মো: ইমদাদুল হক সোহাগ


অর্থনীতির মেরুদণ্ড যখন হুমকির মুখে

বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রাণশক্তি হিসেবে বিবেচিত হয় ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (এসএমই) খাত। দেশের মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি), কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং দারিদ্র্য বিমোচনে এই খাতের অবদান অনস্বীকার্য । জিডিপিতে প্রায় ২৫-৩২ শতাংশ অবদান রাখার পাশাপাশি দেশের শিল্প খাতের প্রায় ৮৫ শতাংশ কর্মসংস্থান এই খাতের মাধ্যমেই তৈরি হয় । এই খাতটি দেশের অর্থনৈতিক কাঠামোর প্রধান স্তম্ভ হিসেবে রাজধানী থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত গ্রাম পর্যন্ত বিস্তৃত, যা কেবল পণ্য উৎপাদনই নয়, গ্রামীণ অর্থনীতিকে সচল রাখতেও ব্যাপক ভূমিকা রাখে ।কিন্তু অর্থনীতির এই মেরুদণ্ড আজ এক বহুমুখী সংকটের মুখোমুখি। তীব্র ডলার সংকট, লাগামহীন মুদ্রাস্ফীতি এবং একটি ভঙ্গুর ব্যাংকিং ব্যবস্থা—এই ত্রিফলা আক্রমণের মুখে এসএমই খাতটি অস্তিত্বের সংকটে পড়েছে। এই সংকট কেবল স্বতন্ত্র উদ্যোক্তার জন্য হুমকি নয়, বরং এটি দেশের সামগ্রিক আর্থ-সামাজিক স্থিতিশীলতার জন্যও একটি অশনিসংকেত।

এই প্রতিবেদনের উদ্দেশ্য দ্বিমুখী। প্রথমত, সামষ্টিক অর্থনীতির এই চ্যালেঞ্জগুলো মাঠপর্যায়ে একজন এসএমই উদ্যোক্তার দৈনন্দিন ব্যবসায়িক কার্যক্রমে কী ধরনের প্রভাব ফেলছে, তার একটি পুঙ্খানুপুঙ্খ এবং বাস্তবভিত্তিক চিত্র তুলে ধরা। দ্বিতীয়ত, এই সংকট থেকে উত্তরণের জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের করণীয় বিষয়ে একটি কাঠামোগত, পর্যায়ক্রমিক এবং কার্যকর সংস্কার পথনকশা উপস্থাপন করা, যা স্থিতিশীলতা পুনরুদ্ধার, এসএমই খাতকে সহায়তা এবং টেকসই পুনরুদ্ধারের ভিত্তি স্থাপন করবে।

সংকটের বহুমাত্রিক রূপ: সামষ্টিক অর্থনীতির চালচিত্র

বাংলাদেশের বর্তমান অর্থনৈতিক সংকট কোনো একক কারণে সৃষ্টি হয়নি, বরং এটি ডলার সংকট, মুদ্রাস্ফীতি এবং ব্যাংকিং খাতের দুর্বলতার মতো একাধিক গভীর এবং পরস্পর-সম্পর্কিত সমস্যার ফল। এই অধ্যায়ে তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে সংকটের মূল চালিকাশক্তিগুলো বিশ্লেষণ করা হয়েছে।

ডলার সংকট ও মুদ্রার অবমূল্যায়ন

দেশের সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতার প্রধান কারণ হলো তীব্র ডলার সংকট, যা কোভিড-পরবর্তী সময়ে এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর থেকে মারাত্মক রূপ ধারণ করেছে। এই সংকটকে বর্তমান নাজুক পরিস্থিতির মূল চালিকাশক্তি হিসেবে চিহ্নিত করেছেন বিশেষজ্ঞরা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পূর্ববর্তী নীতি, যা টাকার মান কৃত্রিমভাবে ধরে রাখার চেষ্টা করেছিল, তা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে।

তথ্য-উপাত্ত অনুযায়ী, ডলারের বিপরীতে টাকার ব্যাপক অবমূল্যায়ন ঘটেছে। আনুষ্ঠানিক বিনিময় হার প্রতি ডলারে ৮৬ টাকা থেকে বেড়ে ১১০ টাকায় দাঁড়িয়েছে, যেখানে খোলা বাজারে এই হার ১২০ টাকাও ছাড়িয়ে গেছে । এর ফলে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ভয়াবহভাবে হ্রাস পেয়েছে। ২০২১ সালের আগস্টে যেখানে রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৪৮ বিলিয়ন ডলার, তা ২০২৪ সালের শুরুতে নিট হিসাবে ১৬ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে আসে, যা অর্ধেকেরও বেশি পতন। এই সংকট দেশের লেনদেন ভারসাম্যে (Balance of Payments) রেকর্ড ঘাটতি তৈরি করেছে। এই পরিস্থিতির পেছনে আমদানি-রপ্তানির ভারসাম্যহীনতা, রেমিট্যান্স প্রবাহে ধীরগতি, বাহ্যিক অর্থনৈতিক ধাক্কা এবং পুঁজি পাচারের মতো বিষয়গুলো কাজ করেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রশাসনিক বা নির্দেশনামূলক মুদ্রানীতি বাজারভিত্তিক সমাধানের পরিবর্তে সংকটকে আরও ঘনীভূত করেছে।

লাগামহীন মুদ্রাস্ফীতি ও জনজীবনে প্রভাব

উচ্চ এবং ধারাবাহিক মুদ্রাস্ফীতি সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা মারাত্মকভাবে হ্রাস করেছে এবং একই সাথে ব্যবসার পরিচালন ব্যয় বাড়িয়েছে। ২০২৫ সালের জুলাই মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল ৮.৫৫%, যা তিন মাস ধরে কমার পর আবার ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা দেখায়। বিশেষ করে খাদ্য মূল্যস্ফীতি সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ওপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করেছে।

উদ্বেগের বিষয় হলো, ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে টানা ৪২ মাস ধরে মজুরি বৃদ্ধির হার মূল্যস্ফীতির হারের পেছনে পড়ে আছে, যার ফলে শ্রমিকদের প্রকৃত আয় ক্রমাগত হ্রাস পাচ্ছে। এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি গ্রহণ করেছে এবং নীতি সুদহার (Policy Rate) বাড়িয়ে ১০% করেছে, যার ফলে ব্যাংক ঋণের সুদহার ৯% থেকে বেড়ে ১১.৮৯% ছাড়িয়ে গেছে। তবে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এই মুদ্রানীতি কেবল চাহিদার দিকটি নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছে, যেখানে মুদ্রাস্ফীতির মূল কারণ সরবরাহ খাতের সমস্যা, যেমন—সরবরাহ শৃঙ্খলে বিঘ্ন, বাজার সিন্ডিকেট এবং দুর্বল বাজার ব্যবস্থাপনা।

ব্যাংকিং খাতের ভঙ্গুর দশা

বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত গভীর সুশাসনের অভাব এবং কাঠামোগত দুর্বলতায় ভুগছে, যা আর্থিক স্থিতিশীলতাকে ক্ষুণ্ণ করছে এবং এসএমই-এর মতো উৎপাদনশীল খাতে ঋণ প্রবাহকে বাধাগ্রস্ত করছে।
এই খাতের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো খেলাপি ঋণের (Non-performing loans - NPLs) বিশাল বোঝা। ২০২৪ সালের তথ্য অনুযায়ী, খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৪.৮০ লক্ষ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের এক-পঞ্চমাংশের বেশি। এই সূচকে বাংলাদেশ এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে খারাপ অবস্থানে রয়েছে। বিপুল পরিমাণ খেলাপি ঋণের কারণে ব্যাংকগুলো অত্যন্ত ঝুঁকি-বিমুখ হয়ে পড়েছে এবং এসএমই খাতে ঋণ বিতরণ উল্লেখযোগ্যভাবে কমিয়ে দিয়েছে। এই সংকট ব্যাংকগুলোর ওপর সাধারণ মানুষের আস্থাও কমিয়ে দিয়েছে, যার ফলে এক পর্যায়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে আমানত উত্তোলনের ওপর সীমা আরোপ করতে হয়েছিল। এই পরিস্থিতির জন্য মূলত রাজনৈতিক প্রভাবযুক্ত গোষ্ঠীর ঋণখেলাপি, পুঁজি পাচার এবং গত এক দশকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বায়ত্তশাসন ক্রমাগত হ্রাস পাওয়াকে দায়ী করা হয়।

সামষ্টিক অর্থনীতির এই তিনটি সংকট বিচ্ছিন্ন নয়, বরং একটি অপরটির সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত হয়ে এক দুষ্টচক্র তৈরি করেছে। ডলার সংকট টাকার অবমূল্যায়ন ঘটাচ্ছে, যা সরাসরি "আমদানিজনিত মুদ্রাস্ফীতি" (imported inflation) তৈরি করছে। এই উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমিয়ে দিচ্ছে, ফলে এসএমই পণ্যের চাহিদা কমছে। মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুদহার বাড়াতে বাধ্য হচ্ছে , যা এসএমই উদ্যোক্তাদের জন্য ঋণের খরচ বাড়িয়ে দিচ্ছে এবং তাদের ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা কমাচ্ছে। এটি খেলাপি ঋণ বাড়ার ঝুঁকি তৈরি করে ব্যাংকিং খাতের সংকটকে আরও ঘনীভূত করছে। সব মিলিয়ে, একটি দুর্বল ব্যাংকিং খাত এসএমইগুলোকে প্রয়োজনীয় চলতি মূলধন দিতে ব্যর্থ হচ্ছে, যা তাদের অস্তিত্বকে হুমকির মুখে ফেলছে।

একইসাথে, তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে প্রশাসনিক বা "নির্দেশভিত্তিক" নীতি, যেমন—ডলারের দাম বেঁধে দেওয়া বা ঋণের সুদহার নির্দিষ্ট করে দেওয়া, সংকট সমাধানে ব্যর্থ হয়েছে এবং পরিস্থিতিকে আরও জটিল করেছে। এটি একটি গভীর প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতার দিকে ইঙ্গিত করে, যা বাজারভিত্তিক সমাধানের পরিবর্তে কাঠামোগত সমস্যায়র সমাধান আরোপের প্রবণতা দেখায়।
বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনৈতিক সূচক: একটি তুলনামূলক চিত্র

সূচক

অর্থবছর ২০২১ (বাস্তব)
অর্থবছর ২০২৫ (বাস্তব/পূর্বাভাস)
পরিবর্তনের দিক

জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার
প্রায় ৭.১%
প্রায় ৩.৯৭%
নিম্নমুখী

গড় ভোক্তা মূল্যস্ফীতি
প্রায় ৫.৫৬%
৮.৫৫% (জুলাই ২০২৫)
ঊর্ধ্বমুখী

বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ (নিট)
৪৮ বিলিয়ন ডলার (আগস্ট ২০২১)
১৬ বিলিয়ন ডলারের কম (প্রারম্ভিক ২০২৪)
তীব্র পতন

টাকা/ডলার বিনিময় হার (আনুষ্ঠানিক)
৮৬ টাকা (আগস্ট ২০২১)
১১৭ টাকা (মে ২০২৪)
অবমূল্যায়ন

বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি
প্রায় ১০.৬৮%
৯.৯০% (নভেম্বর ২০২৩)
লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কম

খেলাপি ঋণের হার (NPL Ratio)
প্রায় ৭.৯%
২০% এর বেশি (২০২৪)
তীব্র বৃদ্ধি

উদ্যোক্তার চোখে সংকট: মাঠপর্যায়ের বাস্তবতাসামষ্টিক অর্থনীতির সংকটগুলো সাধারণ উদ্যোক্তাদের জন্য কীভাবে একটি দৈনন্দিন দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছে, এই অধ্যায়ে তার বাস্তব চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। জাতীয় পর্যায়ের তথ্য-উপাত্ত এবং একজন উদ্যোক্তার অভিজ্ঞতার মধ্যে যে বিস্তর ফারাক, তা এখানে স্পষ্ট করা হয়েছে।

লেখক: উদ্যোক্তা, কলামিস্ট ও ভূ-রাজনৈতিক বিশ্লেষক।