নড়াইল সদর হাসপাতাল ভরসার জায়গা এখন ভোগান্তির কেন্দ্র

রূপক মুখার্জি, নড়াইল : নড়াইল জেলা সদর হাসপাতালে চলছে চরম চিকিৎসক সংকট। জরাজীর্ণ অবকাঠামো, চিকিৎসা সরঞ্জামের অভাব। এক কথায়, খুড়িয়ে খুড়িয়ে চলছে জেলার সদর হাসপাতাল। প্রায় আট লাখ মানুষের ভরসার এই ১০০ শয্যার হাসপাতাল এখন যেন ভোগান্তির অন্যতম স্থান।
হাসপাতালের বারান্দা, সিঁড়ি, এমনকি মেঝেতেও উপচে পড়া রোগীর ভিড়। বহির্বিভাগে লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে রোগীরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করছেন চিকিৎসকের দেখা পাওয়ার জন্য। জরুরি বিভাগে কান্না, চিৎকার আর আর্তনাদের মধ্যে চলছে চিকিৎসাসেবা। ওয়ার্ডে জায়গা না পেয়ে অনেক রোগীকে রাখা হচ্ছে বারান্দায় বা মেঝেতে।
হাসপাতাল সূত্র জানায়, অনুমোদিত ৩৯টি চিকিৎসক পদের বিপরীতে বর্তমানে কর্মরত আছেন মাত্র ১৬ জন। সার্জারি, মেডিসিন, কার্ডিওলজি, চক্ষু, নাক-কান-গলা, চর্ম, যৌনরোগ, রেডিওলজি—প্রায় সব গুরুত্বপূর্ণ বিভাগের সিনিয়র কনসালটেন্ট পদ শূন্য। এমনকি প্যাথলজিস্ট ও রেডিওলজিস্টের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদেও বছরের পর বছর ধরে কেউ নেই।
হাসপাতালের অপারেশন থিয়েটারে গাইনী বিভাগের ওটি টেবিল দুটি অচল। ডায়াথার্মি, অ্যানেসথেসিয়া মেশিন, এমনকি ওটি লাইট পর্যন্ত নষ্ট হয়ে আছে। অটোক্লেভ মেশিন বিকল থাকায় জীবাণুমুক্ত সরঞ্জাম ব্যবস্থাও প্রশ্নবিদ্ধ। বাধ্য হয়ে জেনারেল ওটি থেকে ধার করা লাইট দিয়ে কাজ চালাতে হচ্ছে।
দুইটি আলট্রাসনোগ্রাম মেশিন বহু বছর ধরে অকেজো, ফলে রোগীদের বেসরকারি ডায়াগনস্টিক সেন্টারেই নির্ভর করতে হচ্ছে—যার খরচ অনেকের জন্যই অতিরিক্ত বোঝা।
সদর উপজেলার হবখালী গ্রামের ৬৫ বছর বয়সী রাবেয়া খাতুন বলেন, “সকাল থেকে লাইনে বসে আছি, এখনও ডাক্তার পাইনি। এত ভিড় যে মেঝেতে বসে থাকতে হচ্ছে, নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয়।”
কালিয়া থেকে আসা রুবেল মিয়া বলেন, “ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষার পরও চিকিৎসক দেখা যায় না। বলা হয়—ডাক্তার রাউন্ডে আছেন। সব মিলিয়ে হয়রানি ছাড়া কিছুই পাচ্ছি না।”
আরেক রোগী সিমা খাতুন অভিযোগ করে বলেন, “বাথরুমে ঢুকলেই বমি আসে। দুর্গন্ধ আর নোংরা পানির কারণে আরও অসুস্থ হয়ে পড়ি।”
ভাদুলিডাঙ্গার বাসিন্দা সুজন বিশ্বাস বলেন, “আমার মাকে বারান্দায় রেখে চিকিৎসা করাতে হচ্ছে। রাতে মশার কামড় আর দুর্গন্ধে ঘুমানোর উপায় নেই।”
দিনমজুর জাহিদুল ইসলাম বলেন, “সরকারি হাসপাতালে আসি খরচ কম হবে ভেবে, কিন্তু অর্ধেকের বেশি ওষুধই বাইরে থেকে কিনতে হয়।”
হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. আব্দুল গফ্ফার বলেন, “অর্ধেকেরও বেশি চিকিৎসক পদ শূন্য থাকায় বিশাল রোগীর চাপ সামলানো কঠিন হয়ে পড়েছে। তারপরও আমাদের চিকিৎসক ও কর্মীরা সীমিত সম্পদে সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছেন।”
স্থানীয় সমাজসেবক আল-আমিন বলেন, নড়াইল সদর হাসপাতালের এ করুণ অবস্থার পেছনে বছরের পর বছর ধরে অবহেলা ও উদাসীনতাই দায়ী। দ্রুত চিকিৎসক নিয়োগ ও সরঞ্জামের ব্যবস্থা না করলে মানুষের ভোগান্তি আরও বাড়বে।
জেলা সদর হাসপাতালের চিকিৎসা সেবা নিয়ে কথা হয় বেসরকারি টিভি চ্যানেল২৪ এর নড়াইল প্রতিনিধি সাইফুল ইসলাম তুহিনের সাথে। তিনি বলেন, স্বাস্থ্য সেবা একেবারেই ভেঙ্গে পড়েছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতা ছাড়া এ সমস্যা থেকে উত্তরণের পথ নেই। তিনি এ বিষয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের স্বাস্থ্য উপদেষ্টার আশু সহযোগিতা কামনা করেছেন।
(আরএম/এএস/অক্টোবর ১৯, ২০২৫)