রঘুনাথ খাঁ, সাতক্ষীরা : শালিসি বৈঠকের সিদ্ধান্ত না মেনে বন্দোবস্ত দলিলের জমি উদ্ধারের নামে অন্যের ডিসিআরকৃত ৫০ শতক জমি ও পুকুর নেট দিয়ে ঘিরে ফেলা হয়েছে। লুটপাট করা হয়েছে ওই পুকুরের মাছ। পুলিশ আসছে এমন খবর পেয়ে আত্মগোপনে যাওয়া লুটপাটকারিরা দীলিপ গাইনের বসতবাাড়ি ও রান্ন ঘরে আগুন দিয়েছে। শুক্রবার রাত সাড়ে ৭টা ও শুক্রবার দিবাগত রাত দেড়টার দিকে দুই দফায় সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার মীরগাং হরিনগর গ্রামে এসব ঘটনা ঘটে।

মীরগাং গ্রামের সুবোধ চন্দ্র গাইনের ছেলে দীলিপ কুমার গাইন জানান, ১৯৬২ সাল থেকে ১৯৬৫ সালের মধ্যে পাঁচটি দলিল মূলে তারা পাঁচ ভাই ও বাবা তাদের মামা কালিপদ ম-লের কাছ থেকে ৪৮ বিঘা জমি কেনেন। মামার ১৪০ বিঘা জমির মধ্যে ১৪ বিঘা জমি ভূলবশতঃ ‘ক’ তপশীলে চলে যায়।ওই জমির মধ্যে কিছুটা মান্দার নদীর বেড়িবাঁধের ভিতরে ও কিছুটা মীরগাং বিলে ও এক একর ৭৮ শতক জমি তাদের কেনা জমির সামনে বনবিবি মন্দিরের সামনে থেকে নিতাই মণ্ডলের বাড়ির সামনে। ‘ক তপশীলভুক্ত’ হওয়ার আগে থেকেই তিনি, সুবাল মণ্ডলের স্ত্রী লক্ষী রানী মণ্ডলসহ ১৮টি পরিবার ওই জমিতে বসতঘর, রান্না ঘর, গোয়ালঘর বানিয়ে বসবাস করাসহ গাছগাছালি লাগিয়ে ও ফসল ফলিয়ে শান্তিপূর্ণ ভোগ দখলে রয়েছেন।

ওই জমির মধ্যে এক একর দেবেন্দ্রনাথ ভাংগীর স্ত্রী পঁচি ভাংগী ও মিজানুর রহমান ও তার স্ত্রী ফাতেমা খাতুন ৬০ শতক জমি যথাক্রমে ১৯৯৩ ও ১৯৯৪ সালে সংশ্লিষ্ট চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত নিয়েছেন মর্মে তারা সম্প্রতি জানতে পারেন। এমনকি লক্ষীরানী ম-লের বাবা বিহারী মণ্ডলের সমাধি ভেঙে গুড়িয়ে দিয়ে জমির সীমানা বেড়া ভেঙে ২০১১ সালে ১৯ শতাংশ জমি জবরদখল করেন ফাতেমা ও মিজানুর রহমান। ভাঙচুরেও জবরদখলে বাধা দেওয়ায় তিনি (দীলিপ) সহ ভাই তপন গাইন, কমলেশ গাইন ও তুষারকে পিটিয়ে ও কুপিয়ে জখম করা হয়।অন্যদের শ্যামনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করালেও তাকে খুলনা ২৫০ শয্যা হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। ফাতেমা ও মিজান জমি নিয়ে আর কোনদিন ঝামেলা করবে না এমন প্রতিশ্রতি দেওয়ায় মামলা করেননি তারা। ছয় মাস আগে ওই জমির বন্দোবস্ত বাতিল করে তাদেরকে বন্দোবস্ত দেওয়ার জন্য আবেদন করেন তারা।

এ নিয়ে বিরোধ তৈরি হওয়ায় ২০২৩ সালের শেষের দিকে তৎকালিন মুন্সিগঞ্জ ইউপি চেয়ারম্যান অসীম কুমার মৃধার নির্দেশে ৭ নং ইউপি সদস্য আনোয়ার হোসেন ও ৮ নং ইউপি সদস্য আব্দুল জলিল এক শালিসি সভায় তপন গাইনের রেকডীয় ২০ শতক জমিসহ ঘরবাড়ি ছেড়ে দিলে পঁচি ভাংগী, তার ছেলে জঙ্গল ভাঙ্গী ও পোতা সাগর ভাংগীকে ৪০ শতক খাস জমি ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু তারা রেকডীয় জমি ছেড়ে না দিয়ে আরো ৪০ শতক জমি দখলের চেষ্টা করে। এজন্য তারা ভাড়াটিয়া সন্ত্রাসীর দ্বারস্ত হয়।

দীলিপ গাইন আরো জানান, পচি ভাংগী ও ফাতেমা তথ্য গোপন রেখে বন্দোবস্ত দলিল করে নিলেও শ্যামনগর সহকারি কমিশনার (ভূমি) এর অফিস থেকে কোন দিনও জমি মেপে বুঝিয়ে দিতে আসেনি। গত ১২ মার্চ ফাতেমার এক অভিযোগের ভিত্তিতে সার্ভেয়র অমল কুমার ঘোষ তাকেসহ ১১ জনকে নোটিশ করেন। ২৩ মার্চ তারা সহকারি কমিশনারের অফিসে হাজির হয়ে ওই জমিতে বসবাস করা ও ভোগদখল করার বিষয়টি তুলে ধরেন। ইউনিয়ন ভূমি কর্মকর্তা ও সার্ভেয়র সরেজমিনে ওই জমি তদন্তে এসে ঘটনার সত্যতা পান এবং অবৈধ বন্দোবন্ত দলিল গ্রহীতাদের দলিল বাতিল করে তাদের নামে দলিল দেওয়ার আবেদন অনুযায়ি কার্যক্রম চালানোর আবেদন করেন তারা। এর নিয়ে মাপ জরিপ করা হলে পঁচি ভাঙ্গীর জমি পূর্ব পশ্চিমে লম্বা বেড়িবাঁধের নীচে পাঁচ ফুট করে লম্বা জায়গা চিহ্নিত করেন সার্ভেয়র অমল কুমার ঘোষ।

এরপরও ফাতেমা, মিজানুর রহমান কৌশলে পচি ভাঙ্গীর পরিবারের সদস্যদের হাতে নিয়ে তাদের সীমানা প্রাচীর ও বাড়ি ঘর ভাঙচুর করে জবরদখলের হুমকি দিয়ে আসছিলেন। এ নিয়ে তারা আতঙ্কে ছিলেন। একপর্যায়ে চলতি বছরের ১৬ জুলাই তাদের দখলীয় সরকারি এক একর ৭০ শতক খাস জমি তুষার গাইন, পশাশ গাইন, বন্দনা গাইন, ধীরেন মণ্ডল, সুকুমার মণ্ডল, হরিশ্চন্দ্র মণ্ডল, লক্ষীরাণী মণ্ডলের নামে ডিসিআর দেওয়া হয়। এরপরও সম্প্রতি পচী ভাংগী, তার ছেলে জঙ্গল ভাংগী ও সাগর ভাংগীর পক্ষ নিয়ে ইউনিয়ন ভূমি কর্মকর্তা সঞ্জয় কুমার রায় তাদের ডিসিআরকৃত জমিতে লাল পাতা ওড়ালে উত্তেজনা চরম আকার ধারণ করে।

মীরগাং গ্রামের মাখন লাল গাইনের ছেলে হরিশ্চন্দ্র গাইন বলেন, তার দাদা কালিপদ মণ্ডলের জমি ভুলবশতঃ ১৪ বিঘা খাস হয়ে গেলে তারা আইনি প্রক্রিয়ায় জমির রেকর্ড সংশোধনের চেষ্টা করে যাচ্ছেন। তা ছাড়া ওই জমির মধ্যে এক একর ৭৮ শতক তার পিসতুত ভাইদের ভোগদখলে কোন আপত্তি না থাকায় দীলিপ ও তার ভাইসহ ১৮টি পরিবার সেখানে বসবাস করে।বন্দোবস্ত পেলে দীলিপ গাইন ও তাদের শরিকরা পাবেন। এ নিয়ে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হতে পারে এমন আশঙ্কায় তিনি গত ৪ জুন কালিগঞ্জ সেনা ক্যাম্প, সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক ও সাতক্ষীরা পুলিশ সুপারের কাছে লিখিত অভিযোগ করেন।

দীলিপ কুমার গাইন আরো বলেন, পঁচি ভাংগীর ছেলে জঙ্গল ও পোতা সাগর পূর্বের শালিস না মেনে জমি জবরদখল করার চেষ্টা করলে সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান আবুল কাশেম মোড়ল ও ইউপি সদস্য আনারুল ইসলাম উভয়পক্ষকে নিয়ে শুক্রবার বিকেল ৫টায় এক শালিসি বৈঠকে বসেন। বৈঠকে ২০২৩ সালের শেষের দিকের, শালিসি সিদ্ধান্তকে বৈধতা দেওয়া হয়। এ সিদ্ধান্ত না মেনে শুক্রবার রাত সাড়ে সাতটার দিকে জঙ্গল ভাংগী ও সাগর ভাংগীর নেতৃত্বে ১৫/২০ জন ভাড়াটিয়া সন্ত্রাসী তার পুকুরসহ ৫০ শতক জমি নেট দিয়ে ঘিরতে থাকে। লুট করা হয় পুকুরের মাছ। বিষয়টি সাবেক চেয়ারম্যান ৯৯৯ এ ফোন করে পুলিশকে অবহিত করেন। বিষয়টি ভুল হয়ে গেছে মর্মে স্বীকার করে জঙ্গল ভাংগী ও তার লোকজন আত্মগোপনে চলে যায়। শুক্রবার দিবাগত রাত দেড়টার দিকে তার বসতঘর ও রান্না ঘরে আগুন দিয়ে চলে যাওয়ার সময় তারা জঙ্গল ভাংগী, সাগর ভাংগী, গোপাল মণ্ডল, নিত্যানন্দ মণ্ডলসহ কয়েকজনকে চলে যেতে দেখেন। আগুন নেভানোর আগেই তার ঘরের ৪০ হাজারের বেশি টাকার ব্যবহৃত সরঞ্জাম পুড়ে যায়। খবর পেয়ে শনিবার ভোরে পুলিশ আসে। পুলিশ চলে যাওয়ার পর তারা নতুন করে দখলে যাওয়ার পরিকল্পনা করছে।

পঁচি ভাংগীর ছেলে জঙ্গল ভাংগী বলেন, তিনি বিরোধ চান না। তাদের পরিবারের দুইজন সুন্দরবনে মাছ ধরতে যেয়ে বাঘর আক্রমণে মারা গেছেন। তাদের পরিবার ও নিজেদের সুবিধার্থে দীলিপ গাইন তাদের রেকডীয় ১২ কাঠা জমি তাদেরকে বিনিময় সূত্রে দিয়েছেন। আর কিছু দিলে তাদের সঙ্গে বিরোধ মীমাংসা হয়ে যাবে।

শ্যামনগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হুমায়ুন কবীর মোল্লা জানান, তিনি ছুটিতে রয়েছেন। পুলিশ ঘটনাস্থল পরিদর্শণ করেছে। এ ঘটনায় মামলার প্রস্তুতি চলছে।

(আরকে/এসপি/অক্টোবর ১৮, ২০২৫)