মোঃ ইমদাদুল হক সোহাগ


প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে আমাদের জাতীয় চেতনা এক পুনরাবৃত্ত আশা আর হতাশার খেলার মধ্য দিয়ে তৈরি হয়েছে। আমরা তিস্তার পানি এবং গঙ্গার ন্যায্য হিস্যার প্রতিশ্রুতির দিকে তাকিয়ে থেকেছি, কাগুজে চুক্তিকে আঁকড়ে ধরেছি, আর আমাদের চোখের সামনেই অগণিত নদীর জীবনপ্রবাহ ক্ষীণ হয়ে এসেছে। কিন্তু এই কয়েক দশক পুরোনো আলোচনায় মগ্ন থাকতে গিয়ে আমরা কি হিমালয়ের সুউচ্চ শৃঙ্গ থেকে নেমে আসা বিশাল ছায়াটিকে উপেক্ষা করেছি? এটি এমন এক সংকট যা দ্বিপাক্ষিক বিবাদকে ছাড়িয়ে যায়; এটি একটি বহুমুখী হুমকি যা বাংলাদেশের অস্তিত্বের ভিত্তিকে চ্যালেঞ্জ করার জন্য প্রস্তুত।

পানি নিরাপত্তা নিয়ে আমাদের চিরাচরিত চিন্তাভাবনা পুরোনো হয়ে গেছে। যখন আমরা পুরোনো হিসাব মেলাতে ব্যস্ত, তখন এক ত্রিমুখী হুমকি আমাদের জাতির ভবিষ্যৎকে শ্বাসরুদ্ধ করার জন্য একত্রিত হচ্ছে। প্রথমটি হলো চীনের জল-আধিপত্যের অপ্রতিরোধ্য উচ্চাকাঙ্ক্ষা; দ্বিতীয়টি ভারতের উচ্চাভিলাষী নদী-সংযোগ প্রকল্প; এবং তৃতীয়টি হলো নীরব ঘাতক—জলবায়ু পরিবর্তন—যা হিমালয়ের হিমবাহগুলোকে ক্রমাগত ক্ষয় করে চলেছে। এমন একটি ত্রিমুখী হুমকির মুখে দাঁড়িয়ে কেবল দ্বিপাক্ষিক চুক্তির উপর মনোযোগ দেওয়াটা এমন এক বিলাসিতা, যা বহন করার ক্ষমতা আমাদের আর নেই।

এক সংকট, তিন ফ্রন্ট: এক আসন্ন বিপর্যয়

আমাদের সবুজ ব-দ্বীপের শিরায় গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র এবং মেঘনার মতো নদীগুলো জীবনরক্তের মতো প্রবাহিত হয়। তাদের উৎস—পবিত্র হিমালয়—এখন ভূ-রাজনৈতিক চাল এবং প্রকৃতির নিষ্ঠুর প্রতিশোধের এক মঞ্চে পরিণত হয়েছে।

চীনের কৌশলগত ছায়া: তিব্বত মালভূমি থেকে ব্রহ্মপুত্র (চীনে ইয়ারলুং সাংপো) আমাদের ভূমিতে নেমে আসে। এখানেই চীন তার প্রবাহের উপর নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণের একটি দুর্গ তৈরি করছে। আন্তর্জাতিক রীতিনীতি এবং ভাটির দেশগুলোর প্রতি তার দায়িত্ব উপেক্ষা করে বেইজিং একের পর এক বিশাল বাঁধ নির্মাণ করছে, যা কৌশলগত "জল-নিয়ন্ত্রণের চাবিকাঠি" হিসেবে কাজ করে। এমন একটি পরিস্থিতির কথা ভাবুন, যেখানে গুরুত্বপূর্ণ শুষ্ক মৌসুমে তারা সেই চাবিকাঠি ঘুরিয়ে দেয়। বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ কৃষক হাহাকার করবে, উর্বর খেত ধুলোয় পরিণত হবে এবং আমাদের নদীগুলো শুকিয়ে যাবে। এটি কেবল বিদ্যুৎ উৎপাদন নয়; এটি পানিকে একটি শক্তিশালী অস্ত্রে পরিণত করার ছক, যা একটি সমগ্র অঞ্চলের ভাগ্য নির্ধারণ করতে পারে। আমাদের কি সেই দিনের জন্য অপেক্ষা করা উচিত, যেদিন তারা এই শ্বাসরুদ্ধকর ক্ষমতা প্রয়োগ করবে?

"চীন যদি হিমালয়ের পানি সরবরাহকে অস্ত্রে পরিণত করে, তবে বাংলাদেশের কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি এক ভয়াবহ ভবিষ্যতের মুখোমুখি হবে।"

ভারতের নদীকেন্দ্রিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা: আমাদের আরেক উজানের প্রতিবেশী ভারত তার নিজের পানি সংকট মোকাবেলার জন্য একটি জাতীয় নদী-সংযোগ প্রকল্পের দীর্ঘদিনের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করছে—একটি পরিকল্পনা যা বাংলাদেশের জন্য এক দুঃস্বপ্নে পরিণত হতে পারে। গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র অববাহিকা থেকে যে "উদ্বৃত্ত পানি" তারা সরিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা করছে, তা বাস্তবে আমাদের দক্ষিণাঞ্চলের অপরিহার্য জীবনরেখা। এটি বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবনকে টিকিয়ে রাখে এবং হাজার হাজার উপকূলীয় একর জমিকে লবণাক্ততার আগ্রাসন থেকে রক্ষা করে। এই পানি সরিয়ে নেওয়ার অর্থ হলো আমাদের জাতির কৃষিভিত্তিক হৃদপিণ্ডে লবণাক্ত হতাশা প্রবেশ করানো। লক্ষ লক্ষ কৃষকের ঘাম অসহায় চোখের জলে পরিণত হবে এবং ঘূর্ণিঝড়ের বিরুদ্ধে আমাদের প্রাকৃতিক ঢাল—সুন্দরবন—হয়তো এই পরিবেশগত অভিঘাত সহ্য করতে পারবে না।

প্রকৃতির অনিবার্য প্রতিশোধ: এই মানবসৃষ্ট হুমকির পাশাপাশি, জলবায়ু পরিবর্তন যেন কফিনের শেষ পেরেকটি ঠুকে দিচ্ছে। হিমালয়ের হিমবাহগুলো এমন এক হারে গলছে যা সবচেয়ে উদ্বেগজনক বৈজ্ঞানিক পূর্বাভাসকেও ছাড়িয়ে গেছে। এর পরিণতি এক নির্মম পরিহাস: প্রথমে, হিমবাহ হ্রদের আকস্মিক ভাঙনে সৃষ্ট আকস্মিক এবং বিধ্বংসী বন্যা, এবং তারপরে, পানির মূল উৎসগুলো শুকিয়ে যাওয়ায় দীর্ঘস্থায়ী, পঙ্গু করে দেওয়া খরা। যে নদীগুলো এখন পানিতে টইটম্বুর, সেগুলো হয়তো এক প্রজন্মের মধ্যেই ক্ষীণ ধারায় পরিণত হবে। যখন এই কঠোর বাস্তবতার সাথে উজানের শক্তিগুলোর রাজনৈতিক চাল যুক্ত হয়, তখন পরিস্থিতি শিরদাঁড়া হিম করা এক সংকটের রূপ নেয়।

এক নতুন পথের সন্ধানে: নিষ্ক্রিয়তা থেকে সক্রিয় কূটনীতি

এটা দিনের আলোর মতো স্পষ্ট যে আমাদের বর্তমান কূটনৈতিক কৌশল একটি ভাঙা তরী। নিষ্ক্রিয় পর্যবেক্ষণ এবং প্রতিক্রিয়ামূলক আলোচনার যুগ শেষ হয়েছে। আমাদের এখন এই ত্রিমুখী হুমকি মোকাবেলা করতে হবে—আগ্রাসন দিয়ে নয়, বরং জ্ঞান, সক্রিয় কূটনীতি এবং কৌশলগত দূরদৃষ্টি দিয়ে।

সামনের একমাত্র কার্যকর পথ হলো একটি সমন্বিত “অববাহিকা-ভিত্তিক জল ব্যবস্থাপনা” কাঠামোকে সমর্থন করা। এটি কোনো দিবাস্বপ্ন নয়; এটি সম্মিলিতভাবে টিকে থাকার একমাত্র যৌক্তিক পথ। বাংলাদেশকে হিমালয়ান নদী কমিশন গঠনের প্রস্তাব উত্থাপনে নেতৃত্ব দিতে হবে, যা হবে চীন, ভারত, নেপাল এবং ভুটানকে অন্তর্ভুক্ত করে একটি বহুপাক্ষিক সংস্থা। এই কমিশনের মূল ভিত্তি হতে হবে তথ্য বিনিময়ে সম্পূর্ণ স্বচ্ছতা, সমস্ত উজানের প্রকল্পের সহযোগিতামূলক মূল্যায়ন এবং ন্যায্য জলের অধিকার প্রতিষ্ঠা—যা কোনো অনুগ্রহ হিসেবে নয়, বরং একটি সহ-নদী অববাহিকার দেশ হিসেবে আমাদের অবিচ্ছেদ্য অধিকার।

আলোচনার টেবিলে চীনের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা নিঃসন্দেহে চ্যালেঞ্জিং হবে, তবে এটি অসম্ভব নয়। আমাদের কূটনৈতিক বয়ানকে অনুরোধের স্তর থেকে কৌশলগত যুক্তির স্তরে উন্নীত করতে হবে। আমাদের স্পষ্টভাবে বোঝাতে হবে যে, একটি নদী অববাহিকার দেশের অস্থিতিশীলতা অনিবার্যভাবে অন্য সব দেশকে প্রভাবিত করে। একটি সমৃদ্ধ, স্থিতিশীল এবং পরিবেশগতভাবে সুরক্ষিত বাংলাদেশ কেবল আমাদের প্রয়োজন নয়—এটি সমগ্র অঞ্চলের দীর্ঘমেয়াদী নিরাপত্তা এবং অর্থনৈতিক স্বার্থের জন্য অপরিহার্য। এই বার্তাই আমাদের সবচেয়ে শক্তিশালী কূটনৈতিক অস্ত্র।

"একটি সমৃদ্ধ বাংলাদেশ তার প্রতিবেশীদের জন্য বোঝা নয়; এটি আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার একটি ভিত্তিপ্রস্তর।"

শেষ কথা: আমাদের অস্তিত্ব রক্ষার আহ্বান

আমাদের নদীর প্রবাহ আমাদের সভ্যতার স্পন্দন। সেই স্পন্দন আজ দুর্বল হয়ে পড়ছে। হিমালয়ের জল-রাজনীতি এখন আর কোনো দূরবর্তী পররাষ্ট্রনীতির বিষয় নয়; এটি জাতীয় নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক টিকে থাকা এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের অস্তিত্বের এক জরুরি প্রশ্ন।

এটি কোনো দূরবর্তী, দুঃস্বপ্নের ভবিষ্যতের গল্প নয়। এটি আমাদের সন্তানদের ভবিষ্যতের জন্য আজই লেখা একটি সুস্পষ্ট চিত্রনাট্য। ঢাকার নীতি-নির্ধারক থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত চরের কৃষক পর্যন্ত, প্রত্যেক নাগরিককে এই অস্তিত্বের সংকটের ভয়াবহতা অনুধাবন করতে হবে। আমাদের আজকের নীরবতা মানে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি মৃত্যু পরোয়ানা জারি করা। পানি জীবন, কোনো অস্ত্র নয়। আসুন, আমাদের নদীগুলোকে মরুভূমির প্রতিধ্বনি হতে না দিই।

লেখক: উদ্যোক্তা, কলামিস্ট ও ভূ-রাজনৈতিক বিশ্লেষক।