গুণমানই উন্নয়নের মূল, নিরাপত্তার হাতিয়ার

ডা. মাহতাব হোসাইন মাজেদ
আজ মঙ্গলবার ১৪ অক্টোবর — বিশ্ব মান দিবস। বিশ্বজুড়ে এই দিনটি পালিত হয় সমাজ, প্রযুক্তি, বাণিজ্য ও মানুষের জীবনে মানের গুরুত্ব উপলব্ধি করার জন্য। মান হলো এমন একটি অদৃশ্য কাঠামো, যা আমাদের দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটি অংশে নীরবে কাজ করে—পণ্য, সেবা, স্বাস্থ্য, পরিবেশ থেকে শুরু করে শিক্ষা ও প্রযুক্তি পর্যন্ত। ২০২৫ সালে পালিত হচ্ছে ৫৬তম বিশ্ব মান দিবস। এই দিনটি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়—কোনো সমাজ, প্রতিষ্ঠান বা রাষ্ট্র উন্নত হতে হলে, তাকে মানসম্পন্ন হতে হবে। কারণ মানই উন্নয়নের মাপকাঠি, আস্থার ভিত্তি এবং অগ্রগতির দিকনির্দেশনা।
মান বলতে কী বোঝায়
মান বলতে বোঝায়—কোনো নির্দিষ্ট বিষয়, পণ্য বা প্রক্রিয়ার জন্য এককভাবে নির্ধারিত নিয়ম, মাপ, গুণগত মান বা গ্রহণযোগ্য সীমা। এটি এমন একটি যৌথ ব্যবস্থা, যা মানুষকে সঠিক, নিরাপদ ও সঙ্গতিপূর্ণ পথে কাজ করতে সহায়তা করে।
মানের ধারণা শুধু শিল্পে নয়—আমাদের প্রতিদিনের জীবনের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িয়ে আছে।
যেমন—
* খাবারে স্বাস্থ্যসম্মত উপকরণের পরিমাণ নির্ধারণ * ভবন নির্মাণে নিরাপত্তা ও স্থায়িত্ব নিশ্চিত করা * ওষুধ তৈরিতে সঠিক উপাদান ব্যবহার * বৈদ্যুতিক যন্ত্রে নিরাপদ ভোল্টেজ বজায় রাখা * কিংবা তথ্য প্রযুক্তিতে একক নিয়মে তথ্য আদানপ্রদান করা—সবকিছুতেই মান অপরিহার্য। * মান একটি নীরব ভাষা—যা বিশ্বের বিভিন্ন দেশ, প্রতিষ্ঠান ও মানুষের মধ্যে বোঝাপড়া গড়ে তোলে।
মানের মূল উদ্দেশ্য
১. গুণগত স্থায়িত্ব:- একটি পণ্য বা সেবা প্রতিবার একই গুণমান বজায় রাখে।
২. নিরাপত্তা ও আস্থা:- মানসম্পন্ন জিনিস ব্যবহারকারীর জীবনে আস্থা ও নিশ্চয়তা এনে দেয়।
৩. সহযোগিতা বৃদ্ধি:- বিভিন্ন দেশ বা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সহজ যোগাযোগ ও সমন্বয় সৃষ্টি হয়।
৪. বাণিজ্য ও রপ্তানিতে সহায়তা:- মান বজায় রাখলে পণ্য আন্তর্জাতিক বাজারে সহজে গ্রহণযোগ্য হয়।
৫. উদ্ভাবন ও নতুন প্রযুক্তিতে সহায়তা:-মান একটি নির্দিষ্ট ভিত্তি দেয়, যার ওপর নতুন উদ্ভাবন ও উন্নয়ন গড়ে ওঠে।
বিশ্ব মান দিবসের ইতিহাস
১৯৪৬ সালের ১৪ অক্টোবর ইংল্যান্ডের রাজধানী লন্ডনে ২৫টি দেশের প্রতিনিধি একত্রিত হন আন্তর্জাতিক মান নির্ধারণের প্রয়োজনে। পরের বছর ১৯৪৭ সালে গঠিত হয় আন্তর্জাতিক মান সংস্থা—আন্তর্জাতিক মান সংস্থা (আইএসও)। এরপর থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ একসঙ্গে কাজ করতে থাকে যাতে পণ্য, প্রযুক্তি ও সেবার মান বিশ্বব্যাপী একসাথে সমন্বিত থাকে।
১৯৭০ সালে প্রথমবার ১৪ অক্টোবরকে “বিশ্ব মান দিবস” হিসেবে উদযাপন শুরু হয়। এরপর প্রতি বছর এই দিনটি পালিত হচ্ছে পৃথিবীর প্রায় সব দেশে, মান নির্ধারক, প্রকৌশলী, বিজ্ঞানী ও গবেষকদের অবদানকে সম্মান জানানোর জন্য।
মানের গুরুত্ব
মান আমাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে অমূল্য ভূমিকা রাখে।
১. শিল্প ও বাণিজ্যে:- মান অনুসারে উৎপাদন করলে শিল্পে একরূপতা আসে। গ্রাহক সন্তুষ্ট থাকে, পণ্যের বাজার বাড়ে। একইসঙ্গে আন্তর্জাতিক বাজারেও দেশের পণ্য সহজে স্থান পায়।
২. স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তায়:- ওষুধ, খাদ্য, চিকিৎসা উপকরণ—সব ক্ষেত্রে মান বজায় রাখা রোগের ঝুঁকি ও বিপদের সম্ভাবনা কমায়।
৩. প্রযুক্তিতে:- তথ্য ও যোগাযোগ ব্যবস্থায় মান বজায় রাখলে সব দেশ ও প্রতিষ্ঠান সহজে তথ্য বিনিময় করতে পারে।
৪. পরিবেশ সংরক্ষণে:-পরিবেশবান্ধব উৎপাদন, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, জ্বালানি সাশ্রয়—এসব কিছুই মান নির্দেশিকার মাধ্যমে নিশ্চিত হয়।
৫. শিক্ষায় ও গবেষণায়:- মান নির্ধারণের মাধ্যমে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো দক্ষতা ও গুণগত মান বাড়াতে পারে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট
বাংলাদেশ একটি ক্রমবর্ধমান উন্নয়নশীল দেশ। শিল্প, কৃষি, তথ্যপ্রযুক্তি, স্বাস্থ্যসেবা, নির্মাণ ও রপ্তানির ক্ষেত্রে আমাদের অবস্থান দ্রুত উন্নত হচ্ছে।এই উন্নয়ন ধরে রাখতে হলে মান নিয়ন্ত্রণ সবচেয়ে প্রয়োজনীয় বিষয়।
ইতিবাচক অগ্রগতি
* বাংলাদেশ সরকার ইতোমধ্যে জাতীয় মান সংস্থা (বিএসটিআই)–এর মাধ্যমে বিভিন্ন পণ্যের মান নির্ধারণ করেছে।
* অনেক প্রতিষ্ঠান মাননিয়ন্ত্রিত সার্টিফিকেট গ্রহণ করছে এবং দেশীয় পণ্যের মান উন্নত করছে।
* রপ্তানি খাতে মান বজায় রাখার কারণে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক বিশ্বে আস্থা অর্জন করেছে।
* খাদ্যপণ্য, ওষুধ ও নির্মাণসামগ্রীতে মান নিরীক্ষা আগের চেয়ে অনেক বেশি জোরদার হয়েছে।
চ্যালেঞ্জ
দেশের অনেক ছোট ও মাঝারি প্রতিষ্ঠান এখনো মাননির্ভর উৎপাদনে সক্ষম নয়, ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশ সীমিত থাকে।
পর্যাপ্ত পরীক্ষাগার, আধুনিক যন্ত্রপাতি এবং প্রশিক্ষিত জনবল সবখানে নেই, যা মান যাচাই ও উৎপাদন প্রক্রিয়াকে বাধাপ্রাপ্ত করে।
সাধারণ মানুষের মধ্যে মানের গুরুত্ব ও সচেতনতা এখনও পর্যাপ্ত নয়, ফলে পণ্য ও সেবা মান উন্নয়নে জাগরণ সৃষ্টি করা কঠিন হয়ে পড়ে।
আন্তর্জাতিক মানের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলা অনেক সময় কঠিন হয়ে পড়ে, কারণ প্রযুক্তি, কাঁচামাল ও গুণগত মান বজায় রাখা সহজ নয়।
মাননির্ভর উৎপাদনের জন্য সরকারি নীতি, উদ্যোগ ও সচেতনতা প্রয়োজন, যা না থাকলে উৎপাদন ও রপ্তানিতে সমস্যা তৈরি হয়।
দীর্ঘমেয়াদে এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করা গেলে দেশ উৎপাদন ও অর্থনীতিতে আরও শক্তিশালী হতে পারবে।
ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা ও মাননির্ভরতা
বাংলাদেশের পণ্য ও সেবা আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখলে রপ্তানি বৃদ্ধি পাবে এবং বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহ বাড়বে।
শিল্পখাতে মানসম্মত উৎপাদন বৃদ্ধি পেলে কর্মসংস্থান সৃষ্টির সুযোগ প্রসারিত হবে এবং যুবসমাজের জন্য নতুন চাকরির ক্ষেত্র তৈরি হবে।
মাননির্ভর প্রশাসন দেশের প্রশাসনিক কার্যক্রমকে আরও স্বচ্ছ ও কার্যকর করে তুলবে।
শিক্ষাক্ষেত্রে মাননির্ভরতার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের দক্ষতা ও সৃজনশীলতা বৃদ্ধি পাবে।
স্বাস্থ্য, যোগাযোগ ও অন্যান্য সেবায় মান বজায় রাখলে নাগরিকদের জীবনমান উন্নত হবে।
“স্মার্ট বাংলাদেশ” গড়ার লক্ষ্য অর্জনে মাননির্ভর প্রযুক্তি ও উদ্ভাবন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
দীর্ঘমেয়াদে মাননির্ভরতা দেশের অর্থনীতি, সমাজ ও প্রযুক্তিগত অগ্রগতিকে সমন্বিতভাবে এগিয়ে নেবে।
বিশ্ব মান দিবসের উদ্দেশ্য ও তাৎপর্য
বিশ্ব মান দিবস আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে মান শুধু নিয়ম নয়—এটি উন্নয়ন, নিরাপত্তা ও টেকসই জীবনের ভিত্তি।
এই দিবসের মূল উদ্দেশ্য হলো—
১. সমাজে মান সচেতনতা বৃদ্ধি করা।
২. যারা মান নির্ধারণ ও রক্ষণে কাজ করেন, তাদের অবদান স্বীকৃতি দেওয়া।
৩. শিল্প, শিক্ষা ও প্রশাসনে মানভিত্তিক সংস্কৃতি গড়ে তোলা।
৪. নতুন প্রযুক্তি, পরিবেশ ও স্বাস্থ্যক্ষেত্রে মান প্রয়োগ নিশ্চিত করা।
৫. বিশ্বব্যাপী একক নীতি ও সহযোগিতা গড়ে তোলা।
বর্তমান সময়ের প্রাসঙ্গিকতা
* পরিবেশগত চ্যালেঞ্জ: জলবায়ু পরিবর্তন ও পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তি।
* মানের সরাসরি প্রভাব: নিরাপত্তা, গোপনীয়তা ও মানবকল্যাণ নিশ্চিত করতে।
* রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনায় মান: নীতি ও উন্নয়নের স্থায়িত্ব বাড়ায়।
* শিল্প ও উৎপাদনে মান: বিপণন ও আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় স্থান ধরে রাখে।
* প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনে মান: নতুন প্রযুক্তি নির্ভরযোগ্য ও নিরাপদ হয়।
* মানবকল্যাণ: স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সামাজিক সেবা উন্নত হয়।
* ঝুঁকি কমানো: মানহীনতা বিপদ ও ক্ষতি বৃদ্ধি করে।
* টেকসই উন্নয়ন: মান নিশ্চিত করলে দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য সহজ হয়।
* মান কেবল কারখানার নয়, রাষ্ট্র ও সমাজের মূল ভিত্তি।
বাংলাদেশে করণীয়
১. মানভিত্তিক শিক্ষা চালু করা:- বিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রমে মান বিষয়ে পাঠ অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন।
২. সরকারি নীতিতে মান সংযোজন:- সব সরকারি ক্রয়, প্রকল্প ও কাজের ক্ষেত্রে মান অনুসরণ বাধ্যতামূলক করা উচিত।
৩. পরীক্ষাগার ও গবেষণা কেন্দ্র বাড়ানো:- দেশব্যাপী আধুনিক মান পরীক্ষাগার স্থাপন করে উৎপাদনের গুণমান নিশ্চিত করতে হবে।
৪. উদ্যোক্তা ও শ্রমিক প্রশিক্ষণ:- শিল্পক্ষেত্রে কর্মরতদের মাননির্ভর প্রশিক্ষণ প্রদান করতে হবে।
৫. জনসচেতনতা বৃদ্ধি:- গণমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে মান সচেতনতা প্রচার করতে হবে।
৬. আঞ্চলিক সহযোগিতা:- দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে মান নির্ধারণে অভিজ্ঞতা ও তথ্য বিনিময় করা প্রয়োজন।
মাননির্ভর সমাজ গড়ার উপকারিতা
মাননির্ভর সমাজ গড়ে তোলার মাধ্যমে একটি দেশ তার উন্নয়ন ও অগ্রগতির পথে দৃঢ় পদক্ষেপ নিতে পারে।
* জনগণের আস্থা বৃদ্ধি পায়: মান বজায় থাকলে পণ্য ও সেবার প্রতি মানুষের বিশ্বাস জন্মায়। এতে সমাজে স্বচ্ছতা ও ন্যায্যতার পরিবেশ তৈরি হয়।
* ব্যবসা-বাণিজ্যে প্রতিযোগিতা বাড়ে: মানসম্পন্ন উৎপাদন উদ্যোক্তাদের মধ্যে সুস্থ প্রতিযোগিতা সৃষ্টি করে, যা অর্থনীতিকে গতিশীল করে তোলে।
* আন্তর্জাতিক বাজারে দেশের ভাবমূর্তি উন্নত হয়: মানসম্মত পণ্য ও সেবা রপ্তানি করলে বিশ্ববাজারে দেশের সুনাম ও গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি পায়।
* দুর্ঘটনা, ক্ষতি ও অপচয় কমে যায়: মান বজায় রাখলে উৎপাদন ও ব্যবহার প্রক্রিয়ায় নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়, ফলে দুর্ঘটনা ও ক্ষয়ক্ষতি হ্রাস পায়।
* প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনে গতি আসে: মাননির্ভর চিন্তা গবেষণা ও নতুন উদ্ভাবনের পথ উন্মুক্ত করে, যা আধুনিক সমাজ গঠনে সহায়তা করে।
* টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জনে সহায়ক হয়: মাননির্ভর সমাজ পরিবেশ, অর্থনীতি ও সামাজিক ভারসাম্য বজায় রেখে টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করে।
পরিশেষে বলা যায়, মান হলো আমাদের উন্নয়ন ও অগ্রগতির প্রাণশক্তি। মান ছাড়া কোনো সমাজ, প্রতিষ্ঠান কিংবা রাষ্ট্র স্থায়ী সাফল্যের স্বপ্ন দেখতে পারে না। একটি মানসম্মত জাতি শুধু অর্থনৈতিকভাবে নয়, নৈতিক, সামাজিক ও পরিবেশগত দিক থেকেও সমৃদ্ধ হয়। আজ ১৪ অক্টোবর, ৫৬তম বিশ্ব মান দিবস আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়—প্রত্যেকে যদি নিজের অবস্থান থেকে মান বজায় রাখি, তবে পুরো জাতিই হবে মাননির্ভর, উন্নত ও নিরাপদ। মান শুধু পণ্যে নয়, জীবনের প্রতিটি কাজে, আচরণে ও দায়িত্বে প্রতিফলিত হওয়া উচিত। তাই আসুন, আজকের এই দিনে আমরা এক অঙ্গীকার করি—মানই হোক আমাদের শক্তি, মানই হোক আমাদের গর্ব।
লেখক: সংগঠক ও প্রবন্ধকার, প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি।