বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সংকট: পর্ব- ০১
অর্থায়নের চতুর্মুখী সংকট

মো: ইমদাদুল হক সোহাগ
এসএমই খাতের জন্য অর্থায়ন বা ঋণ প্রাপ্তি এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। দেশের মাত্র ২৮-৩০% এসএমই আনুষ্ঠানিক ঋণ সুবিধার আওতায় আসতে পারে, যার ফলে এই খাতে প্রায় ২.৮ বিলিয়ন ডলারের একটি বিশাল অর্থায়ন ঘাটতি (financing gap) তৈরি হয়েছে। এই সংকট চারটি প্রধান দিক থেকে উদ্যোক্তাদের আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলেছে:
সাধ্যাতীত সুদহার: ঋণের সুদহারের ওপর থেকে ৯% সীমা তুলে দেওয়ার পর এসএমই ঋণের সুদহার ১৪-১৫% পর্যন্ত পৌঁছেছে। স্বল্প লাভের ব্যবসায়ীদের জন্য এই উচ্চ সুদহার একটি বিশাল বোঝা, যা তাদের টিকে থাকাকেই অসম্ভব করে তুলেছে।
কঠোর জামানত ব্যবস্থা: ব্যাংকগুলো ঋণের বিপরীতে উচ্চমূল্যের জামানত দাবি করে, যা ঋণের পরিমাণের চেয়েও বেশি হতে পারে। অধিকাংশ ক্ষুদ্র উদ্যোক্তার পক্ষেই এই ধরনের জামানত দেওয়া সম্ভব হয় না, যা ঋণ প্রাপ্তির ক্ষেত্রে প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
জটিল ও সময়সাপেক্ষ প্রক্রিয়া: ব্যাংক থেকে ঋণ পাওয়ার আবেদন প্রক্রিয়া অত্যন্ত দীর্ঘ (বড় প্রতিষ্ঠানের জন্য ১৫-২০ দিনের বিপরীতে এসএমই-এর জন্য ৪৫-৬০ দিন), জটিল এবং আমলাতান্ত্রিক। প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সংগ্রহ এবং প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে গিয়ে অনেক উদ্যোক্তা, বিশেষ করে স্বল্প শিক্ষিতরা, মাঝপথেই হাল ছেড়ে দেন।
ব্যাংকের অনাগ্রহ: খেলাপি ঋণের ভারে জর্জরিত ব্যাংকগুলো এসএমই খাতকে একটি "উচ্চ-ঝুঁকিপূর্ণ" খাত হিসেবে দেখে এবং ঋণ দিতে অনাগ্রহ প্রকাশ করে। ফলে বড় ব্যবসায়ীরা সহজে ঋণ পেলেও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা উপেক্ষিত হন।
ক্রমবর্ধমান পরিচালন ব্যয় ও সংকুচিত মুনাফা
ডলার সংকট এবং মুদ্রাস্ফীতি সরাসরি ব্যবসার পরিচালন ব্যয় বাড়িয়ে দিয়েছে, যা উদ্যোক্তাদের মুনাফাকে সংকুচিত করে ফেলেছে।
আমদানিকৃত কাঁচামাল: টাকার অবমূল্যায়নের কারণে আমদানিকৃত কাঁচামালের দাম বহুগুণে বেড়েছে। অনেক আমদানিকারক ডলার সংকটের কারণে ঋণপত্র (LC) খুলতে পারছেন না, যা বাজারে কাঁচামালের সংকট তৈরি করছে এবং দাম আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে।
জ্বালানি ও বিদ্যুৎ: জ্বালানি খাতের অদক্ষ ব্যবস্থাপনা এবং কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে দেওয়া ভর্তুকির কারণে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দাম বেড়েছে। এর পাশাপাশি অপর্যাপ্ত বিদ্যুৎ ও গ্যাস সরবরাহ উৎপাদনকে মারাত্মকভাবে ব্যাহত করছে পরিবহন খরচ: জ্বালানির দাম বাড়ার সাথে সাথে কাঁচামাল ও উৎপাদিত পণ্য পরিবহনের খরচও বেড়েছে, যা সরাসরি পণ্যের উৎপাদন খরচের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে।
সংকুচিত বাজার ও বিক্রয় হ্রাস
একদিকে যেমন উৎপাদন খরচ বাড়ছে, অন্যদিকে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যাওয়ায় বাজার সংকুচিত হচ্ছে। এই দ্বিমুখী চাপ এসএমই খাতকে খাদের কিনারে ঠেলে দিয়েছে।
ভোক্তার ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস: লাগাতার উচ্চ মুদ্রাস্ফীতির কারণে সাধারণ মানুষের প্রকৃত আয় কমে গেছে। ফলে তারা নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাইরে অন্যান্য কেনাকাটা কমিয়ে দিয়েছে, যার সরাসরি প্রভাব পড়েছে এসএমই খাতের বিক্রির ওপর পণ্যের দাম বাড়াতে না পারা: বড় কোম্পানিগুলোর মতো এসএমই উদ্যোক্তারা তাদের বর্ধিত উৎপাদন খরচ সহজে ভোক্তার ওপর চাপাতে পারে না। দাম বাড়ালে ক্রেতা হারানোর ঝুঁকি থাকে, ফলে তাদের হয় লোকসানে পণ্য বিক্রি করতে হয়, নয়তো মুনাফা বিসর্জন দিতে হয়।
ব্যবসা বন্ধ ও কর্মী ছাঁটাই: উচ্চ পরিচালন ব্যয় এবং কম বিক্রির কারণে অনেক এসএমই প্রতিষ্ঠান তাদের কার্যক্রম বন্ধ করে দিতে বা কর্মী ছাঁটাই করতে বাধ্য হচ্ছে।
আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও নীতিমালার ফাঁক
মাঝে মাঝে সরকারের ভালো উদ্যোগও ভুল নকশা এবং আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে উদ্যোক্তাদের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়ায়।
এসএমই রেমিট্যান্স সুবিধা: বাংলাদেশ ব্যাংক এসএমইদের জন্য বছরে ৩,০০০ ডলার পর্যন্ত বিদেশে পাঠানোর একটি সুবিধা চালু করে। কিন্তু এর জন্য এসএমই ফাউন্ডেশন থেকে নিবন্ধনের একটি অতিরিক্ত শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়। যেখানে উদ্যোক্তাদের ট্রেড লাইসেন্স এবং টিআইএন সার্টিফিকেট রয়েছে, সেখানে এই নতুন নিবন্ধন কেবল সময় ও খরচই বাড়ায় না, অনেককে এই সুবিধা নেওয়া থেকে নিরুৎসাহিতও করে।
প্রণোদনা প্যাকেজের ব্যর্থতা: কোভিড-১৯ মহামারির সময়ে ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজ সম্পর্কে ৭৬% উদ্যোক্তাই অবগত ছিলেন না। যারা জানতেন, তাদের অনেকেই জটিল আবেদন প্রক্রিয়া এবং পরিশোধের শর্ত নিয়ে দ্বিধায় থাকায় এর সুফল নিতে পারেননি। এটি প্রমাণ করে যে নীতিনির্ধারক এবং মাঠপর্যায়ের উদ্যোক্তাদের মধ্যে একটি বড় যোগাযোগ এবং বাস্তবায়নের ঘাটতি রয়েছে।
দুর্নীতি: ঋণ প্রাপ্তি থেকে শুরু করে বিভিন্ন নিয়ন্ত্রক সংস্থার ছাড়পত্র পেতে দুর্নীতি একটি বড় বাধা হিসেবে কাজ করে, যা ব্যবসার খরচ বাড়িয়ে দেয়।
এই খাতের মূল সমস্যা হলো এটি একটি "মিসিং মিডল" বা মধ্যবর্তী ফাঁদে আটকা পড়েছে। এসএমইগুলো মাইক্রোক্রেডিট পাওয়ার জন্য বেশি বড়, কিন্তু বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কাছে ঋণ পাওয়ার জন্য যথেষ্ট ছোট এবং জামানতবিহীন। ব্যাংকগুলো তাদের উচ্চ-ঝুঁকিপূর্ণ মনে করে, বিশেষ করে যখন খেলাপি ঋণের হার বেশি থাকে। ফলে তারা বড় কর্পোরেট ক্লায়েন্টদের দিকেই বেশি মনোযোগ দেয়। এই কাঠামোগত ঘাটতির কারণেই ২.৮ বিলিয়ন ডলারের অর্থায়ন সংকট তৈরি হয়েছে। বর্তমান সংকট এই ঘাটতিকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে।
একইভাবে, এসএমই-এর জন্য নেওয়া নীতিগুলোর ক্ষেত্রে একটি विरोधाभास দেখা যায়। যে নীতিগুলো তাদের সাহায্য করার জন্য তৈরি, সেগুলোই প্রায়শই দুর্বল নকশা এবং আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে তাদের ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। যেমন, রেমিট্যান্স সুবিধার উদ্দেশ্য ছিল বৈদেশিক লেনদেন সহজ করা, কিন্তু অতিরিক্ত নিবন্ধনের শর্ত এটিকে আরও জটিল করে তুলেছে । এটি ইঙ্গিত দেয় যে নীতিনির্ধারকরা হয়তো উদ্যোক্তাদের বাস্তব সমস্যা থেকে বিচ্ছিন্ন এবং উপর থেকে নিয়ন্ত্রণের মানসিকতা নিয়ে নীতি প্রণয়ন করেন।
এসএমই উদ্যোক্তাদের প্রধান চ্যালেঞ্জসমূহ
সামষ্টিক অর্থনৈতিক চালক
উদ্যোক্তার উপর প্রত্যক্ষ প্রভাব
ব্যবসায়িক পরিণতি
তথ্যসূত্র
ডলার সংকট
আমদানিকৃত কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধি
মুনাফা হ্রাস এবং উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি
টাকার অবমূল্যায়ন (৮৬ থেকে ১১০+)
উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি
ভোক্তার ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস
পণ্যের চাহিদা ও বিক্রি কমে যাওয়া
অনেক এসএমই-এর বিক্রি কমেছে
ব্যাংকিং খাতে উচ্চ খেলাপি ঋণ
ব্যাংকগুলোর ঋণ প্রদানে অনাগ্রহ ও কঠোরতা
চলতি মূলধন ও সম্প্রসারণের জন্য অর্থায়নের অভাব
২০২৫ সালের প্রথম প্রান্তিকে ঋণ বিতরণ কমেছে
সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি
ঋণের সুদহার বৃদ্ধি (১৪-১৫%)
ঋণের বোঝা বৃদ্ধি এবং নতুন বিনিয়োগে অনাগ্রহ
সুদহার ৯% থেকে বৃদ্ধি
আমলাতান্ত্রিক জটিলতা
অপ্রয়োজনীয় নিবন্ধন ও দীর্ঘ প্রক্রিয়া
সময় ও অর্থের অপচয়, সরকারি সুবিধা থেকে বঞ্চনা
এসএমই রেমিট্যান্স সুবিধার শর্ত
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আশু করণীয়: স্থিতিশীলতা ফেরানোর কৌশল (সময়সীমা: ০-৩ মাস)
অর্থনৈতিক পতন রোধ করতে এবং একটি ন্যূনতম স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে জরুরি ভিত্তিতে কিছু উচ্চ-প্রভাবসম্পন্ন পদক্ষেপ নিতে হবে। এই অধ্যায়ে সেই আশু করণীয়গুলো তুলে ধরা হলো।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের জন্য ত্রি-স্তরীয় সংস্কার প্রস্তাবনা
নীতি খাত
আশু করণীয় (০-৩ মাস)
স্বল্পমেয়াদী সংস্কার (৩-১২ মাস)
ভিত্তি স্থাপন (১-২ বছর)
মুদ্রানীতি
বাজারভিত্তিক বিনিময় হার প্রতিষ্ঠা করা
এসএমই-এর জন্য বিশেষ ঋণ প্রকল্প চালু করা
বাংলাদেশ ব্যাংকের পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত করা
রাজস্ব নীতি
অপ্রয়োজনীয় সরকারি ব্যয় হ্রাস
এসএমই-বান্ধব কর কাঠামো প্রণয়ন
রাজস্ব বোর্ডকে নীতি ও প্রশাসন—দুই ভাগে বিভক্ত করা
এসএমই সহায়তা
সরবরাহ ব্যবস্থা সিন্ডিকেটমুক্ত করা
কার্যকর প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়ন
নতুন জাতীয় এসএমই নীতিমালা ২০২৫ প্রণয়ন
বাণিজ্য সুবিধা
জরুরি আমদানির জন্য ডলার তহবিল গঠন
আমদানি-রপ্তানি প্রক্রিয়া ডিজিটালাইজ করা
ন্যাশনাল সিঙ্গেল উইন্ডো (NSW) পূর্ণ বাস্তবায়ন
ব্যাংকিং খাত
খেলাপি ঋণ আদায়ে টাস্কফোর্স গঠন
ব্যাংক মার্জার ও অধিগ্রহণ আইন কার্যকর করা
শক্তিশালী ব্যাংক রেজোলিউশন ফ্রেমওয়ার্ক প্রতিষ্ঠা
অবকাঠামো
বন্দর কার্যক্রম সচল রাখা
পতেঙ্গা ও বে টার্মিনালের কাজ দ্রুত করা
মাতারবাড়ী ও পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দরের কাজ সম্পন্ন করা
মুদ্রা বাজার স্থিতিশীল করা
বৈদেশিক মুদ্রার বাজার স্থিতিশীল করা সরকারের প্রথম এবং প্রধান অগ্রাধিকার হওয়া উচিত, কারণ এটি আমদানিজনিত মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ এবং ব্যবসায়িক কার্যক্রমে পূর্বাভাসযোগ্যতা ফিরিয়ে আনার জন্য অপরিহার্য।
বাজারভিত্তিক বিনিময় হার: অবিলম্বে ডলারের বিনিময় হারের ওপর থেকে সব ধরনের প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ তুলে নিয়ে এটিকে বাজারের ওপর ছেড়ে দিতে হবে। ক্রলিং পেগ পদ্ধতিকে একটি অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থা হিসেবে বিবেচনা করে সম্পূর্ণ ভাসমান মুদ্রার হারের দিকে যেতে হবে। এটি ডলারের তারল্য ফিরিয়ে আনার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভূমিকা শক্তিশালীকরণ: বাংলাদেশ ব্যাংককে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপমুক্ত থেকে স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দিতে হবে। সুদের হার করিডোর (IRC) এবং খোলা বাজার কার্যক্রমের (OMO) মতো মুদ্রানীতির সরঞ্জাম ব্যবহার করে তারল্য ব্যবস্থাপনা এবং মুদ্রানীতির সঠিক সংকেত প্রদান নিশ্চিত করতে হবে।
ডলারের চাহিদা ব্যবস্থাপনা: বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ক্ষয় করে এমন অপ্রয়োজনীয় সরকারি আমদানি প্রকল্প সাময়িকভাবে স্থগিত করতে হবে। জ্বালানির মতো জরুরি সরকারি আমদানির জন্য একটি পৃথক তহবিল গঠন করা যেতে পারে, যাতে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ওপর চাপ কমে।
ডলার সরবরাহ বৃদ্ধি: অবৈধ হুন্ডি নেটওয়ার্কের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে এবং বৈধ পথে রেমিট্যান্স পাঠানোকে উৎসাহিত করতে হবে।
লেখক: উদ্যোক্তা কলামিস্ট ও ভূ-রাজনৈতিক বিশ্লেষক।