বাংলাদেশের রাজনীতি ও আসন্ন নির্বাচন: জটিলতার ভেতরে অনিশ্চিত ভবিষ্যত

আবীর আহাদ
বাংলাদেশের রাজনীতি আজ গভীর অনিশ্চয়তা ও জটিলতার মোড়ে দাঁড়িয়ে। একদিকে আন্তর্জাতিক মহলে পরিচিত তথাকথিত ডক্টর ইউনুস সরকার ঘোষণা দিয়েছে, আগামী ফেব্রুয়ারিতেই অনুষ্ঠিত হবে জাতীয় নির্বাচন; অন্যদিকে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি নির্বাচনের নিরপেক্ষতা, প্রশাসনের নিরপেক্ষতা ও নির্বাচন কমিশনের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে গুরুতর সন্দেহ প্রকাশ করছে বলে তাদের আচার-আচরণে মনে হয়।
আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ ও নেতৃত্বহীন অবস্থায় থাকায় রাজনৈতিক মেরুকরণ আরও তীব্র হয়েছে। তা সত্বেও তাদের প্রবল গণভিত্তি তাদেরকে বড়োধরনের চ্যালেঞ্জের দিকে টেনে নিয়ে যেতে পারে। কারণ বিবোধীমাঠে তারা যোগ্য খেলোয়াড়। অপরদিকে বিএনপি মনে করছে, ইউনুস সরকারের প্রশাসনিক কাঠামো ও নির্বাচন কমিশন তাদের পক্ষে নিরপেক্ষ আচরণ করবে না। ফলে শেষ মুহূর্তে বিএনপির নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার আশঙ্কা প্রবল হয়ে উঠছে।
অন্যদিকে সাধারণ মানুষ, ব্যবসায়ী সমাজ ও আন্তর্জাতিক মহল- সবাই এক প্রশ্নে একমত: সব দলের অংশগ্রহণ ছাড়া নির্বাচন হলে দেশে স্থিতিশীলতা ফিরবে কীভাবে?
সব দলের অংশগ্রহণহীন নির্বাচন কি টিকবে?
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস বলে, প্রধান দলগুলোর অংশগ্রহণ ছাড়া কোনো নির্বাচনই দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতা আনতে পারেনি। ২০১৪ সালের নির্বাচন তার বড় উদাহরণ, বিএনপি অংশ না নেওয়ায় ভোট কার্যত একতরফা হয়, যার ফলে রাজনীতি আরও বিভক্ত হয় এবং পরবর্তী বছরগুলোতে রাজনৈতিক সহিংসতা চরমে ওঠে।
এবার যদি আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধই থাকে এবং বিএনপিও শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে না আসে, তবে দেশীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে “অংশগ্রহণহীন নির্বাচন” নিয়ে তীব্র সমালোচনা আবারও দেখা দিতে পারে।
অন্তর্বর্তী সরকার ও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা
বর্তমান ইউনুস সরকারের বৈধতা ও গ্রহণযোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। এটি মূলত একটি অন্তর্বর্তী (interim) প্রশাসন, যার উদ্দেশ্য ছিল দেশে সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টি করা। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই সরকারের নিরপেক্ষতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে, অনেকে মনে করেন, সরকারটি জামায়াত–এনসিপি ঘেঁষা প্রবণতা দেখাচ্ছে।
সরকার দাবি করছে, তারা “গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে” কাজ করছে; কিন্তু বিরোধীরা বলছে, এটি কেবল একদলকে সরিয়ে অন্য একটি বিশেষ গোষ্ঠীকে ক্ষমতায় আনার কৌশল মাত্র।
রাজনৈতিক এই দ্বন্দ্ব যদি সমঝোতার পথে না আসে, তাহলে দেশ আবারও সহিংসতা ও প্রশাসনিক অচলাবস্থার ঝুঁকিতে পড়তে পারে।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া: যুক্তরাষ্ট্র–ভারত–চীন–রাশিয়া
বাংলাদেশের আসন্ন নির্বাচন এখন দক্ষিণ এশিয়ার কূটনৈতিক প্রতিযোগিতার এক কেন্দ্রবিন্দুতে। চারটি পরাশক্তিই নিজেদের স্বার্থে এখানে ঘুঁটি সাজাচ্ছে----
যুক্তরাষ্ট্র: ওয়াশিংটন শুরু থেকেই অংশগ্রহণমূলক ও অবাধ নির্বাচনের দাবি জানিয়ে আসছে। তারা চায়, বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার পুনঃপ্রতিষ্ঠা ঘটুক ও মানবাধিকার পরিস্থিতি উন্নত হোক। যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগ সরকারের সময় থেকেই সমালোচনামুখর; তাদের অবস্থান এখন বিএনপি জামায়াত ও নাগরিক সমাজের প্রতি তুলনামূলকভাবে নরম। ইউনুস সরকারের প্রতি তাদের কূটনৈতিক সহানুভূতিও স্পষ্ট। ফলে নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক স্বাধীনতা ও সুষ্ঠু প্রতিযোগিতা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের চাপ বাড়বে।
ভারত: দিল্লির মূল অগ্রাধিকার: স্থিতিশীলতা ও সীমান্ত-নিরাপত্তা। ভারতের আশঙ্কা, রাজনৈতিক অস্থিরতা বা নতুন কোনো শক্তির উত্থান যেন সীমান্ত ও ট্রানজিট নীতিতে প্রভাব না ফেলে। তাই ভারত ইউনুস সরকারের সমালোচনায় সরব না হলেও “ব্যালান্সড” অবস্থান নিয়েছে; তারা চায়, নির্বাচনে সব পক্ষ অংশগ্রহণ করুক।
চীন: চীন বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান অর্থনৈতিক অংশীদার এবং বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (BRI)-এর মাধ্যমে গভীরভাবে যুক্ত। তাদের প্রধান লক্ষ্য, অর্থনৈতিক ধারাবাহিকতা বজায় রাখা। তাই চীনের জন্য মূল প্রশ্ন, নির্বাচনের পর যে-ই ক্ষমতায় আসুক, তাদের বিনিয়োগ ও প্রকল্প যেন অক্ষুণ্ণ থাকে।
রাশিয়া: রাশিয়ার অবস্থান সবচেয়ে জটিল। অতীতে তারা আওয়ামী লীগ সরকারের ঘনিষ্ঠ মিত্র ছিল, বিশেষ করে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র ও প্রতিরক্ষা সহযোগিতায়। কিন্তু এখন আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ, আর ইউনুস প্রশাসন কার্যত আওয়ামীবিরোধী। ফলে মস্কো “কৌশলগত নীরবতা” বজায় রেখেছে। তারা প্রকাশ্যে ইউনুস সরকারকে সমর্থন করছে না, বিরোধিতাও করছে না। রাশিয়া আশঙ্কা করছে, বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব বাড়লে দক্ষিণ এশিয়ায় পশ্চিমা বলয়ের প্রভাব স্থায়ী হয়ে পড়বে। তাই তারা সম্ভবত ভারতের সঙ্গে সমন্বিতভাবে “নরম কূটনৈতিক চাপ” বজায় রাখবে।
ভবিষ্যতের চিত্র
সব মিলিয়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ এখন তিনটি পথে বিভক্ত হতে পারে----
১️) সমঝোতার পথ: ডক্টর ইউনুস সরকার সব দলকে আলোচনায় এনে নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি করে।
২️) বয়কটের পথ: বিএনপি বা অন্যান্য দল আস্থা হারিয়ে নির্বাচন বর্জন করে, ফলে নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হয়।
৩️) সংঘাতের পথ: রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা সহিংসতা ও প্রশাসনিক অচলাবস্থায় রূপ নেয়।
শেষকথা
বাংলাদেশ এখন এক সংকটময় সন্ধিক্ষণে, যেখানে ক্ষমতার লড়াই, আন্তর্জাতিক স্বার্থ ও জনগণের প্রত্যাশা একসূত্রে গাঁথা। যদি রাজনৈতিক দলগুলো সমঝোতার পথে না আসে, তবে গণতন্ত্রের পুনরুদ্ধারের স্বপ্ন আবারও অন্ধকারে হারিয়ে যাবে। আর যদি তারা আলোচনার টেবিলে ফিরে আসে, তবে বাংলাদেশ আবারও ফিরে পেতে পারে তার রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও আন্তর্জাতিক মর্যাদা। রাষ্ট্র, রাজনীতি ও জনগণ, এই তিন শক্তির সমন্বয়েই নির্ধারিত হবে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ: গণতন্ত্রের পথে, নাকি সংঘাতের অন্ধগলিতে।
লেখক :মুক্তিযোদ্ধা লেখক ও বিশ্লেষক।