ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ


প্রতি বছর ১৮ অক্টোবর বিশ্বজুড়ে পালিত হয় বিশ্ব মেনোপজ দিবস। এই দিনটির মূল উদ্দেশ্য হলো নারীদের জীবনের একটি প্রাকৃতিক পরিবর্তন— মেনোপজ বা রজঃনিবৃত্তি সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করা। নারীরা যেন বুঝতে পারেন, মেনোপজ কোনো রোগ নয়, বরং জীবনচক্রের একটি স্বাভাবিক অধ্যায়।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) এবং আন্তর্জাতিক মেনোপজ সোসাইটি যৌথভাবে এই দিনটি পালনের উদ্যোগ নেয়। ২০১৪ সাল থেকে অক্টোবর মাসটিকে “বিশ্ব মেনোপজ মাস” হিসেবেও পালন করা হচ্ছে। এর লক্ষ্য হলো নারীরা মেনোপজের প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া, শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তন সম্পর্কে জানুক এবং এটি গ্রহণ করতে পারে ভয় বা বিভ্রান্তি ছাড়াই।

ইতিহাসে দেখা যায়, ১৮০০ সালের ইংল্যান্ডে মেনোপজের উপশমের জন্য নানা প্রাকৃতিক ও রাসায়নিক পদ্ধতি ব্যবহার করা হত। আফিম বা গাঁজার ব্যবহার থেকে শুরু করে, ১৮৯০ সালে ওভেরিন নামক ওষুধের প্রচলন। ১৯৩০ সালের পর মেনোপজকে ঘাটতিজনিত সমস্যা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তবে আধুনিক দিনে, হরমোন রিপ্লেসমেন্ট থেরাপি (HRT) সবচেয়ে প্রচলিত ও কার্যকর সমাধান।

মেনোপজের প্রতি সচেতনতা নারীর স্বাস্থ্য ও মানসিক স্থিতিশীলতার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি শুধু শারীরিক নয়, সামাজিক ও মানসিক জীবনেও প্রভাব ফেলে। বিশ্ব মেনোপজ দিবস নারীদের মনে করিয়ে দেয় যে, মেনোপজ জীবনচক্রের স্বাভাবিক অংশ এবং এটি গ্রহণের মাধ্যমে তারা স্বাভাবিক ও সুস্থ জীবনযাপন করতে পারে।

মাসিক ও মেনোপজের পার্থক্য

অনেকে মাসিক এবং মেনোপজকে একই বিষয় মনে করেন, কিন্তু এরা ভিন্ন।

> মাসিক (রজঃস্রাব) :- * মাসিক হলো নারীর প্রজনন চক্রের একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া, যেখানে জরায়ু থেকে রক্ত ও টিস্যু নির্গত হয় যদি ডিম্বাণু পরিপক্ক না হয় বা গর্ভধারণ না ঘটে।
* সাধারণত ২১–৩৫ দিনের মধ্যে একবার ঘটে, যা স্বাভাবিক ধরা হয়। * এটি নারীর হরমোন (ইস্ট্রোজেন ও প্রজেস্টেরন) দ্বারা নিয়ন্ত্রিত এবং প্রজননক্ষম নারীর স্বাভাবিক শারীরিক প্রক্রিয়ার অংশ।

> মেনোপজ :- * মেনোপজ হলো মাসিকের স্থায়ী বন্ধ। যখন ডিম্বাশয় থেকে ডিম্বাণু নিঃসরণ বন্ধ হয় এবং নারীর প্রজননক্ষমতা শেষ হয়, তখন এটি মেনোপজ। * সাধারণত ৪৫–৫৫ বছর বয়সের মধ্যে আসে, গড় বয়স প্রায় ৫০ বছর। * মেনোপজ শুরু হলে মাসিক বন্ধ হয়ে যায় এবং আর পুনরায় হয় না।

রোগ নির্ণয়

মেনোপজ নির্ণয় মূলত উপসর্গ ও বয়সের ওপর নির্ভর করে। যদি একটানা ১২ মাস মাসিক বন্ধ থাকে, তবে চিকিৎসক এটিকে মেনোপজ বলে ধরেন। অনেক সময় অন্যান্য রোগের কারণে মাসিক অনিয়মিত হতে পারে। তাই নিশ্চিত করতে করা হয়— * রক্তে নারী হরমোনের মাত্রা (ইস্ট্রোজেন, প্রজেস্টেরন) পরিমাপ। * থাইরয়েড বা অন্যান্য হরমোনজনিত সমস্যা পরীক্ষা।* প্রয়োজনে জরায়ু ও ডিম্বাশয়ের স্বাস্থ্য যাচাই।

এছাড়া মেনোপজের আগাম অবস্থাও নির্ণয় করা যেতে পারে, যা পূর্ব মেনোপজকাল হিসেবে পরিচিত। এটি সাধারণত ৪৫ বছরের কাছাকাছি শুরু হয় এবং ডিম্বাশয়ের কার্যক্ষমতা ধীরে ধীরে কমে যাওয়ার প্রক্রিয়া।

কারণ

মেনোপজের প্রধান কারণ হলো বয়সজনিত পরিবর্তন, যখন ডিম্বাশয়ের কার্যক্ষমতা কমে যায়। ডিম্বাশয় থেকে হরমোন নিঃসরণ ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যায়, ফলে শরীরে নানা পরিবর্তন আসে। * অস্ত্রোপচারে ডিম্বাশয় কেটে ফেলা – সার্জারির কারণে হরমোন উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়। * ক্যানসার চিকিৎসার প্রভাবে ডিম্বাশয়ের কোষ ক্ষয় – রশ্মি বা কেমোথেরাপি। * জিনগত প্রভাব – পরিবারে আগেভাগে মেনোপজের ইতিহাস থাকলে একই প্রবণতা দেখা দেয়। * ধূমপান ও মদ্যপান – হরমোনের নিঃসরণে ব্যাঘাত ঘটায়। * অপুষ্টি ও মানসিক চাপ – শরীরের ভারসাম্য নষ্ট করে আগেভাগে মেনোপজ ঘটাতে পারে। * চিরাচরিত জীবনধারা ও অস্বাস্থ্যকর অভ্যাস – যেমন অতিরিক্ত রাতজাগা, মানসিক চাপ, অনিয়মিত খাওয়া-পড়া।মেনোপজের কারণ বোঝার মাধ্যমে নারীরা তাদের জীবনধারা ও স্বাস্থ্য রক্ষা করতে পারে।

লক্ষণ

মেনোপজের সময় শরীর ও মনে নানা পরিবর্তন দেখা দেয়।

শারীরিক লক্ষণ: * মাসিক অনিয়মিত হওয়া বা স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে যাওয়া। * হঠাৎ শরীর গরম লাগা ও ঘাম ঝরা (হট ফ্ল্যাশ)। * রাতে ঘুম ভেঙে যাওয়া বা নিদ্রাহীনতা। * মাথাব্যথা, ক্লান্তি ও ঘুমের সমস্যা। * ত্বক শুষ্ক হওয়া, চুল পাতলা বা পড়া। * ওজন বৃদ্ধি ও মেদ জমা। * যৌন ইচ্ছা কমে যাওয়া, যোনিপথে শুষ্কতা বা জ্বালা। * হাড় দুর্বলতা বা জয়েন্ট ব্যথা।

> মানসিক লক্ষণ: * মনঃসংযোগ কমে যাওয়া। * মেজাজ খিটখিটে বা অস্থিরতা। * উদ্বেগ, হতাশা, হতাশাবোধ বৃদ্ধি। * আত্মবিশ্বাস কমে যাওয়া। * হঠাৎ রাগ, কান্না বা আবেগপ্রবণতা। এই লক্ষণগুলি নারীকে শারীরিক ও মানসিকভাবে অসুবিধা দিতে পারে। তবে সচেতন থাকলে ও জীবনধারার পরিবর্তন আনা হলে এগুলি অনেকাংশে নিয়ন্ত্রণযোগ্য।

জটিলতা

মেনোপজের পর হরমোন কমে গেলে দেখা দিতে পারে— * হাড় দুর্বলতা (অস্টিওপোরোসিস) – ক্যালসিয়ামের অভাবে হাড় ভাঙার ঝুঁকি বৃদ্ধি। * হৃদরোগ ও স্ট্রোকের ঝুঁকি বৃদ্ধি – রক্তে চর্বির মাত্রা বেড়ে যায়, হৃদপিণ্ডের চাপ বৃদ্ধি পায়।* স্মৃতিশক্তি ও মনোযোগে সমস্যা – মানসিক ভারসাম্য নষ্ট হয়, ভুলে যাওয়ার প্রবণতা বাড়ে। * যোনি ও মূত্রনালীর সমস্যা – শুষ্কতা, ব্যথা বা সংক্রমণ হতে পারে।* দীর্ঘমেয়াদি অবসাদ ও মানসিক ভারসাম্যহীনতা – বিষণ্ণতা বা উদ্বেগ দেখা দিতে পারে। সঠিক জীবনধারা, ব্যায়াম ও পুষ্টি গ্রহণের মাধ্যমে এসব জটিলতা অনেকাংশে নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব।

সাবধানতা ও প্রতিকার

> খাদ্যাভ্যাস:- * দুধ, ছোট মাছ, ডিম, বাদাম, শাকসবজি ও ফল। * অতিরিক্ত চিনি, তেল ও লবণ এড়িয়ে চলা। * পানি পর্যাপ্ত পরিমাণে পান করা। * ধূমপান ও মদ্যপান পরিহার করা।

> শরীরচর্চা:- * প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিট হাঁটা বা হালকা ব্যায়াম। * যোগব্যায়াম, মেডিটেশন মানসিক শান্তি দেয়।

> মানসিক যত্ন: * বই পড়া, সৃজনশীল কাজে যুক্ত থাকা। * বন্ধু ও পরিবারের সঙ্গে খোলাখুলি আলোচনা। * মানসিক চাপ কমাতে মেডিটেশন বা প্রার্থনা।

> স্বাস্থ্য পরীক্ষা:- * বছরে একবার রক্তচাপ, রক্তে চর্বি, হাড়ের ঘনত্ব ও রক্তের চিনি পরীক্ষা।
* প্রস্রাব বা যোনি সমস্যা থাকলে চিকিৎসকের পরামর্শ।

> জীবনধারার পরিবর্তন: * পর্যাপ্ত ঘুম ও বিশ্রাম নেওয়া। * রোদে হাঁটলে ভিটামিন “ডি” তৈরি হয়, যা হাড়ের জন্য উপকারী। * নিজের জন্য সময় রাখা ও মানসিক শান্তি বজায় রাখা। * নেশা, অতিরিক্ত রাতজাগা ও অস্বাস্থ্যকর অভ্যাস পরিহার।

হোমিও প্রতিকার

মেনোপজ হলো এমন একটি প্রাকৃতিক জীবনপর্ব যখন মহিলার ঋতুস্রাব বন্ধ হয় এবং হরমোনের পরিবর্তনের কারণে শরীরে বিভিন্ন শারীরিক ও মানসিক লক্ষণ দেখা দেয়। হোমিওপ্যাথিতে মেনোপজের লক্ষণ অনুযায়ী ব্যক্তিগতকৃত ওষুধ দেওয়া হয়। সাধারণত ব্যবহৃত কিছু ওষুধ হলো: ল্যাইকেসিস – যদি গরমের ঢাপ ও ঘামের সমস্যা বেশি হয়, বিশেষ করে রাতে। মানসিকভাবে উদ্বিগ্ন বা চরম আবেগপ্রবণ হলে কার্যকর।সেপিয়া_ হরমোনের পরিবর্তনের কারণে মানসিক চাপ, অপ্রিয় অনুভূতি, ঘুমের সমস্যা ও ওজন বৃদ্ধি থাকলে।

সাইলেসিয়া – হাড় দুর্বল, হাড়জোড়ের ব্যথা ও দুর্বলত্ব থাকলে।. কালক্যারিয়া কার্বনিকা – ওজন বৃদ্ধি, ঠাণ্ডা লাগা, ক্লান্তি এবং হাড়ের দুর্বলতায় কার্যকর।. পালসেটিলা _আবেগপ্রবণতা, মন খারাপ, ঘুমের সমস্যা ও গরমের ঢাপ থাকলে।প্রতিটি ওষুধ ডোজ ও আকারের ভিত্তিতে চিকিৎসকের পরামর্শে নেওয়া উচিত। আর মেনোপজ একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া হলেও হরমোনের পরিবর্তনের কারণে অসুবিধা দেখা দিতে পারে।তাই হোমিওপ্যাথি ওষুধের মাধ্যমে ব্যক্তিগত লক্ষণ অনুযায়ী শারীরিক ও মানসিক স্বস্তি পাওয়া সম্ভব। চিকিৎসকের পরামর্শে ও জীবনধারার পরিবর্তনের মাধ্যমে মেনোপজের প্রভাব অনেকটাই কমানো যায়।

পরামর্শ

* মেনোপজের সময় নারীদের জন্য সমাজের সমর্থন ও পরিবারিক বোঝাপড়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পরিবার ও বন্ধুদের সমর্থন নারীর মানসিক চাপ কমাতে সাহায্য করে। অফিস বা কর্মক্ষেত্রেও মেনোপজজনিত সমস্যার জন্য সমন্বয় প্রয়োজন। হট ফ্ল্যাশ বা ঘুমের সমস্যা থাকলে, সহকর্মীদের জানালে সহানুভূতিশীল পরিবেশ তৈরি হয়।

* নারীদের উচিত নিয়মিত স্বাস্থ্যবিমা করা, যাতে হঠাৎ কোনো জটিলতা ঘটলে আর্থিক ও চিকিৎসাগত সহায়তা পাওয়া যায়। স্বাস্থ্যবিমা হাড়ের ভাঙা, হৃদরোগ বা দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসার ক্ষেত্রে নিরাপত্তা দেয়।

* মানসিক সুস্থতার জন্য ধ্যান, প্রার্থনা, সঙ্গীত শোনা ও হালকা সৃজনশীল কাজ অত্যন্ত কার্যকর। এছাড়া পোষ্য প্রাণী বা উদ্যানের সঙ্গে সময় কাটানোও স্ট্রেস কমায়।

* পুষ্টি ক্ষেত্রে, ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন D সমৃদ্ধ খাবার গ্রহণ গুরুত্বপূর্ণ। দুধ, পনির, বাদাম, ডিম এবং সূর্যের আলো হাড়কে শক্ত রাখে। চা-কফি ও প্রসেসড খাবারের অতিরিক্ত ব্যবহার কমানো উচিত।

*হালকা ব্যায়ামের পাশাপাশি হাড় ও জয়েন্ট সুস্থ রাখার জন্য ভার-সহনকারী ব্যায়াম করা জরুরি। হাঁটা, লাফানো বা হালকা ওজন তোলা হাড়কে মজবুত করে।

* নারীরা মেনোপজকে নতুন শিক্ষার সময় হিসেবেও নিতে পারেন। নিজের অভিজ্ঞতা, প্রজ্ঞা ও স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধি করে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করা সম্ভব। এটি পরিবার ও সমাজের জন্যও শিক্ষামূলক হতে পারে।

পরিশেষে, মেনোপজ কোনো সমাপ্তি নয়, বরং নারীর জীবনের নতুন সূচনা। এটি জীবনচক্রের একটি স্বাভাবিক অংশ, যা শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তনের মাধ্যমে নারীর অভিজ্ঞতা ও প্রজ্ঞাকে আরও সমৃদ্ধ করে। সচেতনতা, সঠিক খাদ্যাভ্যাস, নিয়মিত ব্যায়াম এবং মানসিক দৃঢ়তা মেনোপজের এই সময়কে স্বাস্থ্যকর ও সুখময় করে তোলে।

মেনোপজ কোনো ভয় নয়; এটি নারীর জীবনের আরেকটি সুন্দর অধ্যায়। চলুন নারীরা সবাই প্রতিজ্ঞা করি—নিজেকে ভালোবাসা, স্বাস্থ্যকর জীবনধারা অনুসরণ এবং মানসিক দৃঢ়তার মাধ্যমে এই নতুন অধ্যায়কে উদযাপন করব।

লেখক: কলাম লেখক ও গবেষক, প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি।