মারুফ হাসান ভূঞা 


বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে জামায়াতে ইসলামী ও গোলাম আজম এক কলঙ্কময় অধ্যায়। পূর্ব বাংলার মানুষের উপর অত্যাচার, নিপীড়ন ও অর্থনৈতিক শোষণে অবরুদ্ধ করে রাখা পশ্চিম পাকিস্তান রাষ্ট্রকে রক্ষার নামে যে ক'জন ষড়যন্ত্রকারী কাজ করছিল গোলাম আজম ছিলেন তাদের অন্যতম শীর্ষ সংগঠক। কেবল মতাদর্শিকভাবে নয়, সাংগঠনিক, কূটনৈতিক ও সন্ত্রাসী প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরুদ্ধে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর একমাত্র পথ প্রদর্শক হিসেবে কাজ করেছে। 

১৯৭১ সালের শুরুর পূর্ব থেকে গোলাম আজম বুঝতে পারেন বাংলার মানুষ পাকিস্তানের তীব্র শাসন,শোষণ ও অর্থনৈতিক নিপীড়ন থেকে মুক্তির লক্ষে এদেশের মানুষ সংগঠিত হচ্ছে, জনযুদ্ধের দিকে দাবিত হচ্ছে। গোলাম আজম পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর ছত্রছায়ায় নিজের তৎকালীন ইসলামী ছাত্রসংঘ ও জামায়াতে ইসলামীর সংগঠনগুলোকে পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষার নামে সংগঠিত করতে থাকেন। কুৎসা রটানো শুরু করেন ধর্ম বনাম মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে। মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী নিজের ব্যক্তিগত বানানো ধর্মীয় বক্তব্য ছড়িয়ে মুক্তিযুদ্ধকে হিন্দুত্ববাদের ষড়যন্ত্র হিসেবে উপস্থাপন করবার চেষ্টা করেন। সে লক্ষে বাংলাদেশে ২৫ মার্চের ভয়াল গণহত্যার পূর্বেই ঢাকায় পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর সঙ্গে বৈঠক করেন এবং “বিদ্রোহ দমন”–এর আহ্বান জানান (সূত্র: The Daily Pakistan Observer, মার্চ ১৯৭১)।

গোলাম আজম ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান গুলোতে পড়াশোনা করা শিক্ষার্থী বিশেষ করে এতিম খানা, মক্তবের মতো প্রতিষ্ঠান গুলোতে অধ্যায়নরত শিক্ষার্থীদের হিপনোটাইজ করে মুক্তিকামী মানুষদের হত্যা করবার পাঠ দিতেন। সে লক্ষে গোলাম আজম ইসলামী ছাত্রসংঘ ও জামায়াতে ইসলামীর যৌথ উদ্যোগে “শান্তি কমিটি”, “আল-বদর” ও “আল-শামস” নামে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর সহযোগী বাহিনী গঠন করে। বাংলার মুক্তিকামী মানুষ ও বুদ্ধিজীবীদের ওপর নির্মম গণহত্যায় সহযোগিতা ও হত্যাযজ্ঞ পরিচালনা করে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন Amnesty International এবং ব্রিটিশ সাংবাদিক অ্যান্থনি ম্যাসকারেনহাসের (Anthony Mascarenhas) প্রতিবেদনে সে নৃশংসতার চিত্র বিস্তারিতভাবে উঠে এসেছে।

গোলাম আজমের প্রত্যক্ষ ও সরাসরি তত্ত্বাবধানে গঠিত ও পরিচালিত “কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটি” ছিল পাকিস্তানি সেনাদের সহযোগী রাজনৈতিক বাহিনী। পাকিস্তান সামরিক বাহিনী এই কমিটির কার্যবিবরণী, তথ্য ও আয়োজন অনুযায়ী, দেশব্যাপী মুক্তিকামী মুক্তিযোদ্ধা, রাজনৈতিক সচেতন ব্যক্তি, বিশেষজ্ঞ, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবীদের হত্যা, নিপীড়ন, খুন, ধর্ষন পরিচালনা করতো। ১৯৭১ সালের এপ্রিল থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত এই কমিটি পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে নীতিগত ভাবে সহযোগিতা করেছে। বাংলার মানুষের ঘর- ব্যাবসায়ী প্রতিষ্ঠানে সরাসরি লুটপাট ও হত্যাযজ্ঞ পরিচালনা করেছে।

ঢাকা, খুলনা, রাজশাহী ও চট্টগ্রামে এই কমিটির স্থানীয় শাখাগুলো সরাসরি আল-বদর বাহিনীর সঙ্গে জোটবদ্ধ ভাবে রীতিমতো কর্মসূচি আকারে গণহত্যায় কাজ করত। আল-বদরের সদস্যরা মূলত ইসলামী ছাত্রসংঘের ক্যাডার ছিল,মূলত ছদ্মনামে বুদ্ধিজীবী হত্যার উদ্দেশ্যে এই বাহিনী গড়ে তোলা হয়। যার প্রধান ও ঐশ্বরিক তাত্ত্বিক ছিলেন গোলাম আজম। সারাদেশে মুক্তিযুদ্ধকালীন যে সকল বুদ্ধিজীবি মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় হয়ে উঠে সে সকল বুদ্ধিজীবীকে হত্যার অভিযানে সক্রিয় ভূমিকা নেয়, এই আল-বদর বাহিনী। এই বাহিনীর নৃশংসতা ও গঠন কতটা উদ্দেশ্য প্রনোদিত কেবল বুদ্ধিজীবী হত্যাকে কেন্দ্র করে ছিল তাঁর প্রমাণ মিলে ১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১-এ যেসব শিক্ষক, সাংবাদিক ও সাহিত্যিককে হত্যার মধ্য দিয়ে। আর এই হত্যাকান্ড পরিচালনার পেছনে আল-বদর বাহিনী সরাসরি গোলাম আজমের নেতৃত্ব, সাংগঠনিক কাঠামো ও আদর্শিক অনুশীলনের পরিস্ফুটন পাই ব্যাপকভাবে।
(সূত্র: Government of Bangladesh, War Crimes Files, 1972)।

যুদ্ধ চলাকালীন গোলাম আজম একদিকে যেমন আল-শামস, আল-বদর ও শান্তি কমিটির মাধ্যমে হত্যাযজ্ঞে পরিচালনায় পাকিস্তান সামরিক বাহিনীকে সহযোগিতা করছিল। অন্যদিকে ধর্মকে পূজি করে সেসব হত্যাযজ্ঞকে আরো কেন্দ্রভূত করতে পূর্ব পাকিস্তান থেকে পালিয়ে পশ্চিম পাকিস্তান, যুক্তরাজ্যে গিয়েও সক্রিয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী প্রচারণা চালান। তিনি ১৯৭১ সালের মে মাসে ইসলামাবাদে অনুষ্ঠিত এক সংবাদ সম্মেলনে দাবি করেন—বাংলাদেশে “ভারতের ষড়যন্ত্রে গৃহযুদ্ধ চলছে” এবং “পাকিস্তানি সেনারা দেশের ঐক্য রক্ষায় লড়ছে” বারে বারে ধর্মীয় মিথ্যা বক্তব্য দিয়েছেন হিন্দুত্ববাদী যুদ্ধ, নাস্তিকদের যুদ্ধ বলে। আর সে যুদ্ধ মোকাবিলায় মুসলমান সমাজের ঐক্যবদ্ধতাকে ঈমানি দায়িত্ব হিসেবে সংঘায়িত করেছেন। (সূত্র: Dawn, মে ১৯৭১)।

সে গণহত্যার চিহ্নিত সহকারী গোলাম আজমকে যদি কেউ ‘মহান নেতা’ বলতে চায়, ইতিহাসের মহা নায়ক বানাতে চাই তবে সেটি শুধু মিথ্যার প্রচার নয়, শহীদদের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা হবে,বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে কালিমালিপ্ত করা হবে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে বিকৃত করে কোনো সমাজ টিকে থাকতে পারে না। মুক্তিযুদ্ধ কোনো রাজনৈতিক পক্ষের সম্পদ নয়, এটি ছিল বাঙালির অস্তিত্ব রক্ষার যুদ্ধ, শোষণ, মুক্তির লড়াই। তাই এই মাটিতে যুদ্ধাপরাধী, পাকিস্তান রাষ্ট্রের পূর্ব চিন্তা, মৌলবাদী, সাম্প্রদায়িক চিন্তার পুনর্বাসনের কোনো স্থান নেই।

যারা ইতিহাস বিকৃত করে অপরাধীকে নায়ক বানাতে চায়, তারা মূলত পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে মরিয়া হয়ে আছে।কিন্তু তারা হয়তো ভুলে যাচ্ছে, এই জাতি রক্ত দিয়ে পাকিস্তানি শাসকদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে, যুদ্ধ করেছে এবং বাংলার স্বাধীনতা এনেছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে ঘাতক কখনো মহানায়ক হয় না। ঘাতক ঘাতক-ই হয়।

লেখক : লেখক ও প্রাবন্ধিক।