু করে মোবাইল মানি, ই-কমার্স ডেলিভারি, ই-পোস্ট— সব ক্ষেত্রেই ডাক বিভাগ আজ নতুন করে নিজেকে আধুনিক রূপে গড়ে তুলছে।
বিশ্ব ডাক দিবস আমাদের মনে করিয়ে দেয়— মানবসমাজে যোগাযোগের যে অক্ষয় সেতু নির্মিত হয়েছে, তার ভিত স্থাপিত হয়েছে ডাক ব্যবস্থার ওপর। প্রতিটি ডাককর্মী, প্রতিটি চিঠি ও প্রতিটি ডাকঘর বহন করে মানুষের আশা, ভালোবাসা, ইতিহাস ও রাষ্ট্রীয় অগ্রগতির সাক্ষ্য। ডিজিটাল যুগেও ডাক ব্যবস্থা তার প্রাসঙ্গিকতা হারায়নি; বরং সময়ের সঙ্গে পরিবর্তিত হয়ে এটি এখন এক বিশ্বব্যাপী মানবসংযোগের প্রতীক।
বিশ্ব ডাক দিবস (World Post Day) প্রতি বছর ৯ অক্টোবর পালিত হয়। ১৮৭৪ সালের এই দিনে সুইজারল্যান্ডের বার্ন শহরে প্রতিষ্ঠিত হয় Universal Postal Union (UPU)— যা আন্তর্জাতিক ডাকব্যবস্থাকে একত্রিত করার মাধ্যমে বৈশ্বিক যোগাযোগের নতুন যুগের সূচনা ঘটায়। পরবর্তীতে জাতিসংঘের একটি বিশেষায়িত সংস্থা হিসেবে UPU মানবসভ্যতার এক অনন্য ঐক্যসূত্রে পরিণত হয়। ১৯৬৯ সালে টোকিও কংগ্রেসে গৃহীত প্রস্তাব অনুযায়ী ১৯৭০ সাল থেকে বিশ্বব্যাপী ৯ অক্টোবর ‘বিশ্ব ডাক দিবস’ হিসেবে পালন করা শুরু হয়।
ডাকব্যবস্থা শুধু চিঠিপত্র আদানপ্রদানের একটি মাধ্যম নয়; এটি ছিল রাষ্ট্রীয় যোগাযোগ, অর্থনৈতিক লেনদেন, সাংস্কৃতিক বিনিময় এবং কূটনৈতিক সম্পর্কের মূল ভরকেন্দ্র। বিশ্ব ডাক দিবস এই বাস্তবতাকে স্মরণ করিয়ে দেয়— কীভাবে এক টুকরো খাম বা ডাকটিকিট রাষ্ট্র ও সমাজের ইতিহাসকে ধারণ করে। আজও বিশ্বের ১৯০টিরও বেশি দেশে ডাকব্যবস্থা প্রতিদিন কোটি কোটি মানুষকে সংযুক্ত করে রাখছে। UPU-র সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, প্রতি বছর প্রায় ৩৫০ বিলিয়ন ডাক সামগ্রী বিশ্বব্যাপী বিনিময় হয়, যার মধ্যে চিঠি, পার্সেল, সরকারি নথি ও ব্যবসায়িক কুরিয়ার অন্তর্ভুক্ত। ডিজিটাল যুগেও ডাক বিভাগ ই-কমার্স, ডিজিটাল পেমেন্ট, এবং সরকারি সেবায় অপরিহার্য ভূমিকা রাখছে।
বাংলাদেশে ডাক বিভাগের ইতিহাস এক বিশেষ তাৎপর্য বহন করে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালীন ডাকব্যবস্থা শুধুমাত্র একটি প্রশাসনিক পদক্ষেপ ছিল না, বরং এটি ছিল রাষ্ট্রীয় অস্তিত্বের প্রথম ঘোষণা।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে যখন পাকিস্তান সরকার বাংলাদেশের সমস্ত যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙে ফেলেছিল, তখন মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি এম. এ. জি. ওসমানী রৌমারীতে উদ্বোধন করেন ফিল্ড পোস্ট অফিস। এই ডাক অফিস থেকেই বিশ্ববাসী প্রথম জানতে পারে— এটি পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ সংকট নয়, বরং একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্মপ্রক্রিয়া। চিঠির মাধ্যমে পাঠানো বার্তাগুলোই প্রমাণ করেছিল, মুক্তিবাহিনী কেবল যুদ্ধ করছে না, বরং একটি রাষ্ট্র গঠনের জন্য প্রশাসনিক কাঠামোও গড়ে তুলেছে।
একই সময়ে ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল, কলকাতার ৮, থিয়েটার রোড (৭০০০৭১) ঠিকানায় গঠিত হয় বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার— মুজিবনগর সরকার। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তখন পাকিস্তানে বন্দি ছিলেন, আর তাজউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে গঠিত এই সরকার ভারতীয় ডাক বিভাগের সহায়তায় বাংলাদেশের ডাক বিভাগ চালু করে। ভারতের Indian Post ব্যবস্থার মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধাদের নির্দেশ, আন্তর্জাতিক সংবাদের আদানপ্রদান, এবং কূটনৈতিক বার্তা প্রেরণ করা হতো। কলকাতার থিয়েটার রোডই হয়ে ওঠে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম ডাক সদর দপ্তর— যা পরবর্তীতে দেশের ডাক বিভাগের জন্মস্থান হিসেবে স্বীকৃতি পায়।
ড. এস. এম. সারওয়ার মোর্শেদ তাঁর “মুক্তিযুদ্ধে ডাকবিভাগ” গ্রন্থে এই ইতিহাস বিস্তারিতভাবে লিপিবদ্ধ করেছেন। তিনি দেখিয়েছেন, কীভাবে প্রতিটি ডাক বার্তা স্বাধীনতার রাজনৈতিক দলিল হিসেবে কাজ করেছে এবং যুদ্ধরত জাতির রাষ্ট্রীয় কাঠামো গঠনে ভূমিকা রেখেছে।
বিশ্ব ডাক দিবসের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালীন ডাক ব্যবস্থার এই ইতিহাস বিশ্বব্যাপী ডাক সেবার মূল উদ্দেশ্যের সঙ্গে গভীরভাবে সংযুক্ত— মানুষকে সংযুক্ত করা, বার্তা পৌঁছে দেওয়া, আর সত্য ও স্বাধীনতার কথা বিশ্বকে জানানো।
আজ বিশ্ব ডাক দিবসে আমরা স্মরণ করি, ডাক শুধুই বার্তা নয়— এটি জাতির ইতিহাস, রাষ্ট্রের স্বপ্ন ও মানুষের হৃদয়ের সংযোগরেখা। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ডাক বিভাগ সেই সংযোগকে রক্ত ও ত্যাগের মূল্য দিয়ে প্রতিষ্ঠা করেছিল। যোগাযোগব্যবস্থা মানবসভ্যতার বিবর্তনে এমন এক মৌলিক শক্তি, যা রাষ্ট্র, অর্থনীতি, সংস্কৃতি, জ্ঞান ও রাজনীতির বিকাশকে প্রভাবিত করেছে। মানবজাতির প্রাচীনতম সভ্যতা থেকেই যোগাযোগ ছিল সামাজিক সংগঠনের প্রাণরস। ভাষার উদ্ভব, প্রতীকচিহ্নের ব্যবহার, দূত প্রেরণ, লিখিত পত্র প্রেরণ— এই ধারাবাহিক প্রক্রিয়াগুলো একদিকে যেমন মানুষকে সামাজিক জীবনে প্রবেশ করিয়েছে, অন্যদিকে রাষ্ট্রীয় কাঠামোর জন্ম দিয়েছে। ইতিহাসের প্রতিটি যুগে যোগাযোগের ধরন, গতি ও পরিধি সভ্যতার চরিত্র নির্ধারণ করেছে।
প্রাচীন মিশর, ব্যাবিলন, পারস্য, রোম কিংবা গুপ্ত ও মৌর্য সাম্রাজ্যের প্রশাসনিক দক্ষতা নির্ভর করত তাদের ডাকব্যবস্থা ও দূতব্যবস্থার উপর। প্রাচীন রোমান “Cursus Publicus” ছিল এমন এক ডাক ব্যবস্থা, যা শাসক ও প্রজার মধ্যে প্রশাসনিক নির্দেশাবলীর প্রবাহ নিশ্চিত করত। মধ্যযুগে ইসলামী খেলাফত প্রশাসনিক ও কূটনৈতিক যোগাযোগে ডাক ব্যবস্থাকে রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব হিসেবে গ্রহণ করে, যা পরবর্তীতে উমাইয়া ও আব্বাসীয় যুগে আন্তর্জাতিক যোগাযোগের রূপ নেয়।
ইউরোপীয় রেনেসাঁ ও আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার উত্থানের সঙ্গে যোগাযোগ প্রযুক্তি নতুন যুগে প্রবেশ করে। ১৫শ শতাব্দীতে মুদ্রণযন্ত্রের আবিষ্কার শুধু জ্ঞানের প্রসার ঘটায়নি, বরং রাজনৈতিক মতাদর্শ, ধর্মীয় সংস্কার ও জাতীয়তাবাদের প্রসারকে ত্বরান্বিত করেছে। ১৯শ শতাব্দীতে ডাকটিকিট ও সার্বজনীন ডাকব্যবস্থা উদ্ভাবনের ফলে যোগাযোগ হয়ে ওঠে গণমানুষের অধিকার। ১৮৭৪ সালে সুইজারল্যান্ডে Universal Postal Union (UPU) প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বিশ্ব এক অভিন্ন ডাক নেটওয়ার্কে যুক্ত হয়— যা পরবর্তীকালে বৈশ্বিক সংহতির প্রতীক হয়ে ওঠে।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় ডাক ও যোগাযোগ ব্যবস্থা রাষ্ট্রগঠনের পূর্বশর্ত হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। মুক্তাঞ্চলের ফিল্ড পোস্ট অফিস ও কলকাতার থিয়েটার রোডের সদর দপ্তর প্রমাণ করে যে, যোগাযোগ ব্যবস্থার মাধ্যমে একটি রাষ্ট্রের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক অস্তিত্ব বিশ্বকে জানানো সম্ভব। স্বাধীনতার পর এই ধারাটি অব্যাহত থেকে দেশের উন্নয়ন পরিকল্পনায় যোগাযোগ ব্যবস্থাকে জাতীয় অগ্রাধিকার দেয়।
বর্তমান বিশ্বে যোগাযোগ প্রযুক্তির রূপান্তর ঘটেছে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের মধ্য দিয়ে। টেলিকমিউনিকেশন, স্যাটেলাইট, ইন্টারনেট, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, ডিজিটাল ডাক সেবা— এই সব উপাদান আজ রাষ্ট্রীয় নীতি, অর্থনৈতিক প্রবাহ, ও নাগরিক জীবনের কেন্দ্রবিন্দুতে। ২০২৪ সালের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বব্যাপী ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৫.৩ বিলিয়ন ছাড়িয়েছে; মোবাইল সংযোগ সক্রিয় রয়েছে ৮.৬ বিলিয়ন। শুধুমাত্র ডাক খাতে বার্ষিক লেনদেনের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারেরও বেশি, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য অংশ এসেছে ই-কমার্স সেবার মাধ্যমে।
বাংলাদেশেও ডাক ব্যবস্থা ও টেলিকম খাত জাতীয় অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তিতে পরিণত হয়েছে। ডাক বিভাগ আজ ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে রূপান্তরিত, যেখানে ‘ডাকপিওন অ্যাপ’, ‘ই-পোস্ট’, ‘ই-পার্সেল’, ‘ডাক ব্যাংকিং’, এবং ‘ডাকঘর সঞ্চয় ব্যাংক’ দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কাছে আর্থিক অন্তর্ভুক্তির নতুন পথ খুলে দিয়েছে। এই সেবাগুলো শুধু তথ্য প্রবাহ নয়, বরং অর্থনৈতিক প্রবাহেরও সমান্তরাল ব্যবস্থা তৈরি করছে।
যোগাযোগ ব্যবস্থার আধুনিক অবদান কেবল তথ্যের গতি বাড়ানো নয়, বরং রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তগ্রহণ ও সামাজিক অংশগ্রহণে গণতান্ত্রিক চেতনার বিকাশ ঘটানো। আজ নাগরিক মতামত, জনমত জরিপ, অনলাইন শিক্ষা, টেলিমেডিসিন, ও ভার্চুয়াল কূটনীতি— সব ক্ষেত্রেই যোগাযোগ প্রযুক্তি জ্ঞানের গণতন্ত্রীকরণ ঘটাচ্ছে।
ভবিষ্যতের যোগাযোগব্যবস্থা আরও গভীর ও অন্তর্ভুক্তিমূলক হবে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI), কোয়ান্টাম ইন্টারনেট, ৬জি প্রযুক্তি, স্যাটেলাইট নেটওয়ার্ক, এবং ইন্টারনেট অব থিংস (IoT) একত্রে এমন এক বুদ্ধিমান যোগাযোগব্যবস্থা গড়ে তুলবে, যেখানে প্রতিটি বস্তু, নাগরিক, ও প্রতিষ্ঠান একটি সংযুক্ত জ্ঞানের পরিকাঠামোর অংশ হয়ে যাবে। ভবিষ্যতে রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারণ, বৈশ্বিক বাণিজ্য, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, এমনকি শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতও এই যোগাযোগনির্ভর কাঠামোর মধ্য দিয়ে পরিচালিত হবে।
তবে এই সম্ভাবনার পাশাপাশি নৈতিকতা, গোপনীয়তা ও তথ্য-নিরাপত্তা এক নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে। ডেটা মনোপলি, সাইবার হুমকি, এবং প্রযুক্তিগত বৈষম্য ভবিষ্যতের যোগাযোগব্যবস্থাকে রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত করতে পারে। সুতরাং, পিএইচডি স্তরের গবেষণায় আজ প্রয়োজন— যোগাযোগব্যবস্থাকে কেবল প্রযুক্তিগত নয়, বরং সমাজবিজ্ঞান, নৃবিজ্ঞান, ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করা।
যোগাযোগব্যবস্থা মানবজাতির সভ্যতাকে যেমন জন্ম দিয়েছে, তেমনি আধুনিক রাষ্ট্রের নীতি, অর্থনীতি ও সংস্কৃতিকে পরিচালনা করছে। ইতিহাসে এটি ছিল রাষ্ট্রের ভাষা; বর্তমান বিশ্বে এটি নাগরিকের কণ্ঠস্বর; আর ভবিষ্যতে এটি হবে সমগ্র মানবজাতির সম্মিলিত জ্ঞানের প্রতীক।
লেখক : গণমাধ্যমকর্মী।