ওয়াজেদুর রহমান কনক


বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল—বিশেষ করে রংপুর, লালমনিরহাট, নীলফামারী, কুড়িগ্রাম ও গাইবান্ধা জেলা—প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ হলেও দীর্ঘদিন ধরে অর্থনৈতিকভাবে পশ্চাদপদ অঞ্চলের মর্যাদা বহন করে আসছে। খরাপ্রবণতা, নদীভাঙন, মৌসুমি বন্যা, সেচের অভাব ও কর্মসংস্থানের সীমাবদ্ধতা এই অঞ্চলের জনগণের জীবনমান উন্নয়নে প্রধান প্রতিবন্ধকতা হিসেবে কাজ করেছে। এই বাস্তবতায় “তিস্তা মহাপরিকল্পনা” কেবল একটি অবকাঠামোগত প্রকল্প নয়, বরং এটি বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের অর্থনৈতিক পুনর্জাগরণের সম্ভাবনাময় রূপরেখা—একটি আঞ্চলিক উন্নয়নের নতুন দিগন্ত। তিস্তা মহাপরিকল্পনা হলো বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলকে কেন্দ্র করে একটি বৃহৎ নদী ব্যবস্থাপনা ও আঞ্চলিক উন্নয়ন প্রকল্প, যার মূল উদ্দেশ্য—তিস্তা নদীর পানিপ্রবাহ সংরক্ষণ, নদীভাঙন নিয়ন্ত্রণ, সেচব্যবস্থা সম্প্রসারণ, কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি, এবং উত্তরাঞ্চলের অর্থনৈতিক পুনর্জাগরণ ঘটানো।

বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের উদ্যোগে প্রণীত এই পরিকল্পনায় চীনের রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান PowerChina প্রযুক্তিগত সহায়তা দিয়েছে। আনুমানিক ব্যয় প্রায় ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার (প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা)। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে নদীর দুই তীরে পানি সংরক্ষণের জন্য রিজার্ভয়ার, বাঁধ ও সেচ অবকাঠামো গড়ে তোলা হবে, যা খরাপ্রবণ উত্তরাঞ্চলে ত্রিমৌসুমি চাষের সুযোগ সৃষ্টি করবে।

একই সঙ্গে তিস্তা নদীর চরাঞ্চলে পরিকল্পিতভাবে ইকো-ট্যুরিজম, মৎস্য চাষ, অর্থনৈতিক অঞ্চল ও শিল্পায়ন গড়ে তোলার পরিকল্পনাও রয়েছে। এটি কেবল পানি ব্যবস্থাপনা নয়—বরং একটি সমন্বিত সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন প্রকল্প, যা শিক্ষা, কর্মসংস্থান, নারী উদ্যোক্তা, পরিবেশ সংরক্ষণ এবং স্থানীয় অর্থনীতি পুনর্গঠনে ভূমিকা রাখবে। ইকো-ট্যুরিজম, মৎস্য চাষ, অর্থনৈতিক অঞ্চল ও শিল্পায়ন—এই চারটি উপাদান একত্রে উত্তরাঞ্চলের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের মূল চালিকা শক্তি হিসেবে বিবেচিত।

ইকো-ট্যুরিজম হলো পরিবেশবান্ধব পর্যটন, যা নদী, হ্রদ, বন ও চরাঞ্চলের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য প্রদর্শন করে স্থানীয় মানুষের আয় বৃদ্ধি করে এবং পরিবেশ সংরক্ষণে অবদান রাখে।

মৎস্য চাষ বা অ্যাকুয়াকালচার নদী, হ্রদ ও জলাভূমিতে মাছ উৎপাদন বৃদ্ধি করে, যা খাদ্য নিরাপত্তা, স্থানীয় অর্থনীতি ও কর্মসংস্থান নিশ্চিত করে।

অর্থনৈতিক অঞ্চল (Economic Zone) হলো শিল্প ও বাণিজ্য কেন্দ্র, যেখানে আধুনিক অবকাঠামো ও সুবিধা প্রদান করে ক্ষুদ্র থেকে বড় উদ্যোক্তা, উৎপাদন ইউনিট ও বিনিয়োগের সুযোগ সৃষ্টি হয়।

শিল্পায়ন হলো শিল্পকারখানা, প্রসেসিং ইউনিট ও মানসম্মত উৎপাদন প্রতিষ্ঠা করা, যা কৃষি ও প্রাকৃতিক সম্পদকে প্রক্রিয়াজাতকরণ করে অর্থনৈতিক মূল্য বৃদ্ধি করে।

এই চারটি উপাদান একসাথে কার্যকর হলে নদী তীরবর্তী এলাকার অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে বৈচিত্র্য, কর্মসংস্থান, আয়ের বৃদ্ধি এবং টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত হয়।

তবে প্রকল্পের বাস্তবায়নে চ্যালেঞ্জও রয়েছে—বিশেষত ভারতের সঙ্গে তিস্তা চুক্তি অনিষ্পন্ন থাকা, চীনের অর্থায়নকে ঘিরে ভূরাজনৈতিক টানাপোড়েন, পরিবেশগত ঝুঁকি এবং দীর্ঘমেয়াদি রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয়।

তবুও, সফলভাবে বাস্তবায়িত হলে তিস্তা মহাপরিকল্পনা উত্তরবঙ্গকে বাংলাদেশের “নর্থ ইকোনমিক করিডর” রূপে গড়ে তুলতে পারে, যা জাতীয় অর্থনীতিতে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে এবং টেকসই উন্নয়নের পথে একটি ঐতিহাসিক পদক্ষেপ হিসেবে গণ্য হবে।

নর্থ ইকোনমিক করিডর (North Economic Corridor) হলো বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলকে অর্থনৈতিক উন্নয়ন, শিল্পায়ন ও বাণিজ্যের সঙ্গে মূল শহর ও আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সংযুক্ত করার একটি পরিকল্পিত আঞ্চলিক করিডর। এর মূল লক্ষ্য হলো নদী তীরবর্তী এলাকা, রেল ও সড়ক যোগাযোগ, বিমানবন্দর এবং শিল্পাঞ্চলকে একসাথে যুক্ত করে কৃষি, শিল্প, ব্যবসা ও পর্যটনের কার্যক্রমের সঙ্গে অর্থনৈতিক কার্যকারিতা বৃদ্ধি করা।

করিডরের মাধ্যমে উত্তরাঞ্চলের উৎপাদন, রপ্তানি, বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পাবে, স্থানীয় জনগণের আয় ও জীবনমান উন্নত হবে, এবং জাতীয় অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখবে। এটি মূলত অঞ্চলভিত্তিক পরিকল্পিত উন্নয়ন ও সড়ক–নদী–বিমান যোগাযোগের সমন্বিত কাঠামো, যা উত্তরবঙ্গকে দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করবে।

তিস্তা নদী হিমালয়ের পাদদেশ থেকে উৎপন্ন হয়ে ভারতের সিকিম ও পশ্চিমবঙ্গ অতিক্রম করে বাংলাদেশের রংপুর বিভাগে প্রবেশ করে, এবং অবশেষে ব্রহ্মপুত্র নদে মিলিত হয়। নদীটির মোট দৈর্ঘ্য প্রায় ৩১৫ কিলোমিটার, যার মধ্যে প্রায় ১২৪ কিলোমিটার প্রবাহিত হয়েছে বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে। কিন্তু এই নদীর পানিবণ্টন নিয়ে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে কয়েক দশক ধরে অনিষ্পন্ন একটি চুক্তি বিরাজ করছে। ১৯৮৩ সালে স্বাক্ষরিত তিস্তা চুক্তির খসড়া কার্যকর হয়নি, ফলে শুষ্ক মৌসুমে পানিপ্রবাহ ৫০০ কিউসেকের নিচে নেমে আসে—যা কৃষি ও পরিবেশ উভয়ের জন্য ভয়াবহ সংকট তৈরি করে। এই পটভূমিতে বাংলাদেশের প্রস্তাবিত “তিস্তা মহাপরিকল্পনা” (Teesta Master Plan) কৌশলগত ও অর্থনৈতিকভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।

তিস্তা মহাপরিকল্পনা মূলত নদী ব্যবস্থাপনা, পানি সংরক্ষণ, সেচ, বন্যা নিয়ন্ত্রণ, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও আঞ্চলিক অর্থনৈতিক উন্নয়নকে কেন্দ্র করে একটি বহুমাত্রিক উন্নয়ন পরিকল্পনা। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের (BWDB) অধীনে প্রণীত এ প্রকল্পটি ২০২৩ সালে নতুনভাবে উপস্থাপিত হয়, যেখানে চীনের Power Construction Corporation of China (PowerChina) প্রযুক্তিগত সহায়তা প্রদান করেছে। প্রকল্পের আনুমানিক ব্যয় প্রায় ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার (প্রায় ১০,০০০ কোটি টাকা)।

এ পরিকল্পনায় তিস্তা নদীর দুই তীরে নদীড্রেজিং, বাঁধ ও এমব্যাংকমেন্ট নির্মাণ, ওয়াটার রিজার্ভয়ার, সেচ ব্যবস্থা, ফিশারি, পর্যটন কেন্দ্র ও অর্থনৈতিক জোন প্রতিষ্ঠা অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। লক্ষ্য হলো, বর্ষাকালে অতিরিক্ত পানির সঞ্চয় করে তা শুষ্ক মৌসুমে কৃষি, শিল্প ও গৃহস্থালি কাজে ব্যবহারযোগ্য করা।

তিস্তা নদী অববাহিকা বাংলাদেশের প্রায় ৭ লক্ষ হেক্টর ভূমিকে সরাসরি প্রভাবিত করে। বর্তমানে যেখানে বছরে এক বা দুই মৌসুমে চাষ সম্ভব, মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের পর ত্রিমৌসুমি চাষের সুযোগ সৃষ্টি হবে। পানি সংরক্ষণ ও আধুনিক সেচ প্রযুক্তির মাধ্যমে বছরে প্রায় ২৫-৩০ লাখ টন অতিরিক্ত খাদ্যশস্য উৎপাদন সম্ভব হবে বলে বিশেষজ্ঞরা ধারণা দেন। ধান, গম, ভুট্টা, পেঁয়াজ, রসুন, ডাল ও সবজি উৎপাদনে বিপুল বৃদ্ধির সম্ভাবনা তৈরি হবে।

এর পাশাপাশি কৃষিজাত পণ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প গড়ে ওঠলে অঞ্চলভিত্তিক খাদ্যশিল্প চেইন (Agro-based Value Chain) সৃষ্টি হবে, যা কৃষকদের আয় বৃদ্ধি ও কর্মসংস্থানে মৌলিক পরিবর্তন আনবে।

তিস্তা নদীর দুই তীরে পরিকল্পিতভাবে তিস্তা ইকোনমিক জোন গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এতে কৃষি, হালকা শিল্প, টেক্সটাইল, ও খাদ্যপ্রসেসিং ইউনিট স্থাপনের সুযোগ থাকবে। নীলফামারীর সৈয়দপুর বিমানবন্দর ও ইপিজেডের সঙ্গে সমন্বয় ঘটিয়ে একটি নর্থ ইকোনমিক করিডর গঠন করা সম্ভব হবে, যা দক্ষিণ এশিয়ার বাণিজ্যিক সংযোগে বাংলাদেশের ভূমিকা শক্তিশালী করবে। তিস্তা ইকোনমিক জোন হলো বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে তিস্তা নদীর তীরে পরিকল্পিত একটি বিশেষ শিল্প ও বাণিজ্য এলাকা, যা স্থানীয় অর্থনীতি, কর্মসংস্থান এবং উৎপাদন সক্ষমতা বাড়াতে নির্মিত হচ্ছে। এখানে আধুনিক অবকাঠামো, সেচ ও পানির সহজলভ্যতা, সড়ক ও যোগাযোগ সুবিধা, এবং বিনিয়োগের অনুকূল পরিবেশ তৈরি করা হবে।

এই ইকোনমিক জোনে কৃষি-ভিত্তিক শিল্প, খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ, হালকা শিল্প ও অন্যান্য উৎপাদন ইউনিট গড়ে তোলা হবে। এর ফলে নদী তীরবর্তী এলাকার জনগণের আয় বৃদ্ধি, কর্মসংস্থানের সৃষ্টি এবং আঞ্চলিক শিল্পায়ন উৎসাহিত হবে। সংক্ষেপে, তিস্তা ইকোনমিক জোন হলো উত্তরাঞ্চলের অর্থনৈতিক পুনর্জাগরণ ও শিল্পায়নের কেন্দ্রবিন্দু, যা জাতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে।
এছাড়া, তিস্তা নদীকে কেন্দ্র করে ইকো-ট্যুরিজম, নৌপর্যটন, মৎস্যচাষ ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ অঞ্চল তৈরি করা গেলে পর্যটন আয়ের নতুন উৎস সৃষ্টি হবে। ‘তিস্তা ওয়াটার ফ্রন্ট’ প্রকল্পের মাধ্যমে নদীতীরবর্তী এলাকায় নান্দনিক বসতি, রিসোর্ট, সাংস্কৃতিক কেন্দ্র ও বাজার সুবিধা উন্নয়ন করা যেতে পারে, যা স্থানীয় অর্থনীতিকে বৈচিত্র্যময় করবে।

তিস্তা নদীর চরাঞ্চল ও জলাভূমি বাংলাদেশের পরিবেশগত ভারসাম্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। দীর্ঘদিনের অনিয়ন্ত্রিত বালু উত্তোলন, নদীভাঙন ও পানিপ্রবাহ কমে যাওয়া এই ইকোসিস্টেমকে ঝুঁকিতে ফেলেছে। মহাপরিকল্পনায় “Integrated River Basin Management (IRBM)”মডেল প্রয়োগের মাধ্যমে নদীর তলদেশ সংরক্ষণ, জীববৈচিত্র্য রক্ষা, ও বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল পুনর্গঠন অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।

তবে টেকসই বাস্তবায়নের জন্য স্থানীয় জনগণের অংশগ্রহণ ও সামাজিক প্রভাব মূল্যায়ন (Social Impact Assessment) অপরিহার্য। শুধু অবকাঠামো নয়, ইকোলজিক্যাল রেস্টোরেশন ও কমিউনিটি রেজিলিয়েন্স গড়ে তুলতে হবে। ইকোলজিক্যাল রেস্টোরেশন (Ecological Restoration) হলো ক্ষতিগ্রস্ত বা ক্ষয়প্রাপ্ত প্রাকৃতিক পরিবেশকে পুনরুদ্ধার করা এবং তার জীববৈচিত্র্য, জলবায়ু ভারসাম্য ও সিস্টেমকে পুনঃস্থাপন করা। এর লক্ষ্য নদী, বন, জলাভূমি ও অন্যান্য প্রাকৃতিক সম্পদকে পুনরায় টেকসই ও কার্যকর করা।

কমিউনিটি রেজিলিয়েন্স (Community Resilience) হলো স্থানীয় জনগোষ্ঠীর প্রাকৃতিক বিপর্যয়, অর্থনৈতিক চাপ এবং সামাজিক পরিবর্তনের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার সক্ষমতা। এতে জনগণের আত্মনির্ভরতা, দক্ষতা, সহায়ক সামাজিক কাঠামো এবং ঝুঁকি কমানোর ব্যবস্থা অন্তর্ভুক্ত থাকে।

দুইটি ধারণা একত্রে কাজ করলে পরিবেশ সংরক্ষণ এবং স্থানীয় জনগণের নিরাপত্তা ও স্থায়িত্ব নিশ্চিত হয়, যা নদীভিত্তিক বা প্রাকৃতিক বিপর্যয়প্রবণ এলাকায় টেকসই উন্নয়নের জন্য অপরিহার্য।

তিস্তা মহাপরিকল্পনার সফল বাস্তবায়ন বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ উন্নয়ন ছাড়াও দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক জলনীতি ও কূটনৈতিক সম্পর্কের পুনর্গঠন ঘটাতে পারে। ভারত-বাংলাদেশ যৌথ নদী কমিশন (JRC)-এর আওতায় একটি যৌথ পানি ব্যবস্থাপনা কাঠামো গড়ে উঠলে দুই দেশের মধ্যে আস্থা বৃদ্ধি ও সীমান্ত অঞ্চলে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা আসতে পারে। চীনের সম্ভাব্য অর্থায়ন ও প্রযুক্তিগত অংশগ্রহণ প্রকল্পটিকে বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (BRI)-এর সঙ্গে যুক্ত করতে পারে, যা বাংলাদেশের কৌশলগত অবস্থানকে আরও গুরুত্বপূর্ণ করে তুলবে। তবে এতে ভারতের উদ্বেগ ও ভূরাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া সামলাতে বাংলাদেশকে অত্যন্ত দক্ষ কূটনৈতিক ভারসাম্য রক্ষা করতে হবে। বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (Belt and Road Initiative – BRI) হলো চীনের একটি বৃহৎ আন্তর্জাতিক অবকাঠামো ও বিনিয়োগ উদ্যোগ, যা এশিয়া, ইউরোপ, আফ্রিকা ও অন্যান্য অঞ্চলে সড়ক, রেল, বন্দর, বিমানবন্দর এবং অর্থনৈতিক করিডর গড়ে দেশগুলোর মধ্যে বাণিজ্য ও সংযোগ বৃদ্ধি করতে লক্ষ্য করে।

একটি আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংযোগের উদ্যোগ, যা অংশগ্রহণকারী দেশগুলোর বাণিজ্য, অবকাঠামো উন্নয়ন এবং বিনিয়োগের সুযোগ বৃদ্ধি করে, এবং আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক সম্পর্ককে শক্তিশালী করতে সাহায্য করে।

আঞ্চলিক জলনীতি (Regional Water Policy) হলো নদী, জলাশয় ও সেচ ব্যবস্থার ব্যবস্থাপনা ও ব্যবহার সংক্রান্ত নীতি ও পরিকল্পনার একটি কাঠামো, যা একাধিক দেশের মধ্যে পানি সম্পদকে সুষ্ঠুভাবে বিতরণ, ব্যবহার এবং সংরক্ষণ নিশ্চিত করে।

কূটনৈতিক সম্পর্কের পুনর্গঠন (Diplomatic Recalibration) এখানে বোঝায়, বিভিন্ন দেশের সঙ্গে জলসম্পদ সংক্রান্ত সহযোগিতা, চুক্তি এবং আলোচনার মাধ্যমে আস্থা বৃদ্ধি ও বিরোধ নিরসন করা।

আঞ্চলিক জলনীতি ও কূটনৈতিক সম্পর্কের পুনর্গঠন হলো নদী ও পানি ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক বা আঞ্চলিক সহযোগিতা তৈরি করা, যা জলবণ্টন, অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং সুশাসিত সম্পর্কের স্থায়িত্ব নিশ্চিত করে।

তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে উত্তরাঞ্চলে প্রায় ২০ থেকে ২৫ লাখ মানুষের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। মৌসুমি শ্রমিকদের রাজধানীমুখী অভিবাসন কমবে, ফলে গ্রামীণ অর্থনীতি পুনর্জীবিত হবে। নারী কৃষক, ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা ও স্থানীয় যুবসমাজের অংশগ্রহণ বাড়লে সামাজিক কাঠামোতে ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পানি, ও স্যানিটেশন সেবার উন্নতি হবে, যা জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (SDG-6, SDG-8, SDG-13) অর্জনে সহায়ক হবে। তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের মাধ্যমে ২০ থেকে ২৫ লাখ মানুষের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কর্মসংস্থান সৃষ্টির সম্ভাবনা উত্তরের অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাঠামোর একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। প্রকল্পের বাস্তবায়নের সময় এবং পরবর্তীতে নদী ব্যবস্থাপনা, বাঁধ ও সেচ অবকাঠামো নির্মাণ, রিজার্ভয়ার, নদীড্রেজিং এবং তিস্তা ইকোনমিক জোনের শিল্প ও উৎপাদন ইউনিটে সরাসরি শ্রমিক নিয়োগ করা হবে। এর মধ্যে নদী ও সেচ অবকাঠামো নির্মাণে প্রায় ৫০,০০০–৭০,০০০ শ্রমিক কাজ করবে, যারা সাজানো-ভূমি, মাটি উত্তোলন, বাঁধ নির্মাণ এবং যন্ত্রপাতি পরিচালনার দায়িত্বে থাকবে। ইকোনমিক জোনের শিল্প ও প্রক্রিয়াজাতকরণ ইউনিটে ১ থেকে ১.৫ লাখ কর্মী নিযুক্ত হবে, যা অঞ্চলের শিল্পায়ন ও উৎপাদন বৃদ্ধি করবে। তদুপরি, পর্যটন, হোটেল, নৌপর্যটন ও ফিশারি শিল্পে ৩০,০০০–৫০,০০০ মানুষের কর্মসংস্থান তৈরি হবে। সব মিলিয়ে প্রত্যক্ষ কর্মসংস্থান আনুমানিক ২–২.৭ লাখ মানুষের জন্য নিশ্চিত হবে।

পরোক্ষ কর্মসংস্থান হলো প্রকল্পের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত নয়, তবে প্রকল্পের কারণে সৃষ্ট অর্থনৈতিক কার্যক্রম থেকে উদ্ভূত। কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি কৃষক, পরিবহন শ্রমিক, পাইকারী বাজার ও বিতরণ ব্যবস্থায় নতুন সুযোগ সৃষ্টি করবে। শিল্প ও প্রক্রিয়াজাতকরণের সাপ্লাই চেইনে কাঁচামাল সরবরাহ, লজিস্টিক এবং মেরামত সংক্রান্ত কার্যক্রমও কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়াবে। এছাড়া পর্যটন খাতের বিকাশে স্থানীয় দোকান, রেস্টুরেন্ট, হ্যান্ডিক্রাফট এবং সেবা খাতের জন্যও নতুন চাকরি তৈরি হবে। স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং অন্যান্য কমিউনিটি সেবা খাতেও নতুন কর্মসংস্থান হবে। বিশেষজ্ঞরা অনুমান করেন, এই পরোক্ষ কার্যক্রম ১৮–২২ লাখ মানুষকে আঞ্চলিকভাবে আয় ও কর্মসংস্থানের সুযোগ দিতে সক্ষম।

মোট মিলিয়ে প্রকল্পের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কর্মসংস্থান ২০–২৫ লাখ মানুষকে জীবিকা ও আয় নিশ্চিত করবে। এর ফলে শুধু সংখ্যা বাড়বে না, বরং গ্রামীণ অভিবাসন হ্রাস, নারী ও যুবকের অর্থনৈতিক অংশগ্রহণ বৃদ্ধি, এবং স্থানীয় আয় বৃদ্ধির মাধ্যমে জীবনের মান উন্নয়নও নিশ্চিত হবে। উত্তরাঞ্চলের অর্থনীতি ও সামাজিক কাঠামোর উপর তিস্তা মহাপরিকল্পনার প্রভাব দীর্ঘমেয়াদি এবং বহুমুখী হবে, যা অঞ্চলটিকে দেশের আর্থিক ও সামাজিক অগ্রগতির একটি নতুন কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করবে।

তিস্তা মহাপরিকল্পনার প্রধান চ্যালেঞ্জ হলো পানির উৎস নিয়ন্ত্রণে ভারতের ভূমিকায় অনিশ্চয়তা, চীনের অর্থায়নকে কেন্দ্র করে ভূরাজনৈতিক সংবেদনশীলতা, প্রকল্পের আর্থিক স্বচ্ছতা, স্থানীয় জনগণের পুনর্বাসন ইস্যু এবং পরিবেশগত ঝুঁকি। নদী পুনরুদ্ধার ও পানি সংরক্ষণের জন্য উচ্চমানের প্রকৌশল ও দীর্ঘমেয়াদি রক্ষণাবেক্ষণ প্রয়োজন হবে।

তবে এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় বাংলাদেশ যদি “Inclusive Development Framework” গ্রহণ করে—অর্থাৎ, স্থানীয় সম্প্রদায়, বেসরকারি খাত ও আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগীদের যৌথ অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে—তবে এটি দক্ষিণ এশিয়ার একটি মডেল প্রকল্প হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। Inclusive Development Framework হলো একটি নীতি ও পরিকল্পনার কাঠামো, যা উন্নয়নের প্রতিটি ধাপেই সকল জনগোষ্ঠীর সমান অংশগ্রহণ, সুযোগ এবং সুবিধা নিশ্চিত করে। এর মূল লক্ষ্য হলো সামাজিক, অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত বৈষম্য কমানো, যাতে প্রকল্প বা নীতি শুধুমাত্র কিছু মানুষের জন্য নয়, বরং স্থানীয় সম্প্রদায়, নারী, শিশু, শ্রমিক, ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা এবং ভঙ্গুর জনগোষ্ঠীও উন্নয়নের ফল ভোগ করতে পারে।

এটি অন্তর্ভুক্তিমূলক ও সমতার ভিত্তিতে টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করার একটি কাঠামো, যা প্রকল্প বাস্তবায়নে সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং পরিবেশগত দায়িত্ববোধ নিশ্চিত করে।

তিস্তা মহাপরিকল্পনা কেবল একটি নদী পুনরুদ্ধার উদ্যোগ নয়; এটি বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের অর্থনৈতিক মুক্তির সম্ভাবনাময় ঘোষণা। নদী ব্যবস্থাপনা, কৃষি, শিল্প, পর্যটন ও সামাজিক উন্নয়নের সমন্বিত প্রয়াসের মাধ্যমে তিস্তা একটি “রিভার অব লাইফ” রূপে পুনর্জন্ম নিতে পারে। তবে এই সম্ভাবনাকে বাস্তব সাফল্যে রূপ দিতে হলে প্রয়োজন দূরদর্শী নীতি, আঞ্চলিক সহযোগিতা, পরিবেশবান্ধব পরিকল্পনা ও জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ। “রিভার অব লাইফ” বলা হয় কারণ এটি উত্তরবাংলার মানুষের জীবনধারণ, কৃষি, পানির সরবরাহ, খাদ্য উৎপাদন এবং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে সাপ্লাই করে। নদীর পানি এবং অববাহিকা স্থানীয় কৃষি, মৎস্য চাষ, শিল্প ও জীববৈচিত্র্যকে জীবন্ত রাখে, ফলে এটি শুধু একটি নদী নয়—উত্তরাঞ্চলের মানুষের অর্থনৈতিক ও সামাজিক জীবনধারার অবিচ্ছেদ্য অংশ। সংক্ষেপে, তিস্তা নদী অঞ্চলের জীবন, উন্নয়ন এবং সমৃদ্ধির মূল ধারা।

তিস্তার জলরাশি তাই কেবল প্রকৃতির নয়—এটি উত্তরবাংলার স্বপ্ন, আত্মনির্ভরতার প্রতীক এবং টেকসই বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পুনর্জাগরণের প্রবাহমান প্রতিজ্ঞা।উত্তরবাংলার অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে তিস্তা নদীর গুরুত্ব অমুল্য। এটি হিমালয়ের পাদদেশ থেকে উৎপন্ন হয়ে ভারতের সিকিম ও পশ্চিমবঙ্গ অতিক্রম করে বাংলাদেশের রংপুর বিভাগের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয় এবং অবশেষে ব্রহ্মপুত্র নদীতে মিলিত হয়। নদীটির মোট দৈর্ঘ্য প্রায় ৩১৫ কিলোমিটার, যার মধ্যে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্ত অংশ প্রায় ১২৪ কিলোমিটার। তিস্তা নদী শুধু একটি জলাধার নয়; এটি উত্তরাঞ্চলের কৃষি, শিল্প, অর্থনীতি এবং সামাজিক জীবনধারার মূল ভিত্তি। নদীর পানি বর্ষার সময় অতিরিক্ত জল ধারণ করে বন্যা নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে, শুষ্ক মৌসুমে সেচের জন্য অপরিহার্য পানি সরবরাহ করে এবং চরাঞ্চলের মৎস্যচাষ ও প্রাকৃতিক জীববৈচিত্র্যকে সংরক্ষণে ভূমিকা রাখে।

উত্তরাঞ্চল দীর্ঘদিন ধরে খরাপ্রবণ এবং বন্যা-প্রবণ এলাকা হিসেবে পরিচিত। নদী ভাঙন, বালু উত্তোলন, পানিপ্রবাহের অনিয়ম এবং আবহাওয়ার চরম পরিবর্তন এখানে কৃষি ও জীবনযাত্রাকে প্রভাবিত করছে। এসব সমস্যার সমাধানে তিস্তা নদীর সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা অপরিহার্য। এই প্রেক্ষাপটে “তিস্তা মহাপরিকল্পনা” একটি বহুমাত্রিক উদ্যোগ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। এটি কেবল নদী ব্যবস্থাপনার প্রকল্প নয়; বরং উত্তরাঞ্চলের টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়ন, শিল্পায়ন, কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি, মৎস্যচাষ, পর্যটন সম্প্রসারণ এবং স্থানীয় জনগণের জীবনমান উন্নয়নকে লক্ষ্য করে গড়ে তোলা হয়েছে।

প্রকল্প বাস্তবায়ন সফল হলে উত্তরাঞ্চলের প্রায় ২০–২৫ লাখ মানুষ সরাসরি ও পরোক্ষভাবে কর্মসংস্থানের সুযোগ পাবেন। নদী তীরবর্তী এলাকায় ইকো-ট্যুরিজম, কৃষি-ভিত্তিক শিল্প ও প্রক্রিয়াজাতকরণ ইউনিট, তিস্তা ইকোনমিক জোন এবং নদী সংরক্ষণ প্রকল্পের মাধ্যমে আঞ্চলিক অর্থনীতিকে শক্তিশালী করা সম্ভব হবে। তিস্তা নদীকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠবে নর্থ ইকোনমিক করিডর, যা উত্তরাঞ্চলকে দেশের বাণিজ্যিক ও শিল্পিক কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করবে।

পরিবেশগত দিক থেকেও প্রকল্প গুরুত্বপূর্ণ। ইকোলজিক্যাল রেস্টোরেশন ও কমিউনিটি রেজিলিয়েন্স নিশ্চিত করার মাধ্যমে নদীর ক্ষতিগ্রস্ত চরাঞ্চল পুনরুদ্ধার করা হবে, এবং স্থানীয় জনগণ প্রাকৃতিক বিপর্যয় ও অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা অর্জন করবে। একই সঙ্গে আঞ্চলিক জলনীতি ও কূটনৈতিক সম্পর্কের পুনর্গঠন নিশ্চিত হলে নদীর পানিবণ্টন ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা আরও সুষ্ঠু হবে।

লেখক : গণমাধ্যমকর্মী।