আইবিএস চিকিৎসায় হোমিও সমাধান

ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ
বর্তমান সময়ের অন্যতম সাধারণ কিন্তু জটিল পেটের রোগ হলো আইবিএস (Irritable Bowel Syndrome)। বিশ্বজুড়ে লক্ষ লক্ষ মানুষ প্রতিনিয়ত এই অসুখে ভুগছেন। রোগটি জীবননাশকারী নয়, কিন্তু এটি রোগীর জীবনমানকে মারাত্মকভাবে নষ্ট করতে পারে। পেটব্যথা, গ্যাস, কোষ্টবদ্ধতা, ডায়রিয়া, মানসিক অস্থিরতা—সব মিলিয়ে রোগী শারীরিক ও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন।
বাংলাদেশেও এ রোগের প্রকোপ বাড়ছে উদ্বেগজনক হারে। গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতি ১০০ জন নারীর মধ্যে ২৭ জন এবং প্রতি ১০০ জন পুরুষের মধ্যে প্রায় ২০ জন এই রোগে আক্রান্ত। কিন্তু অধিকাংশ মানুষই জানেন না যে তাঁদের এই উপসর্গগুলো আসলে আইবিএসের ইঙ্গিত। তাই সময়মতো সঠিক রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসাই হতে পারে এ রোগের প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণের চাবিকাঠি।
আইবিএস কী?
আইবিএস হলো অন্ত্রের কার্যকারিতাজনিত একটি দীর্ঘস্থায়ী অসুখ, যেখানে অন্ত্রের গতি ও স্নায়ুর সংবেদনশীলতা অস্বাভাবিক হয়ে যায়। ফলে পেটে ব্যথা, ফাঁপা ভাব, অতিরিক্ত গ্যাস, কোষ্টবদ্ধতা ও ডায়রিয়া দেখা দেয়। এটি একটি ফাংশনাল বা কার্যকরী রোগ, অর্থাৎ অন্ত্রের ভেতরে কোনো দৃশ্যমান ক্ষত বা প্রদাহ না থাকলেও এর কার্যক্রমের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায়।সাধারণত ২০ থেকে ৪০ বছর বয়সীদের মধ্যে এ রোগ বেশি দেখা যায়, তবে শিশু ও বৃদ্ধরাও মুক্ত নয়।
আইবিএসের প্রকারভেদ
১. স্প্যাস্টিক কোলন: প্রধানত পেটে ব্যথা ও কোষ্টবদ্ধতা; টয়লেটের পর কিছুটা স্বস্তি আসে।
২. ফাংশনাল ডায়রিয়া: ঘন ঘন পাতলা পায়খানা হয়, বিশেষ করে সকালে ঘুম থেকে ওঠার পরপরই।
৩. ফোরগাট ডিসমোটিলিটি: খাবার খাওয়ার পর পেট ফেঁপে যাওয়া, গ্যাস হওয়া ও ডান পাশে ব্যথা।
আইবিএসের কারণসমূহ
১. মানসিক চাপ ও উদ্বেগ – অতিরিক্ত মানসিক চাপ, দুশ্চিন্তা, বিষণ্নতা বা ভয় স্নায়ুতন্ত্রকে প্রভাবিত করে।
২. অনিয়মিত খাদ্যাভ্যাস – দীর্ঘ সময় না খাওয়া বা রাতে ভারী খাবার খাওয়া।
৩. অতিরিক্ত ফাস্টফুড ও প্রক্রিয়াজাত খাবার – অন্ত্রের ব্যাকটেরিয়া ভারসাম্য নষ্ট করে।
৪. গ্যাস ও হজমজনিত সমস্যা – বদহজম ও ফাঁপা পেট আইবিএস বাড়ায়।
৫. খাবারে অ্যালার্জি বা অসহিষ্ণুতা – দুধ, গম, পেঁয়াজ, রসুন, চকলেট, কোমল পানীয় ইত্যাদি।
৬. সংক্রমণ-পরবর্তী দুর্বলতা – কোনো ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়াজনিত ডায়রিয়ার পর অন্ত্র দুর্বল হয়ে যায়।
৭. হরমোনাল প্রভাব – বিশেষ করে নারীদের মাসিকের সময় হরমোন পরিবর্তন অন্ত্রকে প্রভাবিত করে।
৮. অতিরিক্ত ওষুধ ব্যবহার – অ্যান্টিবায়োটিক ও ব্যথানাশক ওষুধ অন্ত্রের উপকারী জীবাণু ধ্বংস করে।
৯. অপর্যাপ্ত ঘুম – নিদ্রাহীনতা শরীরের হরমোন ভারসাম্য নষ্ট করে।
১০. ব্যায়ামহীন জীবনযাপন ও মানসিক আঘাত শরীরচর্চার অভাব ও মানসিক ধাক্কা আইবিএস বাড়ায়।
আইবিএসের লক্ষণসমূহ
১. পেটে ব্যথা বা টান
২. টয়লেটের পর ব্যথা উপশম হওয়া
৩. গ্যাস, ঢেকুর ও পেট ফাঁপা ভাব
৪. কোষ্টবদ্ধতা ও পর্যায়ক্রমে পাতলা পায়খানা
৫. বমি বমি ভাব ও হজমে অস্বস্তি
৬. মলের সঙ্গে মিউকাস নির্গমন
৭. ক্ষুধামন্দা, মাথা ভার, ক্লান্তি
৮. ঘন ঘন পায়খানার তাগিদ
৯. ওজন কমে যাওয়া বা দুর্বলতা
১০. যৌন দুর্বলতা বা ইচ্ছাশক্তি হ্রাস
১১. মানসিক অস্থিরতা, উদ্বেগ, খিটখিটে মেজাজ
রোগ নির্ণয়
১. CBC: সংক্রমণ বা অ্যানিমিয়া আছে কিনা দেখা হয়।
২. Stool Test: সংক্রমণ বা রক্তপাত শনাক্ত করা হয়।
৩. Food Allergy Test: নির্দিষ্ট খাবারে অসহিষ্ণুতা নির্ধারণ।
৪. Colonoscopy: কোলন ও মলাশয়ের অবস্থা পরীক্ষা।
৫. Endoscopy: পাকস্থলীর অবস্থা যাচাই।
৬. Liver Enzyme Test (SGOT, SGPT): লিভারের কার্যকারিতা দেখা।
৭. Thyroid Test: হরমোনের ভারসাম্য যাচাই।
শিশুদের আইবিএস
শিশুরাও আইবিএসে আক্রান্ত হতে পারে, বিশেষ করে ২ বছর থেকে ১৬ বছর বয়সী শিশুদের মধ্যে। অনেক সময় এটি অন্য রোগের সঙ্গে মিশে যায়, যেমন গ্যাস্ট্রিক, কৃমি, দুধের অ্যালার্জি বা হজমের সমস্যা।
শিশুদের আইবিএসের সাধারণ লক্ষণ
১. ঘন ঘন পেট ব্যথা, বিশেষ করে খাওয়ার পর বা সকালে
২. মাঝে মাঝে পাতলা বা শক্ত পায়খানা
৩. গ্যাস, বমি ভাব ও পেট ফেঁপে থাকা
৪. খাবার পর অস্বস্তি বা পেট মোচড়ানো
৫. ক্ষুধামন্দা, ক্লান্তি ও খিটখিটে ভাব
২ বছর বয়সী শিশুদের আইবিএস
২ বছর বয়সী শিশুরাও আক্রান্ত হতে পারে, যদিও এটি তুলনামূলকভাবে বিরল। ছোটরা তাদের অস্বস্তি প্রকাশ করতে পারে না, তাই অভিভাবককে লক্ষ্য রাখতে হয়।
লক্ষণ:* পেট ব্যথা বা পেট ফুলে থাকা * দিনে কয়েকবার পাতলা বা শক্ত মল * পায়খানার সময় কান্না বা অস্বস্তি * খাওয়ার পর পেট মোচড়ানো বা বমি বমি ভাব * ঘুম কমে যাওয়া বা কান্নাকাটি
কারণ:* দুধ বা ল্যাকটোজ অসহিষ্ণুতা * অ্যান্টিবায়োটিকের অতিরিক্ত ব্যবহার * অতিরিক্ত মিষ্টি বা ফলের জুস * গ্যাস উৎপাদক খাবার (শিম, ফুলকপি, কোমল পানীয়) * মানসিক চাপ বা অনিয়মিত ঘুম
যত্ন ও প্রতিকার:* ল্যাকটোজ-ফ্রি দুধ দিন যদি দুধে সমস্যা হয় * টক দই, ভাত, ডাল, সবজি দিন * অতিরিক্ত চিনি বা কোমল পানীয় বন্ধ করুন * পর্যাপ্ত পানি ও ঘুম নিশ্চিত করুন। সতর্ক সংকেত * পায়খানায় রক্ত * ওজন না বাড়া * দীর্ঘস্থায়ী ডায়রিয়া বা কোষ্টবদ্ধতা * শিশুর দুর্বলতা বা অস্বাভাবিক কান্না। * অধিকাংশ ক্ষেত্রেই শিশুর আইবিএস খাদ্যাভ্যাস ও প্রোবায়োটিক ব্যবহারে নিয়ন্ত্রণে আসে।
আইবিএসের সম্ভাব্য জটিলতা
১. দীর্ঘস্থায়ী অপুষ্টি ও ওজন হ্রাস
২. পানিশূন্যতা ও ইলেকট্রোলাইট ভারসাম্য নষ্ট
৩. অ্যানিমিয়া ও দুর্বলতা
৪. ঘুমের ব্যাঘাত ও মানসিক অবসাদ
৫. কর্মক্ষমতা হ্রাস ও মনোযোগের ঘাটতি
৬. দীর্ঘমেয়াদি গ্যাস্ট্রিক আলসার বা হেমোরয়েড
আইবিএস রোগে যা বর্জনীয়
১. ঝাল, মশলাযুক্ত ও চর্বিযুক্ত খাবার
২. দুধ ও দুধজাত খাবার (টক দই ছাড়া)
৩. গম, ময়দা ও সাদা আটা
৪. চিনি, কোমল পানীয় ও সোডা
৫. চা, কফি ও অ্যালকোহল
৬. ফাস্টফুড ও ভাজাপোড়া
৭. অতিরিক্ত তেল ও কার্বোনেটেড পানীয়
৮. অনিয়মিত খাবার ও রাত জাগা
প্রতিকার
খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন: * সহজপাচ্য ও আঁশযুক্ত খাবার খান (ফল, শাকসবজি, ব্রাউন রাইস)। * নিয়মিত পর্যাপ্ত পানি পান করুন। * অতিরিক্ত গরম বা ঠাণ্ডা খাবার পরিহার করুন। * ধীরে ধীরে খাওয়ার অভ্যাস করুন। * দুধে সমস্যা থাকলে টক দই বা প্রোবায়োটিক গ্রহণ করুন।
জীবনধারাগত পরিবর্তন: * নিয়মিত হাঁটাচলা ও হালকা ব্যায়াম করুন। * ধ্যান, যোগ বা শ্বাস-প্রশ্বাস অনুশীলন করুন। * পর্যাপ্ত ঘুম নিশ্চিত করুন। * প্রতিদিন একই সময়ে টয়লেটের অভ্যাস গড়ে তুলুন।* কাজের ফাঁকে বিশ্রাম নিন ও মন ভালো রাখুন।
হোমিও সমাধান
আইবিএস বা ইরিটেবল বাওয়েল সিনড্রোম হলো অন্ত্রের এক দীর্ঘস্থায়ী কার্যকরী ব্যাধি, যেখানে রোগী বারবার পেটব্যথা, গ্যাস, অম্বল, ডায়রিয়া বা কোষ্ঠকাঠিন্যের মতো উপসর্গে ভোগেন। আধুনিক চিকিৎসায় সাধারণত উপসর্গ নিয়ন্ত্রণ করা হয়, কিন্তু হোমিওপ্যাথি রোগের মূল কারণ—রোগীর মানসিক অবস্থা, দেহপ্রকৃতি ও জীবনযাপন—এসব বিষয় বিচার করে চিকিৎসা প্রদান করে।হোমিওপ্যাথির মূলনীতি হলো “রোগ নয়, রোগীকে চিকিৎসা করা।” তাই একই রোগেও আলাদা রোগীর জন্য ভিন্ন ভিন্ন ওষুধ প্রয়োজন হয়। অভিজ্ঞ হোমিও চিকিৎসক রোগীর মানসিক অবস্থা, খাদ্যাভ্যাস, ঘুম, রাগ-চিন্তা, হজমক্ষমতা ইত্যাদি বিবেচনা করে ওষুধ নির্বাচন করেন। আইবিএস-এর ক্ষেত্রে যে হোমিও ঔষধগুলো প্রায়ই ব্যবহৃত হয়, সেগুলো হলো—ন্যাক্স ভূমিকা: মানসিক চাপ, অনিয়মিত খাদ্যাভ্যাস, অতিরিক্ত চা, কফি বা মসলাযুক্ত খাবারে হজমের সমস্যা, কোষ্ঠকাঠিন্য ও পেটব্যথায় কার্যকর। লাইকোপোডিয়াম: যাদের খাবারের পর পেট ফেঁপে যায়, গ্যাস হয়, ঢেঁকুর ওঠে এবং ডানদিকের পেটে ব্যথা হয়।
কোলোসিন্থিস: যাদের পেটব্যথা চেপে ধরলে কমে যায় এবং রাগ বা মানসিক আঘাতের পর ব্যথা বেড়ে যায়। অ্যালো সোকোট্রিনা: বারবার পায়খানার তাগিদ, পেট মোচড়ানো ব্যথা ও মলদ্বারে জ্বালাপোড়ায় উপকারী। চায়না: অতিরিক্ত গ্যাস, হজমে দুর্বলতা, মাথা ঘোরা ও পেট ফাঁপার মতো উপসর্গে প্রয়োগ করা হয়। সালফার: দীর্ঘদিনের হজমের সমস্যা, সকালে পেট খারাপ ও জ্বালাযুক্ত পায়খানায় কার্যকর। পালসেটিলা: মানসিক পরিবর্তন, চর্বিযুক্ত খাবারে অরুচি, ঢেঁকুর ও গ্যাসে কষ্টে উপযোগী। কার্বো ভেজিটাবিলিস: যাদের গ্যাসের সমস্যা অতিরিক্ত, সামান্য খাওয়ার পরই পেট ভার লাগে, তাদের জন্য উপকারী। আর্জেন্ট নাইট্রিক: মানসিক উৎকণ্ঠা বা ভয় থেকে ডায়রিয়া হলে এই ওষুধ সাহায্য করে।
ব্রায়োনিয়া: খাওয়া বন্ধ রাখলে ব্যথা কমে, নড়াচড়া করলে ব্যথা বাড়ে—এমন রোগীদের জন্য উপকারী। আর্সেনিক অ্যালবাম: খাওয়া-দাওয়ার অরুচি, দুর্বলতা, জ্বালাযুক্ত পায়খানা ও উদ্বেগে কার্যকর। ন্যাট্রাম মিউর: মানসিক আঘাত বা কষ্টে যাদের হজমে সমস্যা হয় এবং ক্ষুধা কমে যায়, তাদের জন্য উপযোগী। ফসফরাস: হজমের দুর্বলতা, গ্যাস, বুকজ্বালা ও ক্লান্তিতে কার্যকর।
ক্যালকেরিয়া কার্বনিকা: দুর্বল হজম, স্থূলতা ও মানসিক দুশ্চিন্তায় আক্রান্ত রোগীদের জন্য উপকারী।সাইলিসিয়া: দীর্ঘদিনের হজম সমস্যা, পেট ফাঁপা ও শক্তির অভাবে ব্যবহৃত হয়।বেলাডোনা: হঠাৎ তীব্র পেটব্যথা, গরম ভাব ও ক্র্যাম্প জাতীয় সমস্যায় উপকারী।
মারকিউরাস সল: ঘন ঘন পায়খানার তাগিদ, মলদ্বারে জ্বালাপোড়া ও দুর্গন্ধযুক্ত পায়খানায় সহায়ক।হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা ব্যক্তিনির্ভর হওয়ায় রোগের সব দিক জেনে, রোগীর সম্পূর্ণ অবস্থার ওপর ভিত্তি করে ওষুধ নির্বাচন করতে হয়। তাই নিজে থেকে ওষুধ না নিয়ে একজন অভিজ্ঞ হোমিও চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া অত্যন্ত জরুরি। নিয়মিত চিকিৎসা, মানসিক প্রশান্তি, পরিমিত খাবার, পর্যাপ্ত বিশ্রাম ও মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে আইবিএস থেকে ধীরে ধীরে স্থায়ী আরোগ্য লাভ করা সম্ভব।
পরিশেষে, আইবিএস কোনো মারাত্মক বা সংক্রামক রোগ নয়, কিন্তু এটি দীর্ঘস্থায়ী কষ্ট ও মানসিক চাপের কারণ হতে পারে। রোগটিকে সম্পূর্ণ নিরাময় করা না গেলেও সচেতন জীবনযাপন, সুষম খাদ্যাভ্যাস ও মানসিক প্রশান্তি বজায় রাখলে এটি সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো—রোগটি অবহেলা না করা। দীর্ঘদিন ধরে চলা পেটব্যথা, কোষ্টবদ্ধতা বা ডায়রিয়াকে “সাধারণ সমস্যা” ভেবে ফেলে রাখলে তা ভবিষ্যতে জটিল অবস্থায় পৌঁছাতে পারে। সঠিক রোগ নির্ণয়, নিয়মিত চিকিৎসা ও মানসিক প্রশান্তিই আইবিএস থেকে মুক্তির একমাত্র পথ।
লেখক : কলাম লেখক ও গবেষক, প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি।