বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সংকট: শেষ পর্ব
ব্যাংকিং খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা

মো: ইমদাদুল হক সোহাগ
একটি সুস্থ অর্থনীতি বিনির্মাণের পূর্বশর্ত হলো একটি সুস্থ ব্যাংকিং খাত। খেলাপি ঋণ এবং দুর্বল সুশাসনের বর্তমান সংকট অবশ্যই সফলতার সাথে মোকাবিলা করতে হবে।
ব্যাংক রেজোলিউশন ফ্রেমওয়ার্ক বাস্তবায়ন: প্রস্তাবিত "ব্যাংক পুনর্গঠন অধ্যাদেশ" (Bank Restructuring Ordinance) আইন হিসেবে পাস করে বাংলাদেশ ব্যাংককে দুর্বল ব্যাংকগুলোতে হস্তক্ষেপ, একত্রীকরণ এবং আমানতকারীদের সুরক্ষা দেওয়ার জন্য সুস্পষ্ট আইনি ক্ষমতা প্রদান করতে হবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বায়ত্তশাসন শক্তিশালীকরণ: বাংলাদেশ ব্যাংক অর্ডার সংশোধন করে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকে এর প্রধান কাজ হিসেবে নির্ধারণ করতে হবে এবং রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ থেকে এর কার্যক্রমে স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে।
খেলাপি ঋণ আদায়ে কঠোর পদক্ষেপ: "দুরূহ সম্পদ ব্যবস্থাপনা অধ্যাদেশ" (DAMO) বাস্তবায়ন করে একটি বিশেষায়িত টাস্কফোর্স গঠন করতে হবে, যা আইনি ফাঁকফোকর বন্ধ করে বড় ও ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের থেকে ঋণ আদায়ে কাজ করবে।
স্বচ্ছতা বৃদ্ধি: ব্যাংকের মালিক এবং বড় ঋণগ্রহীতাদের চূড়ান্ত সুবিধাভোগী মালিকানার (ultimate beneficial ownership) তথ্য প্রকাশ বাধ্যতামূলক করতে হবে, যাতে স্বার্থের সংঘাতপূর্ণ ঋণ প্রদান বন্ধ হয়।
বাণিজ্য ব্যয় হ্রাসে অবকাঠামোগত উন্নয়ন
অদক্ষ বন্দর ও লজিস্টিকস ব্যবস্থা দেশের বাণিজ্যের জন্য একটি বড় প্রতিবন্ধকতা, যা খরচ বাড়ায় এবং রপ্তানি প্রতিযোগিতায় বাধা সৃষ্টি করে।
বন্দর আধুনিকীকরণ: চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতা বাড়াতে বে টার্মিনাল এবং পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনালের নির্মাণকাজ দ্রুত সম্পন্ন করতে হবে। ডিপি ওয়ার্ল্ড (DP World) বা পিএসএ (PSA)-এর মতো বিশ্বমানের আন্তর্জাতিক অপারেটরদের যুক্ত করে বন্দরের দক্ষতা বাড়াতে হবে এবং আধুনিক প্রযুক্তি চালু করতে হবে।
গভীর সমুদ্রবন্দর প্রকল্প সম্পন্নকরণ: মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর (২০৩০ সালের মধ্যে চালু) এবং পায়রা বন্দরের (২০২৬ সালের মধ্যে চালু) নির্মাণকাজ সময়মতো শেষ করতে হবে। এটি বড় জাহাজগুলোকে সরাসরি বাংলাদেশে আসতে সাহায্য করবে, সিঙ্গাপুর বা কলম্বোর মতো আঞ্চলিক ট্রান্সশিপমেন্ট হাবের ওপর নির্ভরতা কমাবে এবং সরবরাহ শৃঙ্খলকে সংক্ষিপ্ত করবে।
সমন্বিত লজিস্টিকস উন্নয়ন: বন্দরগুলোর সাথে সড়ক ও রেল যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন করতে হবে, যাতে কারখানা থেকে বন্দরে এবং বন্দর থেকে কারখানায় পণ্য পরিবহন দ্রুত ও নির্বিঘ্ন হয়।
নতুন জাতীয় এসএমই নীতিমালা প্রণয়ন
২০১৯ সালের এসএমই নীতিমালার মেয়াদ শেষ হওয়ায় ২০৩০ সালকে লক্ষ্য করে একটি নতুন ও ভবিষ্যৎ-মুখী নীতিমালা প্রণয়ন করা প্রয়োজন।
উচ্চাভিলাষী লক্ষ্য নির্ধারণ: নতুন "এসএমই নীতিমালা ২০২৫"-এর লক্ষ্য হওয়া উচিত ২০৩০ সালের মধ্যে জিডিপিতে এসএমই খাতের অবদান বর্তমান প্রায় ২৮% থেকে বাড়িয়ে ৩৫% করা।
কৌশলগত লক্ষ্যে মনোযোগ: এই নীতিমালায় আর্থিক অন্তর্ভুক্তিকরণ, ডিজিটাল রূপান্তর ও চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের জন্য প্রস্তুতি, নারী উদ্যোক্তা উন্নয়ন এবং অনানুষ্ঠানিক খাতের আনুষ্ঠানিকীকরণের মতো কৌশলগত লক্ষ্যগুলোকে প্রাধান্য দিতে হবে।
প্রাতিষ্ঠানিক সমন্বয়: এসএমই ফাউন্ডেশন, বিসিক, বাংলাদেশ ব্যাংক, বিডা এবং অন্যান্য সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর মধ্যে কার্যকর সমন্বয়ের একটি সুস্পষ্ট কাঠামো তৈরি করতে হবে, যাতে বিচ্ছিন্ন ও অকার্যকর সহায়তা কার্যক্রম পরিহার করা যায়।
তথ্যভিত্তিক নীতি প্রণয়ন: এসএমই খাত সম্পর্কিত বিস্তারিত ও নিয়মিত তথ্য সংগ্রহ এবং প্রকাশের ব্যবস্থা করতে হবে, যা প্রমাণ-ভিত্তিক নীতি প্রণয়নে সহায়তা করবে এবং অগ্রগতির মূল্যায়ন সহজ করবে।
দীর্ঘমেয়াদী সংস্কারের ক্ষেত্রে ভৌত অবকাঠামো (যেমন বন্দর, রাস্তা) এবং প্রাতিষ্ঠানিক অবকাঠামো (যেমন ব্যাংকিং আইন, এসএমই নীতি) একে অপরের ওপর নির্ভরশীল। একটি বিশ্বমানের গভীর সমুদ্রবন্দর তখনই পুরোপুরি কার্যকর হবে, যখন এর সহযোগী প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা—যেমন বাণিজ্য অর্থায়নকারী ব্যাংকিং খাত, দ্রুত পণ্য ছাড়করণকারী কাস্টমস এবং রপ্তানিকারকদের সহায়তাকারী এসএমই নীতি—শক্তিশালী হবে। তাই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে এই দুই ধরনের সংস্কার সমান্তরালভাবে এগিয়ে নিতে হবে।
সংকট থেকে সম্ভাবনায় উত্তরণ
বাংলাদেশের বর্তমান অর্থনৈতিক সংকট নিঃসন্দেহে গভীর এবং বহুমুখী। তবে এই সংকট অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের জন্য একটি ঐতিহাসিক সুযোগও তৈরি করেছে—দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে থাকা কাঠামোগত সংস্কারগুলো বাস্তবায়ন করার। এই প্রতিবেদনের মূল বার্তা হলো, এসএমই উদ্যোক্তাদের প্রয়োজনকে পুনরুদ্ধারের ট্রেন্ডিং কেন্দ্রবিন্দুতে রাখা কেবল একটি খাতকে সমর্থন করা নয়, বরং এটি সমগ্র জাতীয় অর্থনীতিকে পুনরুজ্জীবিত করার সবচেয়ে কার্যকর পথ।
বাংলাদেশের উদ্যোক্তারা বারবার তাদের উদ্ভাবনী শক্তি এবং ঘুরে দাঁড়ানোর ক্ষমতার প্রমাণ দিয়েছেন। সরকারের সাহসী, সময়োপযোগী এবং কার্যকর নীতি সহায়তা পেলে এই উদ্যোক্তা শক্তিই বাংলাদেশকে বর্তমান সংকট থেকে বের করে এনে একটি টেকসই ও অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধির পথে চালিত করতে পারে। সঠিক সংস্কারের মাধ্যমে এই সংকটকে সম্ভাবনায় রূপান্তর করা সম্ভব।
লেখক : উদ্যোক্তা কলামিস্ট ও ভূ-রাজনৈতিক বিশ্লেষক।