ফরিদপুরে সর্বনাশা অনলাইন জুয়া কেড়ে নিলো শহীদ শিকদারের প্রাণ
রিয়াজুল রিয়াজ, বিশেষ প্রতিনিধি : ফরিদপুর সদরের কানাইপুরে অনলাইন জুয়া খেলে প্রায় ১২ লাখ টাকা লস গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন শহীদ শিকদার (৩৬) নামের এক ভ্যান চালক। বৃহস্পতিবার দুপুর ১২ টার দিকে নিজ এলাকা কানাইপুরের লক্ষীপুরে ফরিদপুর-মাগুরা মহাসড়কের পাশে, একটি বাগানে গাছের সাথে গলার ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন তিনি।
বৃহস্পতিবার বেলা সাড়ে ১২ টার দিকে স্থানীয় সূত্রে খবর পেয়ে শহীদ শিকদারের লাশ উদ্ধার করে ময়না তদন্তের জন্য ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে পাঠিয়ে স্থানীয় থানা পুলিশ।
উপরোক্ত বিষয়গুলো নিশ্চিত করে ফরিদপুর কোতয়ালি থানার উপপরিদর্শক (এসআই) জাহাঙ্গীর আলম জানান, 'শহীদ শিকদারের লাশ উদ্ধার করে সুরতহাল শেষে ময়না তদন্তের জন্য ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়েছে।' এছাড়া, এ বিষয়ে কোতোয়ালি থানায় একটি অপমৃত্যু মামলা করা হয়েছে বলেও জানান এসআই জাহাঙ্গীর।
বিষয়টি জানতে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় সরেজমিনে কানাইপুরের মিলগেট এলাকা ও লক্ষীপুরে নিহতের বাড়ীতে গিয়ে জানা যায়, শহীদ শিকদার নিয়মিত অনলাইন জুয়া খেলতেন। ভ্যানচালক শহীদ নিরক্ষর থাকলেও প্রবাসী স্ত্রীর সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতে এন্ড্রয়েড মোবাইল সেট ব্যবহার করতেন। স্থানীয় মিলগেট এলাকায় শামীম স্টোর নামে একটি মুদি দোকানে বিকাশ এজেন্ট থাকায় দোকানদার শামীম থেকে তিনি প্রবাসী বউয়ের পাঠানো টাকা লেনদেন করতেন। পরে শামীমের মাধ্যমে জুয়ার অ্যাপস নামিয়ে শিখে নেন জুয়া খেলার নিয়ম। তারপর থেকে অনলাইন জুয়ায় আসক্ত হয়ে পড়েন তিনি। এরপর বিকাশ ব্যবসায়ী শামীমের মাধ্যমে এক একটা জুয়ার অ্যাপস নামিয়ে খেলেন আর হারেন। এভাবে প্রবাসে থেকে স্ত্রীর তিন বছরে কষ্ট করে উপার্জন করা প্রায় ১২ লাখ টাকা তিনি অনলাইন জুয়া খেলে হেরে যান। সম্প্রতি নিহত শহীদ শিকদারের স্ত্রী তিন বছর পর দেশে এসে তাঁর পাঠানো টাকার হিসাব চাইলে তিনি হিসেব দিতে না পারায় নিজের ভুল বুঝতে পেরে, নিজেকে অপরাধী মনে করতে থাকেন। এরপর বৃহস্পতিবার দুপুরে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন এই ভ্যান চালক।
স্থানীয় জনগণের সাথে কথা বলে জানা গেছে মিলগেট এলাকায় অনেক কিশোর যুবককে জুয়ায় আসক্ত করেছেন স্থানীয় মুদি দোকানদার বিকাশ ব্যবসায়ী শামীম। নিহত শহীদ শিকদারের সাথে এক দলে প্রায় ৩০ জনের মতো জুয়া খেলতেন তাদের মধ্যে দু'জনের সাথে কথা হয়। আত্মস্বীকৃত ওই দুই অনলাইন জুয়ারীর নাম শাকিল (৩৫) ও লোকমান (৪১)। তারা শামীমের মাধ্যমে অনলাইন জুয়ার অ্যাপস নামিয়ে তার দোকান থেকে মোবাইলে টাকা ঢুকিয়ে দোকানের সামনে বসে বা মিলগেটের কোনো এক দোকানে বসে খেলতেন। এদের মধ্যে শাকিল ৯৬ হাজার টাকা হেরেছেন এবং লোকমান হিসেব না করলেও আনুমানিক ৫০ হাজার টাকা হারার পর তার এন্ড্রয়েড মোবাইল ফোনটি আছাড় মেয়ে ভেঙে ফেলে জুয়া খেলা ছেড়ে দিয়েছেন বলে জানান।
এসব বিষয়ে জানতে শামীম স্টোরে গিয়ে শামীমের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, এলাকার কোনো বিকাশ এজেন্ট থেকে কেউ তার ব্যক্তিগত বিকাশে ৫০০ টাকার নীচে ঢুকাতে পারতো না, আর ঢুকালেও তাকে বারতি ১০ টাকা বেশি দিতে হতো। আর আমি ২০০, ৩০০, ৪০০ সবই দিতাম। তাই অনেক লোক আমার দোকানে আসতো। তারা টাকা ঢুকিয়ে কি করতো আমি জানতাম না। দেখতাম আমার দোকানের সামনে বসে বসে অনেকেই মোবাইল টিপতো। কিছুক্ষণ পরপর টাকা ভরতো।' তিনি আরও জানান, আমি কাউকে কোনো অ্যাপস নামিয়ে দেই নাই, আমি কোনো অনলাইন জুয়ার সাথে সম্পৃক্তও নই।'
এ বিষয়ে বিকাশ ব্যবসায়ী শামীমের পাশের দোকানদার ও সরকারি রাজেন্দ্র কলেজের মাস্টার্স পড়ুয়া ছাত্র মো. রকিবুল ইসলাম জানান, আমি বিকালে যখন দোকানে আসতাম তখন দেখতাম অনেকগুলো ছেলে শামীম ভাইয়ের দোকানের সামনে বসে মোবাইল টিপছে। আর একটু পরপর ফোনে টাকা ভরছে। তবে তারা কি করছে তা জানতাম না। এমবকি শামীম ভাই অনলাইন জুয়ার সাথে জড়িত আছেন কিনা সেটাও আমার জানা নাই।
এদিকে, এসব ঘটনার পর কানাইপুরে অনলাইন ক্যাসিনো বা জুয়ার খোঁজ খবর নিতে গেলে বেড়িয়ে আসে ভয়াবহ তথ্য। এলাকার একটি বিশাল অংকের যুবকই অনলাইন ক্যাসিনো বা জুয়ায় আসক্ত। তারা নিয়মিত কোনো না কোনো অনলাইন জুয়া খেলে থাকেন। এসব বিষয়ে খোঁজ নিতে ডজন খানেক বিকাশ এজেন্ট মালিকের সাথে কথা বলে এ বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া গেছে। কেউ নাম প্রকাশ করতে অস্বীকৃতি জানালেও এ বিষয়ে মুখ খুলেছেন কানাইপুর হলপট্রি'র একজন বিকাশ এজেন্ট বিল্লাল হোসেন। তিনি জানান, আমি বুঝি কারা কারা টাকা ভরতে আসে জুয়া খেলতে। অনেক সময় তাদের বলি বিকাশে টাকা নাই, দিবো না। অনেক সময় অস্বীকার করতেও পারি না। তিনি জানান, প্রশাসনকে বলে এখনই যদি এসব অনলাইন ক্যাসিনো জুয়া না ফেরানো যায়, তবে অনেকেই ফকির হয়ে যাবেন।
বিষয়টি অবগত করলে স্থানীয় ৯ নং কানাইপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শাহ মোহাম্মদ আলতাফ হুসাইন উদ্বেগ প্রকাশ করে 'দৈনিক বাংলা ৭১'কে জানান, 'এসব অনলাইন ক্যাসিনো, জুয়া বা ক্রিকেট জুয়া দ্রুত বন্ধে প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। আমি ব্যক্তিগতভাবে এলাকায় মাদক, জুয়ার বিপক্ষে সব সময় ছিলাম ও আছি। প্রশাসন চাইলে এসব বন্ধে পুলিশ প্রশাসনকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করবে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের প্রতিটি নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি, বলেও জানান চেয়ারম্যান আলতাফ হুসাইন।
শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত শুক্রবার (২৪ অক্টোবর) সকাল ১১ টায় দিকে শহীদ সিকদারের লাশ ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গ থেকে কানাইপুরের লক্ষীপুরে তার বাড়িতে আনা হয়েছে। বাদ জোহর নামাজে জানাজার পর তাকে দাফন করা হবে বলে নিহত শহীদ শিকদারের পরিবার থেকে জানানো হয়েছে।
অনলাইন ক্যাসিনো বা জুয়া খেলে ১২ লাখ টাকা লস দিয়ে আত্মহত্যা করা শহীদ শিকদার স্থানীয় লক্ষীপুর গ্রামের তোতা শিকদারের বড় ছেলে। পেশায় ভ্যান চালক তোতা শিকদার দাবি করেন, তার মতো কোনো পিতা যেনো অনলাইন জুয়ার কারণে পুত্রহারা না হন। এলাকা থেকে অনলাইন জুয়া বন্ধে স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন ও সংশ্লিষ্ট দপ্তরের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন তোতা শিকদার। নিহত শহীদ শিকদার মৃত্যু কালে এক ছেলে ও এক মেয়ে রেখে গেছেন।
(আরআর/এএস/অক্টোবর ২৪, ২০২৫)
