সামাজিক অসঙ্গতির বিরুদ্ধে দিনরাত কথা বলছে ‘বিবর্তন যশোর’

স্বাধীন মুহাম্মদ আব্দুল্লাহ, যশোর : যশোর শহরের ব্যস্ততম এলাকা কেশবলাল সড়ক। এই এলাকাকে সাধারণত সঙ্গীত পাড়া বলা হয়। আদ্ দ্বীন শিশু হাসপাতালের বিপরীত পাশে ছোট্ট একটি গলি। এই গলি দিয়ে প্রবেশ করলেই চোখে পড়ে সুন্দর একটি উন্মুক্ত মঞ্চ। মঞ্চের পাশে রয়েছে ছোট বড় কয়েকটি কক্ষ। গাছের ছায়ায় কোলাহলমুক্ত একটা পরিবেশ। এখানে প্রবেশ করতেই দেখা যায় বিভিন্ন বয়সের কিছু মানুষ মঞ্চে বসে আড্ডা দিচ্ছেন। কখনও কখনও দেখা যায় নাটকের মহড়া চলছে। আবার উৎসব-পার্বণে বিভিন্ন রং-বেরং এর পোস্টার, ব্যানার, উপকরণ তৈরির ধুম পড়ে এখানে। বলছিলাম বিবর্তন যশোরের প্রধান কার্যালয়ের কথা।
বহুকাল আগে থেকেই যশোর শিল্প, সাহিত্য, ইতিহাস ও ঐতিহ্য সমৃদ্ধ একটি জনপদ। এই জনপদের মানুষ তাদের মনের শৈল্পিক তৃষ্ণা মেটাতে, অন্যায় অবিচার, সামাজিক অনাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও প্রতিকার করতে বেছে নিয়েছেন কবিতা, গান, নাটকসহ সংস্কৃতি চর্চার বিভিন্ন মাধ্যম।
তদ্রূপভাবেই যান্ত্রিক শহরের কোলাহল ভুলে সংস্কৃতি চর্চায় ‘সামাজিক অসঙ্গতির বিরুদ্ধে নাটক’ প্রতিপাদ্য স্লোগান নিয়ে ১৯৮৯ সালের ১২ই অক্টোবর আত্মপ্রকাশ করে ‘বিবর্তন যশোর’ নামে একটি সংগঠন। সাড়ে ৭ শতক জমি সরকারের কাছ থেকে লিজ নিয়ে সংগঠনটি দীর্ঘ ৩৫ বছর তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। দীর্ঘ এই পথ চলার শুরুটা হয়েছিলো সামাজিক সকল অসঙ্গতির বিরুদ্ধে নাটকের ভাষায় প্রতিবাদ করার জন্য। মূলত একটি বাম রাজনৈতিক দলের চিন্তা-চেতনার প্রতিফলন ঘটাতেই বিবর্তনের জন্ম। তৎকালীন স্বৈরশাসকের সামরিক জান্তা যখন এদেশের স্বাধীনচেতা, সংস্কৃতিমনা মানুষের ওপর নির্যাতন শুরু করে তখন যশোরের একদল প্রগতিশীল মানুষ একত্রিত হয়ে বিবর্তন যশোর নামের সংগঠনটি দাঁড় করায়।
বর্তমানে বিবর্তন যশোরের সদস্য সংখ্যা তিন শতাধিক। এখানে নাটকের পাশাপাশি আবৃত্তি ও চিত্রাঙ্কন শেখানো হয়। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ব্যক্তি নাটক প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকেন। নাটকের দুটি শাখা রয়েছে। এখানে শিশুদেরও নাটক শেখানো হয়। এছাড়া বড়দের জন্য রয়েছে নাটক শেখার ব্যবস্থা। আবৃত্তি ও চিত্রাঙ্কনে রয়েছে প্রায় দুই শতাধিক শিক্ষার্থী। অভিজ্ঞ শিক্ষকের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের আবৃত্তি ও চিত্রাঙ্কন শেখানো হয়। আবৃত্তির শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন শিলা, তোপা, এলিস ও নিশি। চিত্রাঙ্কন শেখান সাদি তাইফ, অণু, মোহন ও অপু। দেশ ও দেশের বাইরে বিবর্তন যশোরের ৮৯টি নাটকের প্রায় সহস্রাধিক প্রদর্শনী হয়েছে। যার মধ্যে ১৪টি মঞ্চ নাটকের দুই শতাধিক, ১২টি শিশুতোষ নাটকের ৭০টির বেশি, ৬৩টি পথনাটকের তিন হাজারের বেশি প্রদর্শনী হয়েছে।
উল্লেখযোগ্য নাটকগুলো হলো: যুদ্ধ, পাইচো চোরের কেচ্ছা, পুরস্কার, বুড়ো শালিকের ঘাড়ের রোঁ, মহাবিদ্যা, বিসর্জন, মনের আয়না, বিবাহ প্রস্তাব, রাজা প্রতাপাদিত্য, মাত্ব্রিং ইত্যাদি। এই সংগঠন নাটকের মাধ্যমে যশোরের গণ্ডি ছাড়িয়ে দেশ ও দেশের বাইরে পরিচিতি লাভ করেছে। এ পর্যন্ত দেশ-বিদেশে ৫০টির অধিক নাট্য উৎসবে অংশ নিয়েছে সংগঠনটি এবং ২২টির অধিক আঞ্চলিক, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নাট্য উৎসবের আয়োজন করেছে। ২০১৮ সালে থিয়েটার অলিম্পিকে ‘মাত্ব্রিং’ নামে আঁচিক ভাষার একটি নাটক মঞ্চায়িত করে। ‘মাত্ব্রিং’ শব্দের অর্থ গভীর অরণ্যচারী। এই নাটকের মাধ্যমে সংগঠনটি বিশ্বের নাট্যপ্রেমীদের কাছে পরিচিতি লাভ করে। ২০১৬ থেকে ২০১৭ সালে বেসরকারি পরিবেশনায় সারাদেশের ১৮০টি নাট্য সংগঠনকে টপকিয়ে বিবর্তন যশোর নাটকে প্রথম স্থান অর্জন করে। সম্প্রতি সময়ে স্বাধীনতার ৫০ বছর উপলক্ষে সরকার ঘোষিত সেরা ১০০টি নাটকের মধ্যে বিবর্তন যশোরের ‘মাত্ব্রিং’ নাটক রয়েছে।
বিবর্তন যশোরের ৩টি শাখা রয়েছে। ঢাকা, যশোর সরকারি মাইকেল মধুসূদন কলেজ ও যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় শাখা। সংগঠনটির কমিটি গঠন গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় হয়ে থাকে। এক বছর পরপর সভাপতি, সম্পাদকসহ ১৫ সদস্য বিশিষ্ট কমিটি গঠন করা হয়। সংগঠনটির সদস্যদের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা ও সহমর্মিতা অনন্য নজির স্থাপন করে।
শুধু প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক আন্দোলন নয়। সমাজ ও রাষ্ট্রের ক্রান্তিলগ্নে সংগঠনটি মানবিক ও মানসিক স্বস্তির জায়গা থেকে আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাওয়ার দৃষ্টান্ত রয়েছে। করোনা মহামারির সময় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সংগঠনের নেতাকর্মী ও শুভাকাঙ্ক্ষীদের সহযোগিতায় বিনামূল্যে অক্সিজেন সেবা চালিয়ে গিয়েছেন। শত শত মানুষ তাদের ওপর ভরসা করে মানুষকে সাহায্য সহযোগিতা পাঠিয়েছেন। এমনও গল্প রয়েছে, স্কুল পড়ুয়া শিক্ষার্থী তার মাটির ব্যাংকটি এনে মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন, শুধুমাত্র বিবর্তন যশোরকে বিশ্বাস করে, ভালোবেসে। বিবর্তন যশোর থেকে নাটকচর্চা শিখে অনেকে দেশ ও দেশের বাইরে সুনাম অর্জন করেছেন। সিনেমায় নাম লিখিয়েছেন আব্দুর নূর। নাটকে অভিনয় করছেন কাকলি, তমালসহ আরও অনেকে। পরিচালক বনে গেছেন রাকেশ, নাট্যলেখক হিসেবে নাম অর্জন করেছেন মনিরুল ইসলামরা। বিবর্তন যশোরের পথচলাটা ততটা সহজ ছিলো না। এখনও যে তাদের চলার পথ মসৃণ, তেমনটাও না।
পথনাটক দিয়ে শুরু হওয়া সংগঠনটি তাদের অভিনীত নাটকের মাধ্যমে সমাজের দিনমজুর খেটে খাওয়া মানুষের কথা বলার পাশাপাশি শাসকগোষ্ঠীর কাছে প্রতিবাদের বার্তা পাঠিয়েছে। যে কারণে বারংবার ক্ষমতাসীনদের রোষানলে পড়তে হয়েছে। সংগঠনটি এমনও সময় পার করেছে যখন নাটক মঞ্চায়িত করতে গেলে সরকারের দপ্তরে পাণ্ডুলিপি জমা দিয়ে নাটকের অনুমতি নিতে হয়েছে। ছন্দরাম ও দেবীদর্শন নাটকে সমসাময়িক প্রেক্ষাপট থাকায় নাটক দুটি নিয়ে পুলিশি হয়রানির কথাও শোনা গেছে। বর্তমানে সংস্কৃতির মন্দা অবস্থা।
দেশীয় সংস্কৃতি প্রাচ্য অপসংস্কৃতির জোয়ারে হারাতে বসেছে। এখন নাটক, কবিতা, গান মনের খোরাক মেটাতে অল্প সংখ্যক মানুষের বিনোদন মাধ্যম। অর্থের জোগান ও লোক সংকটে অনেক সাংস্কৃতিক সংগঠন তাদের সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে পারছে না। নানা সীমাবদ্ধতার মধ্য দিয়েও বিবর্তন যশোর সকল সামাজিক অসঙ্গতির বিরুদ্ধে নতুন জীবনের ছাড়পত্র হাতে নিয়ে স্বগৌরবে, নিজস্ব ধারায় দিনরাত দেশ ও দেশের বাইরে কথা বলেই যাচ্ছে।
(এসএ/এসপি/অক্টোবর ২০, ২০২৫)