মানিক লাল ঘোষ


সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় উৎসবগুলোর একটি দুর্গাপূজার অবসানের সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হয় আরেক শক্তিরূপিণী দেবীর আরাধনার প্রস্তুতি। তিনি মা কালী—শক্তি, সংহতি ও কল্যাণের প্রতীক। আর এই কালীপূজাকে কেন্দ্র করেই শুরু হয় আলোর উৎসব দীপাবলি বা দেওয়ালি। কার্তিক মাসের কৃষ্ণপক্ষের অমাবস্যা তিথিতে অনুষ্ঠিত হয় এই শ্যামাপূজা ও দীপাবলি, যা শুভ শক্তির বিজয়, অশুভের বিনাশ এবং আলোকের প্রতিষ্ঠার এক অনন্য উৎসব।

‘দীপাবলি’ শব্দের অর্থ—আলোর সারি। ঘরে ঘরে প্রদীপ জ্বেলে, মোমবাতি ও আলোকসজ্জায় আনন্দের উচ্ছ্বাসে ভরে ওঠে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের জীবন। এই উৎসবের মূল বার্তাই হলো—আলো দিয়ে অন্ধকারকে প্রতিহত করা, কল্যাণ দিয়ে অশুভকে পরাজিত করা।

পুরাণ মতে, এই দিনেই রামচন্দ্র রাবণ বধ করে অযোধ্যায় প্রত্যাবর্তন করেছিলেন, আর সেই আনন্দে প্রজারা প্রদীপ জ্বালিয়ে তাকে বরণ করে নেয়। সেই ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় আজও দীপাবলির সন্ধ্যায় প্রদীপ জ্বালানো হয় ঘরে ঘরে। কেউ তেলের দিয়া, কেউ বা মোমবাতিতে সাজিয়ে তোলে নিজের বাসভবন। দুঃখ-অশান্তি দূর করে শান্তি ও সমৃদ্ধির কামনায় মন্দিরে মন্দিরে গাইতে থাকে আলোর বন্দনা।

বাংলাদেশে এই উৎসব এখন শুধু ধর্মীয় নয়, একটি সার্বজনীন সামাজিক উৎসব। সকল শ্রেণির মানুষের অংশগ্রহণে এটি হয়ে উঠেছে সম্প্রীতি ও সাম্যের প্রতীক। বিশেষত রাজধানীর ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দির, রমনা কালীমন্দির, রামকৃষ্ণ মিশন, পোস্তাগোলা মহাশ্মশানসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তের কালীমন্দির ও শ্মশানঘাটে দীপাবলি ও শ্যামাপূজা আয়োজন হয় হৃদয়ের সবটুকু শ্রদ্ধা নিয়ে।

এছাড়া বাঙালি হিন্দুদের মধ্যে “শ্মশান দীপাবলি”-র এক অনন্য চল রয়েছে। পূর্বপুরুষের আত্মার শান্তির জন্য প্রদীপ প্রজ্বালন, সমাধিস্থলে প্রার্থনা—এই উৎসবকে দেয় অতুলনীয় মানসিক ও আধ্যাত্মিক গভীরতা।

তবে এবারের দীপাবলি কিছুটা ভিন্ন প্রেক্ষাপটে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর সহিংসতার যে ঢেউ দেখা দিয়েছে, তা ভয়ের পাশাপাশি শঙ্কাও সৃষ্টি করেছে। এই প্রেক্ষিতে, দীপাবলির প্রদীপ যেন হয়ে ওঠে ভবিষ্যতের শান্তি ও নিরাপত্তার আলোকবর্তিকা। সকল অশুভ শক্তির বিনাশ ও বাংলাদেশকে একটি আলোকিত, সাম্যের রাষ্ট্রে পরিণত করার প্রার্থনায় দীপাবলিতে মুখর হবে এদেশের সনাতন ধর্মাবলম্বীরা।

দীপাবলি শুধু আলোর উৎসব নয়, এটি আশার প্রতীক। শক্তির আরাধনায়, শান্তির প্রার্থনায়, মানবিকতার আলো জ্বালিয়ে সমাজ থেকে হিংসা, ঘৃণা ও বৈষম্য দূর হোক—এই হোক আমাদের দীপাবলির প্রতিজ্ঞা।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট।