ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ


বুধবার ১৫ অক্টোবর ২০২৫।বিশ্ব হাত ধোয়া দিবস। মানব শরীরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সুরক্ষা ব্যবস্থা হলো চামড়া। এটি শুধু আমাদের শরীরকে ঢেকে রাখে না, বরং এক প্রাকৃতিক বাধা হিসেবে জীবাণু, ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস এবং ক্ষতিকারক পরিবেশগত পদার্থ থেকে রক্ষা করে। বিশেষ করে আমাদের হাত প্রতিদিন অসংখ্য পৃষ্ঠ, বস্তু এবং মানুষের সংস্পর্শে আসে। প্রতিনিয়ত এই সংস্পর্শের মাধ্যমে জীবাণু শরীরে প্রবেশ করতে পারে, যা বিভিন্ন রোগের জন্য ঝুঁকি সৃষ্টি করে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) এবং অন্যান্য স্বাস্থ্য সংস্থা বহু গবেষণার মাধ্যমে প্রমাণ করেছে যে, সঠিকভাবে হাত ধোয়া সংক্রমণ প্রতিরোধে সবচেয়ে কার্যকর পদ্ধতি। শিশু, প্রবীণ এবং রোগপ্রবণ ব্যক্তিরা যদি এই অভ্যাস মেনে চলে, তাহলে মৃত্যু এবং অসুস্থতার হার উল্লেখযোগ্যভাবে কমানো সম্ভব।প্রথমবার ২০০৮ সালে সুইডেনে বিশ্ব হাত ধোয়া দিবস পালিত হয়। এরপর এটি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত হয়েছে। দিবসটি পালনের মূল উদ্দেশ্য হলো হাত ধোয়ার গুরুত্ব এবং স্বাস্থ্য সচেতনতা বাড়ানো। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, হাত ধোয়া শুধুমাত্র ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য নয়, সমাজের জন্যও অপরিহার্য।

বিশ্ব হাত ধোয়া দিবস আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, ছোট একটি অভ্যাস—হাত ধোয়া—কত বড় স্বাস্থ্য সুরক্ষা প্রদান করতে পারে। এটি কেবল সংক্রমণ প্রতিরোধেই নয়, বরং স্বাস্থ্যবিধি ও জীবনের মান উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। হাতের পরিচ্ছন্নতা সামাজিক দায়িত্বের প্রতিফলন হিসেবেও বিবেচিত।

হাত ধোয়ার বৈজ্ঞানিক গুরুত্ব

মানব হাতে হাজার হাজার জীবাণু থাকতে পারে। বিশেষ করে হাতের লোমকূপের গোড়ায় প্রায় ৫০ হাজার জীবাণু লুকিয়ে থাকতে পারে, যা খালি চোখে দেখা যায় না। এই জীবাণু খাদ্য, মুখ, নাক ও চোখের মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করলে ডায়রিয়া, নিউমোনিয়া, ইনফ্লুয়েঞ্জা, চোখের সংক্রমণ, অন্ত্রসংক্রমণ, হেপাটাইটিস এ এবং চর্মরোগ সহ বিভিন্ন সংক্রামক রোগ সৃষ্টি করতে পারে।

সঠিকভাবে হাত ধোয়ার মাধ্যমে শিশুদের মৃত্যু হ্রাস করতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখা যায়। ২০২৫ সালের সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী:

* সঠিকভাবে হাত ধোলার অভ্যাস থাকলে ডায়রিয়ার কারণে শিশু মৃত্যু ৪০% কমে যায়।

* নিউমোনিয়া সংক্রমণ থেকে মৃত্যু ৩০% পর্যন্ত হ্রাস পেতে পারে।

* নিয়মিত হাত ধোয়া হাসপাতালে সংক্রমণ (হাসপাতাল-জন্মসংক্রমণ) ২০–৩০% কমাতে সক্ষম।

* অ্যান্টিবায়োটিকের অনাবশ্যক ব্যবহারও কমিয়ে আনে। করোনাভাইরাস পরবর্তী সময়ে দেখা গেছে, নিয়মিত হাত ধোয়া স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার সবচেয়ে কার্যকর উপায়। এছাড়া, ডেঙ্গু, টাইফয়েড, ভাইরাল সংক্রমণ ও খাদ্যবাহিত রোগ থেকেও হাত ধোয়া সুরক্ষা প্রদান করে।

হাত ধোয়ার মাধ্যমে আমরা শুধু সংক্রমণ রোধ করি না, বরং জীবাণু প্রতিরোধ ক্ষমতা শক্তিশালী করি। নিয়মিত হাত ধোয়া শিশু ও প্রবীণদের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে সাহায্য করে, যা দীর্ঘমেয়াদে কমিউনিটি স্বাস্থ্য জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

হাত ধোয়ার সঠিক সময়

হাত ধোয়া তখনই কার্যকর হয় যখন তা সঠিক সময়ে করা হয়। বিশেষজ্ঞরা নিম্নলিখিত সময়গুলোতে হাত ধোয়া অত্যন্ত জরুরি মনে করেন:

১. খাবার খাওয়ার আগে। ২. অসুস্থ কারও যত্ন নেওয়ার আগে ও পরে। ৩. খাবার তৈরি করার আগে ও পরে। ৪. শৌচালয় ব্যবহারের পরে। ৫. শিশুর ডায়পার বদলানোর বা পরিষ্কার করার পর। ৬. দেহের ক্ষত বা কাটাছেঁড়া পরিষ্কার করার আগে ও পরে। ৭. পোষা প্রাণীর খাবার বা দূষিত বস্তু স্পর্শের পরে। ৮. বাহির থেকে ফিরে ঘরে প্রবেশের আগে। ৯. নাক ঝাড়া, কফ ফেলা বা হাঁচি দেওয়ার পরে। ১০. আবর্জনা বা দূষিত বস্তু স্পর্শের পরে। ১১. মোবাইল, কিবোর্ড, রিমোট ইত্যাদি স্পর্শের পরে। ১২. পরিবেশ বা যানবাহনের স্পর্শকৃত অংশে হাত পড়ার পরে।

শিশু, প্রবীণ ও রোগপ্রবণ ব্যক্তির সংস্পর্শের আগে ও পরে হাত ধোয়া আরও গুরুত্বপূর্ণ। বাস্তবে, এ ধরণের সচেতনতা সমাজে সংক্রমণ হ্রাসে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখে।

হাত ধোয়ার সঠিক পদ্ধতি

সঠিকভাবে হাত ধোয়ার জন্য পাঁচটি ধাপ অনুসরণ করা উচিত:

১. পরিষ্কার, প্রবাহমান পানি দিয়ে হাত ভিজিয়ে নিন এবং সাবান লাগান। ২. সাবান দিয়ে আঙুলের ফাঁক, নখের নিচে ভালোভাবে ঘষুন এবং ফেনা তৈরি করুন। ৩. কমপক্ষে ২০ সেকেন্ড হাত ঘষুন। ৪. পরিষ্কার পানি দিয়ে সাবান ধুয়ে নিন। ৫. পরিষ্কার তোয়ালে বা বাতাসে হাত শুকিয়ে নিন।যদি সাবান বা পানি না থাকে, ৬০% অ্যালকোহল-ভিত্তিক হাত জীবাণুনাশক ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে দৃশ্যমান ময়লা থাকলে এটি কার্যকর নাও হতে পারে। শিশুদের জন্য ব্যবহারের সময় তদারকি করা আবশ্যক।গবেষণায় দেখা গেছে, সঠিকভাবে হাত ধোয়া ডায়রিয়া, নিউমোনিয়া এবং সংক্রমণ ২০–৪০% পর্যন্ত কমাতে সাহায্য করে। এটি স্বাস্থ্য সচেতনতা এবং দীর্ঘমেয়াদি সুরক্ষা নিশ্চিত করে।

খাদ্য ও সংক্রমণ সম্পর্কিত সতর্কতা

কাঁচা মাংস, ডিম, সামুদ্রিক খাবার স্পর্শের পরে হাত ধোয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি বিভাগের গবেষণা অনুযায়ী, রান্নার সময় ৯৫% মানুষ হাত ঠিকমতো ধোয় না। ফলে খাদ্যবাহিত রোগের ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়।

সঠিক হাত ধোয়া

* খাদ্যবাহিত সংক্রমণ যেমন স্যালমোনেলা, ইকোলাই কমাতে সাহায্য করে। * শিশুদের মধ্যে ডায়রিয়া এবং অন্ত্রসংক্রমণ রোধে কার্যকর। * নিউমোনিয়া ও শ্বাসনালী সংক্রমণ হ্রাস করে।
* চর্মরোগ ও সংক্রামক চোখের রোগের ঝুঁকি কমায়। রান্নাঘরের পরিচ্ছন্নতা ও স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করা, এবং হাত ধোয়ার নিয়মিত চর্চা স্বাস্থ্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

আন্তর্জাতিক ও জাতীয় উদ্যোগ

বাংলাদেশে ২০০৩ সালে মাত্র ৩৩% মানুষ নিরাপদ পানির উৎস ও স্বাস্থ্যসম্মত স্যানিটেশনের আওতায় ছিল। ২০২৫ সালের হিসাব অনুযায়ী, প্রায় ৯৯% মানুষ নিরাপদ পানি ও স্যানিটেশনের সুবিধা পেয়েছে। একই সাথে, খোলা স্থানে মলত্যাগকারীর হার প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমেছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) এবং শিশু তহবিল সংস্থা (ইউনিসেফ) হাত ধোয়ার গুরুত্ব নিয়ে বিভিন্ন সচেতনতামূলক কর্মসূচি চালাচ্ছে। “জীবন বাঁচান: হাত পরিষ্কার রাখুন” বা “পরিষ্কার হাত, সুস্থ জীবন” মূল স্লোগান। এসব কর্মসূচি স্কুল, হাসপাতাল, কমিউনিটি ও কর্মস্থলে স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধি করছে।

বাংলাদেশ সরকারও বিভিন্ন স্কুল, হাসপাতাল ও কমিউনিটিতে হাত ধোয়ার জন্য সচেতনতা কর্মসূচি পরিচালনা করছে। এতে শিশু ও কমিউনিটি পর্যায়ে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।

শিশু ও ডিজিটাল স্বাস্থ্যবিধি

শিশুদের মধ্যে হাত ধোয়ার অভ্যাস গড়ে তোলা হলো দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্য সুরক্ষার অন্যতম উপায়। শিশুরা যখন ছোটবেলা থেকে সাবান ব্যবহার ও সঠিক পদ্ধতি শিখবে, তখন সংক্রমণ কমবে। স্কুলে স্বাস্থ্য শিক্ষা, পোষ্টার, প্র্যাকটিক্যাল প্রদর্শনী এবং অভিভাবকের তদারকি গুরুত্বপূর্ণ।

* অফিসে কম্পিউটার ও কিবোর্ড ব্যবহারের আগে ও পরে হাত ধোয়া। * মোবাইল ও ট্যাবলেট ব্যবহারের পরে হাত পরিষ্কার করা। * জনসমাগমে ব্যবহার করা যন্ত্রপাতি স্পর্শের পরে সাবান বা জীবাণুনাশক ব্যবহার। * নিয়মিত হাত ধোয়া ডিজিটাল সংক্রমণ রোধে কার্যকর। এটি স্বাস্থ্য সুরক্ষা এবং ডিজিটাল জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে।

স্বাস্থ্য ও স্যানিটেশন উন্নয়ন

হাত ধোয়া শুধুমাত্র সংক্রমণ রোধ নয়, বরং স্বাস্থ্য ও স্যানিটেশন উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ২০৩০ সালের মধ্যে সকলের জন্য নিরাপদ পানি ও স্যানিটেশন নিশ্চিত করা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক লক্ষ্য। * স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা, সাবান ব্যবহার ও সচেতনতা বৃদ্ধি। * কমিউনিটি পর্যায়ে সংক্রমণ হ্রাস এবং শিশু মৃত্যুর হার কমানো। * হাসপাতাল সংক্রমণ হ্রাস এবং অ্যান্টিবায়োটিকের অনাবশ্যক ব্যবহার কমানো। * স্বাস্থ্য শিক্ষা, প্রচারণা ও স্থানীয় উদ্যোগ এই লক্ষ্যে অবদান রাখে।

বিশ্ব হাত ধোয়া দিবসের লক্ষ্য

১. সব বয়সী মানুষকে সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার অভ্যাস গড়ে তোলা।

২. প্রতিটি দেশে হাত ধোয়া বিষয়ক নজরদারি ও প্রচার।

৩. সচেতনতা বৃদ্ধি ও সংক্রমণ প্রতিরোধে অবদান রাখা।

৪. শিশু ও প্রবীণদের স্বাস্থ্য শিক্ষা বৃদ্ধি।

৫. ডিজিটাল স্বাস্থ্যবিধি ও পরিচ্ছন্নতা চর্চা সম্প্রসারণ। বিশ্ব হাত ধোয়া দিবস আমাদের মনে করিয়ে দেয়, হাত ধোয়া কোনো বিচ্ছিন্ন চর্চা নয়। এটি জীবনাচারের অবিচ্ছেদ্য অংশ। প্রতিদিনের ছোট অভ্যাসই সুস্থ জীবন, রোগমুক্ত সমাজ ও স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করে।

পরিশেষে বলা যায়, হাত ধোয়া কেবল ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য রক্ষার জন্যই গুরুত্বপূর্ণ নয়, এটি কমিউনিটি পর্যায়ে রোগ-জীবাণু ছড়ানো প্রতিরোধেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সঠিকভাবে হাত ধোয়ার মাধ্যমে সাধারণ সংক্রমণ যেমন সর্দি-কাশি, ডায়রিয়া এবং ত্বকের বিভিন্ন সমস্যা অনেকাংশে কমানো সম্ভব। বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধি পেয়েছে, বিশেষ করে শহুরে এলাকাগুলোতে, তবে দূরবর্তী গ্রামীণ ও নিম্নবিত্ত এলাকায় এখনও সচেতনতার অভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে।

সুতরাং, শুধুমাত্র ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতার দিকে মনোযোগ দেওয়াই যথেষ্ট নয়; নিরাপদ পানি, স্যানিটেশন এবং নিয়মিত হাত ধোয়ার অভ্যাসকে প্রতিদিনের জীবনের অংশ হিসেবে গ্রহণ করাও জরুরি। স্কুল, পরিবার এবং কমিউনিটি পর্যায়ে শিক্ষামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করে এই অভ্যাসকে আরও সম্প্রসারিত করা সম্ভব। বিশ্ব হাত ধোয়া দিবসের মাধ্যমে এই বার্তা সারা বিশ্বের মানুষদের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়: “পরিষ্কার হাত, সুস্থ জীবন।” আমাদের সবার দায়িত্ব হলো এই সচেতনতা বজায় রাখা এবং ছড়িয়ে দেওয়া, যাতে শুধু নিজেদেরই নয়, সমগ্র সমাজই সুস্থ ও রোগমুক্ত থাকে। স্বাস্থ্য সচেতনতা ও পরিচ্ছন্নতার মাধ্যমে আমরা একটি নিরাপদ, সুস্থ ও স্বচ্ছ বাংলাদেশ গড়ে তুলতে পারি।

লেখক: সংগঠক, কলাম লেখক ও গবেষক, প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি।