স্থিতাবস্থা বজায় রাখার নির্দেশ আদালতের
শ্যামনগরে হিন্দু সম্প্রদায়ের জমির উপর দিয়ে রাস্তা নির্মাণের চেষ্টা, তিন নারী জখম

রঘুনাথ খাঁ, সাতক্ষীরা : বেড়া ও গাছগাছালি কেটে হিন্দু সম্প্রদায়ের জমির উপর দিয়ে রাস্তা নির্মাণের চেষ্টা করা হয়েছে। বাধা দেওয়ায় ওই পরিবারের তিন নারীকে মারপিট করা হয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার সকাল থেকে বুধবার সকাল ৯টা পর্যন্ত নৌবাহিনীর সদস্য জহির গাজীর নেতৃত্বে সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার মুন্সিগঞ্জ ইউনিয়নের জেলেখালি গ্রামের বিষ্টুপদ পরমান্যের বাড়িতে এ ঘটনা ঘটে।
আহতরা হলেন- জেলেখালি গ্রামের ধর্মদাস পরমান্যের স্ত্রী বাসন্তী পরমান্য, প্রশান্ত পরমান্যের স্ত্রী অনিতা পরমান্য ও তাপস পরমান্যের স্ত্রী বিভা পরমান্য।
জেলেখালি গ্রামের বিষ্টুপদ পরমান্য জানান, ২০০৪ সালে একই গ্রামের সুশীল ম-লের কাছ থেকে ৩২ শতক জমি কিনে তিনি সেখানে নিজের ও চার সন্তানের বসতঘর, রান্নাঘর, গোয়ালঘর ও কাঠঘর বানিয়ে, গাছ গাছালি লাগিয়ে শান্তিপূর্ণ ভোগদখলে ছিলেন। ২০১১ সালে তাদের বাড়ির পূর্ব পাশের বিলে বংশীপুরের জহুরুল গাজীর ছেলে জহির গাজী রাস্তাঘাট বিহীন কম দামে আট শতক জমি কেনেন। তিনি নৌবাহিনীর খুলনা শাখায় সিপাহী হিসেবে কাজ করার সুবাদে গত বছরের ৫ আগষ্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকে তাদের জমি জবরদখল করে রাস্তা বানিয়ে নিজের জমিতে যাওয়ার পরিকল্পনা করেন। কয়েক মাস আগে তিনি কালিগঞ্জ ক্যাম্পের সেনা কর্মকর্তাকে মিথ্যা তথ্য দিয়ে তাদের জমির উপর ঘরবাড়ি ভেঙে ও গাছগাছালি কেটে রাস্তা তৈরির উদ্যোগ নেন। একপর্যায়ে উভয়পক্ষকে সেনা ক্যাম্পে ডেকে শুনানী শেষে সেনা সনা কর্মকর্তা সরেজমিনে এসে বিষয়টি সমাধানের জন্য কালিগঞ্জ সহকারি ভূমি কমিশনারকে (ভূমি) নির্দেশ দেন।
সহকারি কমিশনার তদন্ত করে তাদের জমির উপর থাকা রান্না ঘর, গোয়ালঘর ও কাঠঘর ভেঙে রাস্তা দেওয়া সম্ভব নয় বলে জানিয়ে দেন। এরপরও জহির আবারো সেনাবাহিনীর শরনাপন্ন হলে উভয়পক্ষকে ক্যাম্পে ডাকা হয়। সেখানে স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান ও মেম্বরদের উপস্থিতিতে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য বলা হয়। মুন্সিগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদে শালিসি সভা শেষে আড়াই লাখ টাকা দিয়ে রাস্তার জায়গা দেওয়ার ব্যাপারে সিদ্বান্ত হয়। কিন্তু পরবর্তীতে জহির ওই সিদ্ধান্ত মানেননি। একপর্যায়ে জহির তার মামা সালাম কাগুচীসহ কয়েকজনের সহযোগিতায় তাদের (বিষ্টু) ঘেরা ও বেড়া ভেঙে, গাছগাছালি কেটে রাস্তা বের করার পরিকল্পনা নেয়।
বিষয়টি জানতে পেরে তিনি অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট আদালতে মামলার করার সিদ্ধান্ত নিলে মঙ্গলবার সকালে জহির নেপথ্যে থেকে তার স্ত্রী রুবিনা ও মামা সালাম কাগুচীসহ কয়েক জনকে দিয়ে তাদের ঘেরা, কলাগাছ কেটে ও গোয়ালঘর ভেঙে রাস্তা বানাতে থাকেন। তারা বাধা দিলে তার তিন পুত্রবধুকে পিটিয়ে জখম করা হয়। তাদরেকে স্থানীয়ভাবে চিকিৎসা দেওয়া হয়। জানানো হয় পুলিশ ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে। ছুঁটে আসেন উপজেলা জামায়াতের আমীর আব্দুর রহমান, ইউপি সদস্য দেবাশীষ গাইন ও আব্দুল জলিল। তাদের ও প্রশাসনের পক্ষ থেকে জহির ও তার লোকজনদের সতর্ক করা হলেও বুধবার সকালে জহিরের স্ত্রী রুবিনা, ভাইপো ও মামাদের নিয়ে তাদের জমির উপর দিয়ে ইট, টিন, এসবের্স্টর্স নিয়ে যান। বাধা দেওয়ায় উভয়পক্ষের মধ্যে কথাকাটাকাটির একপর্যায়ে ধাক্কাধাক্কি হয়। সকাল ৯টার দিকে পুলিশ এসে জহিরের অবৈধ কাজ বন্ধ করে দিয়ে বিকেলে উভয়পক্ষকে থানায় যেয়ে বসাবসির কথা বলে যান।
এদিকে জমি জবরদখলের চেষ্টার ঘটনায় বিষ্টু পরম্যান্যের ছেলে তাপস পরমান্য বাদি হয়ে জহির গাজী ও তার স্ত্রী সাবিনা আক্তারসহ কয়েকজনকে বিবাদী করে সাতক্ষীরার অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট আদালতে ১৪৫ ধারায় একটি মামলা দায়ের করেন। বিচারক রিপন বিশ্বাস বিরোধপূর্ণ ৩২ শতক জমিতে স্থিতাবস্থা (স্টাটাস-কো) বজায় রাখার জন্য নির্দেশ দেন। একইসাথে বিবাদীপক্ষকে ওই জমি দখল করা কেন অবৈধ হবে না তা জানতে চেয়ে কারণ দর্শাণোর নোটিশ জারির নির্দেশ দেওয়া হয়।
শ্যামনগর থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখার পাশাপাশি শ্যামনগর সহকারি কমিশনারকে (ভূমি) জমির স্বত্ব ও দখল সংক্রান্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়।
এ ব্যাপারে মুন্সিগঞ্জ ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান পল্টু , ইউপি সদস্য দেবাশীষ গাইন ও আব্দুল জলিল জানান, জহির গাজী নৌবাহিনীর সদস্য হওয়ায় আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের জমি দখল করে রাস্তা নির্মাণের চেষ্টা করছেন। সেনা কর্মকর্তার সিদ্ধান্ত অনুযায়ি তারা পরিষদে বসে যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তাও মানেননি জহির গাজী। দেশের পেক্ষাপট অনুযায়ি সূযোগ বুঝে তিনি বিষ্টু পরমান্যের জমির বেড়া ও গাছগাছালি কেটে রাস্তা বানানোর উদ্যোগ নিয়েছেন। এটা সম্পূর্ণ বেআইনি।
শ্যামনগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোঃ হুমায়ুন কবীর মোল্লা জানান, পুলিশ সুপার ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার নির্দেশে তার নেতৃত্বে পুলিশ বুধবার সকালে ঘটনাস্থলে যেয়ে জহির গাজীর স্ত্রী ও স্বজনদের অবৈধ কাজকর্মে বাধা দেন। শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষায় উভয়পক্ষকে বুধবার বিকেলে থানায় ডাকা হয়েছে। অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট এর আদেশ পেলেই পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
শ্যামনগর সহকারি কমিশনার (ভূমি) রাশেদ হুসাইন জানান, আদালতের আদেশের কপি পেলে যথাযথ তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিল করা হবে।
(আরকে/এসপি/অক্টোবর ০৮, ২০২৫)